‘আমার মেয়ে কই? আমার মেয়েকে দেখেছেন? ওর নাম মরিয়ম, ক্লাস থ্রিতে পড়ে’—হিজাব পরা ৩৪ বছর বয়সী এক নারী রাজধানীর উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হন্তদন্ত হয়ে এভাবেই খুঁজছিলেন তার সন্তানকে।
বিকেল ৩টা থেকে মরিয়মকে খোঁজা শুরু করেন তার স্বজনরা।
মেয়েটির পুরো নাম আফিয়া উম্মে মরিয়ম, বয়স ৯ বছর। বাসা থেকে স্কুল মাত্র ১০ মিনিটের পথ। প্রতিদিনের মতো সে স্কুল শেষে কোচিং করে দুপুর ৩টার মধ্যে বাড়ি ফিরত। দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট মরিয়ম।
‘ওর ক্লাসরুমের সামনেই বিমানটা বিধ্বস্ত হয়,’ বলছিলেন মরিয়মের চাচাতো বোন সায়রা।
স্কুলের বাংলা শিক্ষক সুমন স্যার জানিয়েছেন, ‘ওকে আরও চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে শেষবার দুপুরে ভাত খেতে দেখেছিলাম। রুম থেকে বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই দুর্ঘটনাটা ঘটে। ’
মরিয়মের মতো আরও অনেক শিশু এখনো নিখোঁজ। তৃতীয় শ্রেণির নিধি, নুসরাত জাহান—এদের কেউই এখনো পরিবারের কাছে ফিরে আসেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই সন্তানের প্রাণে বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলেছেন।
এখন শুধু চাচ্ছেন—যদি অন্তত দেহটা খুঁজে পান! তাই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনরা।
নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে—প্রথমে ১৭, তারপর ১৯, ২০, আর এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তা ২২ জনে গিয়ে ঠেকেছে।
তৃতীয় শ্রেণির ক্লাউড (মেঘ) সেকশনের সায়মা আক্তার যেন মুহূর্তেই এক কালো মেঘে ঢেকে গেল। আগুনের উত্তাপে ঝলসে গেছে জুনায়েদ আহসানও, একই শ্রেণির শিক্ষার্থী।
এদিকে দুপুর থেকে উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে একের পর এক স্ট্রেচারে করে আসেন দগ্ধরা। আহতদের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বেড়ে যায় নিখোঁজদের খোঁজে ছুটে আসা পরিবারগুলোর। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত—তবু অনেক পরিবার এখনো প্রিয় মুখটি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
হাসপাতালের করিডোরে ছুটোছুটি, আর্তনাদ, দিশেহারা স্বজনদের কান্না—কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আপনজন, কেউই জানে না কে বেঁচে আছে, কে আর নেই।
কেউ কেউ বুক চাপড়ে কাঁদছেন। সকালে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসেছিলেন যিনি, দুপুরেই হয়তো ভেবেছিলেন একসঙ্গে ভাত খাবেন। কিন্তু সেই দুপুরই যেন হয়ে উঠল চিরকালের জন্য নিঃসঙ্গ এক নিদ্রার।
হাসপাতাল থেকে যে আহত-নিহতদের তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে, সেই তালিকায় চোখ আটকে আছে অভিভাবকদের—আশা, ভয় আর আকুলতায়, যদি কোথাও দেখা মেলে আমার সন্তানের নামটা।
সারা দেশ আজ শোকে স্তব্ধ। মানুষের মুখে একটাই বাক্য—আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভবিষ্যতের ফুলগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেল চোখের সামনেই।
শায়ান ইউসুফ—৯৫ শতাংশ দগ্ধ, মাহতাব—৮৫ শতাংশ, মাহিয়া তাসনিম—৫০ শতাংশ। প্রায় সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।
‘মা, আমার সব জ্বলে গেছে,’—বলে কেঁদে উঠেছিল পঞ্চম শ্রেণির নুরে জান্নাত। তার কপাল, পিঠ পুড়েছে, মুখ ঝলসে গেছে, মাথায় চোট লেগেছে। মা ইয়াসমিন শোকে বাকরুদ্ধ।
একই দিনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়—নিহতদের মধ্যে সাতজন শিশু এতটাই পুড়ে গেছে যে তাদের অবয়ব শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জানান, এই সাত শিশুর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
আজকের দিনটিতে চোখে পড়েছে স্কুল শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম। কেউ পানি, কেউ স্যালাইন, কেউ শুকনো খাবার বিতরণ করছে। হাসপাতালে প্রবেশ রোধে কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। অনেক শিক্ষার্থী এই দগ্ধ দিনে স্বেচ্ছাসেবার দায়িত্ব নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে তৎপরতা। কেউ রক্তের জন্য আবেদন জানাচ্ছেন, কেউ দিচ্ছেন লাইভ আপডেট। হাসপাতাল থেকে যখনই রক্তের আহ্বান জানানো হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিচ্ছেন মানুষ।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলেও বার্ন ইনস্টিটিউটের ভেতরে যেন থমকে আছে ২১ জুলাইয়ের সেই বিভীষিকা। একেকটি পরিবার ছুটে চলেছে এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে—প্রিয় মুখটিকে খুঁজে পাওয়ার আশায়।
বিকেল থেকে শুরু হওয়া মাইকিং থেমে নেই। প্রতিবারই মাইকের শব্দে চমকে উঠছেন বাবা-মায়েরা—এই বুঝি নিজের সন্তানের খবর এলো।
পিএ