ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন, ধর্ষণও গণহত্যা

প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৫
প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে

ঢাকা: এতোদিন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চললেও এবার সরাসরি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কিশোরগঞ্জের দু’জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছেন প্রসিকিউশন। একইসঙ্গে আনা হয়েছে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের বিষয়টিও।



শুধু তাই নয়, এ মামলাটিতেই প্রথমবারের মতো হত্যার বাইরে ‘ধর্ষণকে’ ‘গণহত্যা’ হিসেবে তুলে ধরে অভিযোগ গঠনের আরজি জানানো হয়েছে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে।

ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করলে এটিই হবে প্রথম মামলা, যেখানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
 
আসামি দু’জনের মধ্যে পলাতক রয়েছেন রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হুসাইন। অপর আসামি মোহাম্মদ মোসলেম প্রধান গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। তারা দু’জনই কিশোরগঞ্জের নিকলি উপজেলার বাসিন্দা।
 
বৃহস্পতিবার (০৩ ডিসেম্বর) আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। পরে অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে আগামী ২৯ ডিসেম্বর আদেশের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
 
হুসাইন-মোসলেমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছে।    
 
অভিযোগ দাখিলের পর এ মামলাটিকে ‘ক্লাসিক্যাল মামলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে সাংবাদিকদের তুরিন আফরোজ বলেন, এ মামলাটির কয়েকটি বিশেষ দিক রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, এ মামলাটিতেই প্রথমবারের মতো প্রসিকিউশন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছেন আসামিদের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে আনা হয়েছে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের বিষয়টি।
 
যুদ্ধাপরাধের একটি ঘটনার আংশিক বর্ণনা দিয়ে তুরিন বলেন, অনেক মামলার রায়েই কিন্তু ট্রাইব্যুনাল এবং উচ্চ আদালত বলেছেন, তখন (১৯৭১ সালে) একটি আন্তর্জাতিক অস্ত্রবিরোধ (আর্মস কনফ্লিক্ট) চলছিল।
 
যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে একটি অস্ত্রবিরোধ চলছিল সেহেতু আমরা জানি যে, যুদ্ধকালে জেনেভা কনভেনশন অপারেটিভ হয়ে দাঁড়ায়। এবং সে সময় যুদ্ধ হয়েছে। অপরাধীরা তখন নানাভাবে জেনেভা কনভেনশনকে লঙ্ঘন করেছেন- সেটিই এই মামলায় উঠে এসেছে।

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের বিষয়েও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তুরিন।
 
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কিভাবে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করা হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে তুরিন বলেন, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ভিকটিমের মৃতদেহকে সম্মান দেখাতে হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, একজনকে হত্যা করার পর মৃতদেহটি পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বা পুঁতে ফেলা হয়েছে কিংবা ফেলে রেখে চলে যাওয়ার পর কুকুর-শিয়াল কামড়ে নিয়ে চলে গেছে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী এর দায় প্রতিপক্ষের।

এ মামলায় দুজন বীরপ্রতীককে (মরণোত্তর) হত্যার পর তার মৃতদেহটিকে গাড়ি দিয়ে টেনে দেড় কিলোমিটার নিয়ে যাওয়ার পর রিকশা করে সেই মৃতদেহ পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে।   সেই দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন- খায়রুল জাহান এবং মোহাম্মদ সেলিম। শুধু তাই নয়, এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মাকে রক্তমাখা প্যান্ট দেখিয়ে অপরাধীরা বলেছেন, ‘এটি তোমার ছেলের রক্ত, সে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল’।

‘নিঃসন্দেহে এ ঘটনাগুলো জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধকালে রাষ্ট্রের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, এটি তার মধ্যেও পড়ে’- বলেন তুরিন আফরোজ।
 
ব্যাখ্যা করে তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেন, একটি হত্যাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে প্রমাণ করতে গেলে যেটি দরকার সেটি হচ্ছে, দেখাতে হবে- যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি জেনেভা কনভেনশনের অধীনে সুরক্ষা পেয়েছেন কি-না। হতে পারেন তিনি একজন সাধারণ নাগরিক অথবা একজন যুদ্ধবন্দি। এ মামলায় এটি আমাদের প্রমাণ করতে হবে।
 
আরও প্রমাণ করতে হবে যে, সংঘটিত হত্যাকাণ্ডটি বা হত্যাকাণ্ডগুলো একটি আন্তর্জাতিক অস্ত্রবিরোধের (আর্মস কনফ্লিক্টের) মধ্যে হয়েছে।

এ দু’টি বিষয় যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে যুদ্ধাপরাধ হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে তা প্রমাণ করতে হয় না। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধ শান্তিকালীন সময়েও সংঘটিত হতে পারে আবার যুদ্ধকালীন সময়েও সংঘটিত হতে পারে।
 
তবে অপরাধীর যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের আগে প্রসিকিউশনকে প্রমাণ করতে হবে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক (ইন্টারন্যাশনাল) অস্ত্রবিরোধ না অভ্যন্তরীণ (নন-ইন্টারন্যাশনাল) অস্ত্রবিরোধ। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিলে এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের জোরালো উপস্থাপনা থাকবে বলেও জানান তুরিন আফরোজ।
 
তিনি বলেন, জেনেভা কনভেনশনের অ্যাডিশনাল প্রটোকল( ১)’র আর্টিকেল (১) এবং সাব আর্টিকেল (৪) অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের (আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার) জন্য যদি কোনো আর্মস কনফ্লিক্ট হয়, সে আর্মস কনফ্লিক্ট তখন আর নন-ইন্টারন্যাশনাল থাকে না,  ইন্টারন্যাশনাল আর্মস কনফ্লিক্ট হিসেবেই ধরা হয়।
 
তুরিন বলেন, পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ যারা সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, স্বাধীনতা লাভ করেছে। এর আগে ষাটের দশকে কঙ্গোর কাঙ্গাত এবং নাইজেরিয়ার ভেতরে বায়াফ্রা এ ধরনের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেটি তারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। সে হিসেবে এটি হচ্ছে একটি ক্লাসিক কেস।
 
সহযোগী বাহিনী যুদ্ধাপরাধ করতে পারে কি-না প্রশ্ন করলে উত্তরে তুরিন বলেন, যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞায় বলা আছে, দু’টি পক্ষের হাতে অস্ত্র থাকলে এবং তাদের মধ্যে যদি বিরোধের সৃষ্টি হয় তাহলে আন্তর্জাতিক অস্ত্রবিরোধ হতে পারে। এটা গুরুত্বপূর্ণ না যে, তাদের যথাযথ কোনো কর্তৃপক্ষ হতে হবে।
 
একটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সশস্ত্র গ্রুপের বা গোষ্ঠীর যুদ্ধ হতে পারে। আবার একটি সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে আরেকটি সশস্ত্র গ্রুপেরও যুদ্ধ হতে পারে। সুতরাং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই কেবল যুদ্ধাপরাধ করেছে বিষয়টি কিন্তু সেরকম না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীগুলোও করেছে। কারণ, এই সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীপক্ষ। ফলে তারাও যুদ্ধারাধ করতে পারেন।
 
এ মামলায় ধর্ষণকে গণহত্যা হিসেবে প্রমাণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালের অন্যতম এ প্রসিকিউটর বলেন, এ মামলার আরেকটি নতুন দিক হলো, এতোদিন জেনোসাইড বলতে শুধুমাত্র গণহত্যাকে বুঝেছি। এখন পর্যন্ত সব মামলায় শুধুমাত্র হত্যা দিয়ে গণহত্যার কথা বলা হয়েছে। এ মামলাতেই প্রথমবারের মতো ধর্ষণকে গণহত্যা হিসেবে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। যেটি অন্যান্য দেশের ট্রাইব্যুনালগুলোতেও প্রমাণিত হয়েছে।
 
‘তাছাড়া এতোদিন শুধু বলা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী পরিচিতির কারণেও যে মূলত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তার দোসররা গণহত্যা চালিয়েছে, সেটিও এ মামলায় প্রমাণ করার চেষ্টা করবো’- বলেন তুরিন।
 
হত্যা, ধর্ষণ ছাড়াও কাউকে না মেরে শুধুমাত্র শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করেও জেনোসাইড (গণহত্যা) সংঘটিত করা যায় বলেও উল্লেখ করেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।
 
আগের মামলাগুলোতে কৌশলগত কারণে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তুরিন।
 
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হরি দেবনাথ গত বছরের ১৩ নভেম্বর থেকে গত ০৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস ২৫ দিনে মামলার তদন্ত শেষ করেন। গত ০৭ অক্টোবর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ ও পরে প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থা।
 
তদন্ত চলাকালে ৬০ জনের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। আর দুই আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন ৪০ জন সাক্ষী।
 
গত ০৭ জুলাই  রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হুসাইন (৬৪) ও তার সহযোগী মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানের (৬৬) বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল-২। এরপর নিকলি উপজেলার কামারহাটি গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে মোসলেমকে গ্রেফতার করা হলেও হুসাইন পলাতক।
 
এ মামলার প্রধান আসামি পলাতক সৈয়দ মো. হুসাইন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর ছোট ভাই।
 
হাসান আলীকে গত ০৯ জুন ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১। তার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিই প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ এ দণ্ড দেওয়া হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৫
এমএইচপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।