ঢাকা, শনিবার, ১১ আশ্বিন ১৪৩২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

ঢাকার মিরপুরে পাওয়া গেল আসামের সাকিনা বেগমকে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৩৪, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫
ঢাকার মিরপুরে পাওয়া গেল আসামের সাকিনা বেগমকে আসামের নলবাড়ির বাসিন্দা সাকিনা বেগম (বাঁয়ে) ঢাকার মিরপুরের ঘিঞ্জি এলাকায়

মে মাসের ২৫ তারিখ। আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুরা গ্রাম থেকে পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সাকিনা বেগমকে।

তারা বলেছিল যে, থানায় একটা সই করাতে হবে, তারপরে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

ওই একই সময়কালে আসামের কয়েকশো মানুষকে এভাবেই ‘সই’ করানোর নাম করে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদের অনেককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, কারও ঠাঁই হয়েছে ‘বিদেশী’দের আটক-শিবিরগুলোয়।

তবে অনেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে পারলেও ৬৫ বছর বয়সী সাকিনা বেগমের আর কোনো খোঁজ পায়নি তার পরিবার।

ঢাকার মিরপুরে পাওয়া গেল সাকিনা বেগমকে

বিবিসি কয়েকদিন আগে জানতে পারে মিরপুরের একটি ঘিঞ্জি অঞ্চলে এক বৃদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন, যার বাড়ি ভারতের আসামে।

গুগল ম্যাপে সার্চ করে দেখা গেল যে, ওই বৃদ্ধা যে এলাকার নাম বলছেন, সেই নলবাড়ি আসামের একটি জেলা, সেখানে তার দেওয়া নামের গ্রামও আছে।

বিবিসি আসামের নলবাড়ি জেলায় একটি সূত্রের কাছে জানতে চায় যে, বরকুরা গ্রামে সাকিনা বেগম নামে কোনো নারী নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন কি না।

ঘটনাটি অনেকেরই জানা, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, সাকিনা বেগম নামে একজন বৃদ্ধাকে বরকুরা থেকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল মে মাসে। তার আর খোঁজ পায়নি পরিবার।

এরপরের ধাপে শুরু হলো পরিচিতি যাচাই করা। ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতার কাছে ছিল সাকিনা বেগমের ছেলে-মেয়েদের নাম আর তারা কী কাজ করেন, সেই তালিকা।

ভারতে বিবিসির সংবাদদাতা জোগাড় করলেন এক ছেলে আর এক মেয়ের ফোন নম্বর। তারা আবার অসমীয়া ছাড়া কিছু বলতে পারেন না, কারণ তারা খিলঞ্জিয়া মুসলমান। অর্থাৎ আসামের ভূমিপুত্র এবং ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গ থেকে যে বাংলাভাষী মুসলমানদের আসামে চাষ-আবাদের কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক জনগোষ্ঠী। এদের পূর্বপুরুষরা ১২শ শতক নাগাদ আসামে আসেন।

তার বড় মেয়ে রাসিয়া বেগম নামের যে নারীর ফোন নম্বর পাওয়া গিয়েছিল, তার কাছে প্রথমেই বিবিসি জানতে চায়, সাকিনা বেগম কে হয় আপনার? তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, উনি তো আমার মা, কী হয়েছে মায়ের? এরপরে তিনি গ্রামেরই এক হিন্দি জানা নারীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।

তাদের কাছে পুরনো যে ছবি আছে তার মায়ের, সেটা দিতে বলা হয়। অন্যদিকে ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতার হাতে ছিল সাকিনা বেগমের সবশেষ ছবি। দুটি ছবি মিলিয়ে দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায় বরকুরা গ্রাম থেকে মাস চারেক আগে পুলিশ যে সাকিনা বেগমকে নিয়ে গিয়েছিল, তিনিই ঢাকার মিরপুরে অবস্থানরত সাকিনা বেগম।

নিশ্চিত হওয়ার পর আসামে সাকিনা বেগমের বড় মেয়ের নম্বরে ঢাকা থেকে পাওয়া ছবি পাঠানো হয়। মুহূর্তে জবাব আসে, এটাই তো আমার মা!

সাকিনা বেগমের বড় মেয়ে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলেন তার মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। ঠিক হলো বিবিসির ঢাকার সংবাদদাতা তফসিরুল ইসলাম আর ভারতের সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী একই সময়ে দুই প্রান্ত থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেবেন সাকিনা বেগমের সঙ্গে তার ছেলে-মেয়েদের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার মিরপুরে পৌঁছান তাফসীর বাবু, আর আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুরা গ্রামে পৌঁছান অমিতাভ ভট্টশালী।

নলবাড়িতে তখন হাজির সাকিনা বেগমের তিন মেয়ে ও ছোট ছেলে। বড় ছেলে ব্যাটারি রিকশা চালান, একদিন কাজে না গেলে খাবার জুটবে না, তাই তিনি নিখোঁজ মাকে দেখতেও আসতে পারেননি।

অধীর আগ্রহে দুই দেশে অপেক্ষা করছিল পুরো পরিবার। তাফসীর বাবু যখন ভিডিও কলটা করে সাকিনা বেগমকে দেখিয়ে বললেন, এরা কি আপনার ছেলে মেয়ে হয়? ঢাকার ঘুপচি ঘরে বসে ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই তিনি বলে ওঠেন, এই তো আমার মেয়ে...!

অন্যদিকে ভারতের আসামে গ্রামের বাড়িতে মাকে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন তার ছেলে-মেয়েরা। ওহ.. মা গো...!

দুই পাড়েই তাদের আশেপাশে জড়ো হয়েছিলেন কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধু, আর সাকিনা বেগমের পাশে ছিল ঢাকায় তার আশ্রয়দাতা পরিবারটি। কান্নার রোল, ভারতে ফেরার আকুলতা, ছেলে-মেয়ে আর নাতিদের খোঁজ-খবর কোন কিছুই বাদ থাকলো না।

বিশ মিনিটেরও বেশি কথা হলো। ছেলে-মেয়েরা বার বার মাকে আশ্বাস দিতে লাগলেন যে, তিনি যেন দুশ্চিন্তা না করেন, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনবেনই। ভারতের পরিবারটি কৃতজ্ঞতা জানাল ঢাকার পরিবারকে, তাদের মাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য।

মিরপুরের এক পরিবার আশ্রয় দেয়

কয়েক মাস আগে এলাকার এক দোকানের সামনে বসে এক বৃদ্ধাকে কাঁদতে দেখেন বাংলাদেশের মিরপুরের একটি ঘিঞ্জি অঞ্চলের বাসিন্দারা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে কী বলছিলেন, সেটা কিছুই বুঝতে পারেননি সেখানকার মানুষ। কারণ তার মুখের ভাষা ভিন্ন। তিনি শুধু বারবার বলছিলেন যে তার বাড়ি নলবাড়িতে।

বৃদ্ধাকে কান্নাকাটি করতে দেখে তাকে আশ্রয় দেয় এলাকারই এক পরিবার। ধীরে ধীরে মিরপুরের ওই পরিবারটি বুঝতে পারে যে বৃদ্ধার বাড়ি সম্ভবত ভারতে। তিনি কীভাবে বাংলাদেশে এলেন, তা শুনে ইঙ্গিত পাওয়া গেল যে তাকে সম্ভবত ‘পুশ-ইন’ করা হয়েছিল।

সাকিনা বেগম বলছিলেন, “থানার পুলিশ আমার গ্রামে গিয়েছিল। বলল, আপনার একটা সই নেব, আর আপনাকে নিয়ে আসব। আমার সঙ্গে আমার ছেলেও ছিল। পুলিশ কিন্তু আমাকে থানায় নিয়ে যায়নি।

ওরা হিন্দিতে কথা বলছিল। চারদিকে তারকাঁটার বেড়া। সেখানে একটা বড় লোহার দরজা ছিল। তাদের লোক এসে তালা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল, তোমরা এখান দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাও, হল্লা করো না…, এতটুকুও শব্দ করবেন না। ”

ওই বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলছিলেন সাকিনা বেগম। তখনও তিনি বুঝতে পারেননি যে তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই রাতেই রাস্তায় বাসের দেখা পেয়ে তিনি তাতে উঠে পড়েন।

গত কয়েক মাসে আশ্রয়দাতা পরিবারটিকে তিনি যা জানিয়েছেন তার মাতৃভাষা অসমীয়াতে, তা থেকে ওই পরিবারটির সদস্যরা মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছেন যে সীমান্ত থেকে কীভাবে ঢাকায় এসে পৌঁছিয়েছিলেন সাকিনা বেগম।

ওই পরিবারটির সদস্য ক্লান্তি আখতার বলেন, “উনি বাসে ওঠার পরে বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে উনাকে। উনি বলেছেন যে, আমি নলবাড়ি যাব। ”

বাসের লোকেরা তো আর নলবাড়ি চেনেন না, তাই বারে বারে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছেন তাকে। আবারও আরেকটা বাসে উঠেছেন তিনি। এইভাবে নানা বাসে আসতে আসতে একদিন আমাদের ওইদিক দিয়ে ঢুকে ওখানে একটা দোকান আছে, ওখানে বসে কান্না করছেন, বলছিলেন ক্লান্তি আখতার।

দুই দেশের ভিডিও কলে কথা বলানোর আগে সাকিনা বেগমের বড় মেয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ঠিক কীভাবে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তাদের মা।

রাসিয়া বেগম বলছিলেন, “সই করানোর জন্য এসপি অফিসে আমার মাকে নিয়ে যায় ২৫ তারিখ (মে মাসের)। আমার ছোট ভাই আর মেজো বোন এসপি অফিসে গিয়েছিল। এসপি অফিস থেকে বলা হয় যে গোয়ালপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে মাকে। এর তিন-চারদিন পরে আমি গোয়ালপাড়া গিয়েছিলাম। গোয়ালপাড়া ক্যাম্পে আমাদের কিছুই বলল না ওরা, বলল যে কোনো অর্ডার হয়নি, ১৫ দিন পরে এসো। ১৫ দিন পরে যখন আমরা যাই, সেখানে আমার মা ছিল না। মোট তিনবার গেছি গোয়ালপাড়াতে। ”

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, “আমার মা আছে নাকি আমার মা মারা গেছে না কী হয়েছে, এটাই তো জানতে পারছি না আমরা। মানুষটার কোনো সন্ধান নেই। মা কোথায় আছে, যে আমি খুঁজতে যাব, সেই ক্ষমতা আমার নেই। ”

পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং নথিপত্র থেকে জানা যায়, সাকিনা বেগমকে আসামের বিদেশি ট্রাইব্যুনাল আগেই বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে এবং সেই একই রায় বজায় রেখেছে গুয়াহাটি হাইকোর্টও।

এরপর সাকিনা বেগমকে বিদেশিদের জন্য আটক শিবিরে বন্দি করেও রাখা হয়েছিল। করোনার সময়ে জামিনে মুক্তি পান তিনি। তারপর থেকে নিয়মিত স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে যেতে হতো তাকে।

এই তথ্য জানার পরেই সন্দেহ হয় যে তাকে হয়তো আরও অনেকের মতোই বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় আসাম সরকারেরই দেওয়া একটি তথ্যে।

আসামের বোড়োল্যান্ড স্বশাসিত এলাকার সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়ন এবিএমএসইউ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছিল গৌহাটি হাইকোর্টে, যেখানে তারা ২১ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেছিল যে, তাদের পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর থেকে পরিবার কোনো খোঁজ পায়নি।

আসামে নিয়মিতই ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ধরার অভিযান চলতে থাকে, তাদের বাংলাদেশে পুশ-ব্যাকও করা হয়।

কিন্তু মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে যে বিশেষ অভিযান শুরু হয়, সেখানে বেছে বেছে সেই সব ব্যক্তিদের আটক করা হয়, যাদের ‘ঘোষিত বিদেশি নাগরিক' বলে রায় দিয়েছিল ওই রাজ্যের ‘বিদেশি ট্রাইব্যুনাল’।

এদের অনেকে সেই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করলেও তাদের সাকিনা বেগমের মতোই থানায় ‘সই’ করতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আটক করা হয়।

ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলি অভিযোগ করছে, বহু ভারতীয় নাগরিককে বিদেশি বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে নথিপত্রে সামান্য ভুলের জন্য।

ভারতে তারা বিদেশি বলে চিহ্নিত হলেও কোন দেশের নাগরিক সেটা আবার নির্দিষ্ট করা হয়নি। অভিযোগ, তাদের অনেককেই প্রচলিত নিয়ম ভেঙে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে।

আসামের ওই বিশেষ অভিযানে কতজন আটক হয়েছেন, সেই সংখ্যা সরকার বা আসাম পুলিশ জানায়নি, তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, তাদের হিসাব মতো বিশেষ অভিযানের প্রথম দিন দশেকের মধ্যে তিন শতাধিক মানুষকে আটক করা হয়েছিল, যাদের আগে বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলো বিদেশি বলে ঘোষণা করে দিয়েছে।

আবার পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাসিন্দাকেও বিভিন্ন রাজ্যে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সাকিনা বেগম এবং আরও ছয়জনের ব্যাপারে আসাম সরকার আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে, তাদের বিএসএফের যে সেক্টর হেডকোয়ার্টার আছে ধুবরী জেলায়, তাদের কাছে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে।

সাকিনা বেগমের ঘটনা জানিয়ে ঢাকার স্থানীয় ভাষানটেক থানায় যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা বলেছেন, ঘটনার তদন্ত এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাকিনা বেগম আশায় আছেন এই শেষ বয়সে পরিবারের কাছে ফিরে যাবার। তার ছেলে-মেয়েরা বলছিলেন, আমাদের মাকে ছাড়িয়ে এনে দিন... আপনাদের কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, মাকে আমাদের কাছে এনে দিন। দিনরাত মায়ের কথা চিন্তা করে করে আমাদের দানা-পানি খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে!

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।