দেশের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ অনেক ব্যবসায়ীর পণ্য এক আগুনেই ছাই হয়ে গেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনের উত্তাপ থেকে বাদ যায়নি পোশাক থেকে শুরু করে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মালামাল ও ই-কমার্সের উদ্যোক্তাদের পণ্য।
গতকাল ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের ৮ নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরায় গার্মেন্ট পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘ফার্স্ট অ্যান্ড সেফ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. বেনজির বলেন, হংকং ও চীন থেকে দুটি শিপমেন্টের রেডিমেড গার্মেন্টের পণ্যগুলো পুড়ে গেছে। স্যাম্পল প্রোডাক্টও ছিল। তিনি আরও বলেন, আমি ছোট ব্যবসায়ী, লাখ পাঁচেক টাকার মালামাল পুড়লেও এটা অনেক ক্ষতি। আজ আমার মালামাল খালাস করার কথা ছিল।
জেমটেক্স লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইমরান আহমেদ বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা প্রায় ৪০ কেজি লেইচ (অ্যাক্সেসরিজ) ছিল কার্গো ভিলেজে। দাম প্রায় দুই কোটি টাকা। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জানিয়েছে, ওই মালামাল পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ৯৯ ভাগ। তিনি বলেন, দ্রুত প্রয়োজন হওয়ায় আকাশপথে এই অ্যাক্সেসরিজ আমদানি করেছিলাম। যার মাধ্যমে ১ লাখ ৬২ হাজার ডলারের রপ্তানি হওয়ার কথা। সম্ভবত এ রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এর আগে আমার রপ্তানির ডেট ফেল করেছি। এ মাসের শেষ পর্যন্ত পণ্য দিতে পারলে ক্রেতা নিতেন।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শাওন এন্টারপ্রাইজের মো. শাহিনুর ইসলাম বলেন, আগুনে চট্টগ্রাম হাসপাতালের কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে। যার মূল্য ৩৬০০ ডলারের মতো। আজকে আমাদের পণ্য বুঝে নেওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত এ পণ্যের কোনো খোঁজ পাইনি। ধারণা করছি আগুনে পুড়ে গেছে।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পরে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সামনে লিখিত বক্তব্যে ইনামুল হক বলেন, সাধারণত উচ্চ মূল্যের পণ্য এবং জরুরি শিপমেন্টের ক্ষেত্রে আকাশপথে জাহাজিকরণ করা হয়। আগুনে তৈরি পোশাক, মূল্যবান কাঁচামাল এবং নতুন ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পল পণ্য পুড়ে গেছে। প্রতিদিন ২০০-২৫০টি কারখানার পণ্য আকাশপথে রপ্তানি হয় জানিয়ে ইনামুল হক খান বলেন, ক্ষতির পরিমাণ অনেক হতে পারে। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে শিগগিরই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে একটি সমন্বয় সভা করবে বিজিএমইএ। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘আমরা ভিতরে গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি। পুরো আমদানি বিভাগ পুড়ে গেছে। তিনি জানান, ঘটনাস্থলে বাণিজ্য উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে নতুন পণ্যের আমদানি কার্যক্রমে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। আপাতত টার্মিনাল-৩-এ নতুন স্থানে আমদানি পণ্য রাখার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা। এ ছাড়া ৭২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত পণ্য খালাসের নির্দেশনা দিয়েছেন উপদেষ্টা।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘দেশের রপ্তানি খাত সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত। যে পণ্য এখানে ছিল সেটা পুড়ে গেছে। কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে। পুড়ে যাওয়া পণ্যের চেয়েও বহুগুণ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের একটা পরিস্থিতিতে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই আমাদের আগানো সম্ভব নয়। আমরা কি এটা প্রশ্ন করতে পারি বা আমরা কি ভেবে নিতে পারি যে, এর আগেও বিগত বছরগুলোতে আমরা এরকম দেখেছি। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আগুন লাগত। এটা ষড়যন্ত্রমূলক ও পরিকল্পিত কি না তা সরকারকে ভেবে দেখা উচিত। ’
বিজিএপিএমইএ সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, আমাদের সদস্যদের ১০০ কোটি টাকার বেশি পণ্য আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়েছে। তবে বেশির ভাগ পণ্য বিমার আওতার মধ্যে আছে। ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ ঠিকমতো পেলে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি এফবিসিসিআই সমবেদনা জানায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।
এদিকে, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বিবৃতিতে বলেন, দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরসহ অন্য বন্দরগুলোর সব স্তরে অগ্নিনিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন গতকাল কার্গো ভিলেজ পরিদর্শন শেষে বলেন, আমদানি করা যত পণ্য ছিল সব আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত সেটা আমরা খাতভিত্তিক নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করছি। গতকাল রাতেও বাণিজ্যিক কার্গো এসেছে। আমাদের বাণিজ্যিক সহায়তার স্বার্থে এসব কার্যক্রম বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তৃতীয় টার্মিনাল এলাকায় বিকল্প জায়গা দেওয়া হয়েছে, যাতে পণ্য পরিবহন চালু থাকে। তিনি বলেন, বর্তমানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে ড্যামেজ অ্যাসেসমেন্টের কাজ চলছে। ধ্বংসের আর্থিক ক্ষতি ও ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের ওজন নির্ধারণের পাশাপাশি খাতভিত্তিক বিশ্লেষণের কাজও করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নাশকতাসহ কোনো কিছু উড়িয়ে দেব না।
এদিকে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বিশেষ ব্যবস্থায় চালু রাখার কথা জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর জানায়, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ আপাতত জিএসই মেনটেন্যান্স নামক স্থানে পণ্য রাখার জন্য স্থান নির্ধারণ করেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ওই স্থানে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করছে, ৯ নম্বর গেটে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ওই গেট দিয়ে পণ্যের খালাস প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হচ্ছে।
এনডি