ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার নয় মাসের মাথায় দলটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দীর্ঘদিনের দাবির ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জুলাই গণহত্যায় অভিযুক্ত দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে তীব্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শনিবার (১০ মে) রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতি পাঠানো হয়।
এতে জানানো হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে জানিয়ে বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আজকের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ওই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলাসহ সহিংসতায় এক হাজার চারশ’ জন নিহত হন। আহত হন হাজার হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, কেউ হারিয়েছেন চোখের আলো।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তাদের বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছাত্র-জনতা। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে হত্যা মামলার আসামি আওয়ামী লীগের লোকজন গোপনে দেশ ছেড়ে পালালে ক্ষোভ ঝাড়তে থাকে ছাত্র-জনতা। এর মধ্যে আবার ঢাকা, গোপালগঞ্জসহ দেশের কিছু স্থানে অভ্যুত্থানকারীদের ওপর আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডারদের হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে।
অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার অভিযোগ, প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষকে আহত করার পরও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বা মন্ত্রী-এমপিদের কারও বক্তব্য-বিবৃতিতে কোনো ধরনের অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ দেখা যাচ্ছিল না। উরপন্তু অভ্যুত্থান নিয়ে তারা নানা ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব দেখিয়ে আন্দোলনকারীদেরই ভবিষ্যতে দেখে নেওয়ার হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল। বিশেষ করে সাইবার স্পেসে অভ্যুত্থানকারী ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সমন্বিত অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল তারা। এ নিয়ে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছিল।
এর মধ্যে গত ৭ মে গভীর রাতে চুপিসারে আওয়ামী লীগ আমলের দুইবারের রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের প্রেক্ষাপটে দলটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি আরও জোরদার হয়। ৮ মে রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়।
এতে হাসনাতের দল এনসিপির পাশাপাশি যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, আপ বাংলাদেশ, জুলাই ঐক্য, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থী, ইনকিলাব মঞ্চসহ গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন।
৯ মে শুক্রবার সকালে ওই কর্মসূচি থেকে জুমার নামাজের পর বড় সমাবেশের ঘোষণা দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। এজন্য যমুনা ভবনের পাশেই মিন্টো রোড সংলগ্ন ফোয়ারার কাছে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিকেলে সেখানে সমাবেশ শেষে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ অবরোধ করেন। ওই কর্মসূচিতে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যোগ দেয়। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কর্মসূচি থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়।
শনিবার রাতে ওই আলটিমেটাম শেষ হলে আন্দোলনকারীরা আবার শাহবাগ ছেড়ে যমুনার অদূরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। এর মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠক থেকেই এলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত।
এফএইচ/এমআইএইচ/এএটি/এইচএ/