ময়মনসিংহ: ‘স্মৃতিসৌধের পবিত্রতা বজায় রাখুন। পোস্টার লাগানো নিষেধ।
স্মৃতিস্তম্ভের সীমানা প্রাচীরের চারদিক ঘেঁষেই যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট। অবৈধ এসব স্থাপনার ভিড়ে দিন দিন আড়াল হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভটি। দূর থেকে এ স্মৃতি ভাস্কর্যটি এখন ঠাহর করাই কঠিন। এতে একদিকে নষ্ট হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভের সৌন্দর্য। অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়েছে এর অস্তিত্ব।
বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সরেজমিনে নগরীর ব্যস্ততম পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ে গিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই লক্ষ্য করা যায়।
এমন পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তারা দ্রুত এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জোর দাবিও জানান।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আদর্শ ও মূল্যবোধ তুলে ধরতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ময়মনসিংহ জেলা ইউনিট কমান্ড ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাড়ে আট একর জমির ওপর ৫৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা ব্যয়ে এ স্মৃতি ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৯৯ সালের ৫ মে।
প্রকল্পের বাইরে নতুন করে সংযোজন হয় তোরণ, সংযোগ সড়ক, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, শিল্পকর্ম ও স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতা বর্ধন। ফলে এর নির্মাণ ব্যয় ৬৫ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে।
সরকার, স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও জেলা পরিষদ এটি নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করে। স্মৃতিস্তম্ভটির স্থপতি প্রখ্যাত শিল্পী রশিদ আহম্মেদ। নির্মাণকারী সংস্থা ঢাকা মেসার্স বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ।
চারদিক ঘুরে দেখা যায়, স্মৃতিস্তম্ভের কেন্দ্রে আছে একটি রাইফেল। রাইফেলের বেয়োনেটে ফুটন্ত শাপলা। এর মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রাপ্তিকে বুঝানো হয়েছে। উঁচু স্তম্ভটি মশাল আকৃতির।
স্মৃতিস্তম্ভটির চারটি দেয়ালে চার ধরনের প্রাচীর চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মহান ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিমূর্ত চিত্র।
স্মৃতিস্তম্ভের ত্রিকোণাকৃতি ৭১টি গ্যানেলে কয়েক হাজার বাদুড় বাসা বেঁধেছে। এসব পাখির ঝাঁক মলমূত্র ত্যাগ করে স্মৃতিস্তম্ভটি নোংরা করছে। চারপাশে সীমানা প্রাচীর রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এসব প্রাচীরের একদিকে লোহার কাঁটা কেটে হরদম ভেতরে প্রবেশ করছে মাদকসেবী ও স্থানীয়রা।
স্তম্ভের ভেতরের বাতিগুলোও হাওয়া হয়ে গেছে। ফলে এখানে রাতে থাকে ভুতুড়ে পরিবেশ। পবিত্রতা রক্ষা না করে অনেকেই জুতা বা স্যান্ডেল পায়ে স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে হেঁটে বেড়ান।
স্তম্ভের সামনেই ময়মনসিংহ জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নামের স্মৃতি ফলকের চেহারাও মলিন। সীমানা প্রাচীরের অবৈধ স্থাপনায় ঢেকে যাচ্ছে স্মৃতিফলক।
সীমানা প্রাচীরের চারপাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান, মনিহারীসহ অসংখ্য টং দোকান। এসব দোকানিরা দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্মৃতিস্তম্ভের উত্তর-পশ্চিম পাশে সারি সারি খাবারের হোটেল। এ হোটেল মালিকদের একজন আমির হোসেন (৪৫)। নিজেদের অবৈধ দোকান-পাটের কারণে এ স্মৃতিস্তম্ভের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে কি না এমন প্রশ্ন করতেই আমির হোসেন বললেন, ‘সৌন্দর্য নষ্ট হইতাছে ঠিকই। কিন্তু গরিব মানুষ কইরা খাইতাছি। কী আর করমু ভাই?’
আমিরের কথা শুনে এগিয়ে এলেন পাশের হোটেল ব্যবসায়ী মো. রুমান। তিনি বলেন, ‘দশ বছর যাবত ব্যবসা করতাছি। পৌরসভার কাছে লিজের আবেদন করছি। আমরা ব্যবসা না করলে এই লোহার গ্রিল মাদকসেবীরা কাইট্যা নিয়া যাইতো গা। ’
প্রবেশ গেটের এক পাশে দোকান বসিয়েছেন মো. মানিক। তার দোকান ঘরের চালের কারণে স্মৃতিস্তম্ভের গেটের এক পাশ ঢাকা পড়ে গেছে। এ নিয়ে মোটেও ভ্রুক্ষেপ নেই মানিকের। উল্টো বললেন, ‘১৬ ডিসেম্বর এলে দোকানের চাল সরিয়ে ফেলাই। কোনো সমস্যা হয় না। ’
শুধু কী তাই, নিদারুণ অযত্ন, অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট। এ বিষয়ে স্মৃতিস্তম্ভের তত্ত্বাবধায়ক হাফিজুর রহমানও জানান নিজের অসহায়ত্বের কথা। তিনি বলেন, ‘রাত বিরাতে মাদকসেবীরা আড্ডা দেয়। আর আমরা স্তম্ভের গ্যানেলে থাকা বাদুড় তাড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। ’
প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর সামনে রেখেই এ স্মৃতিস্তম্ভের সাজসজ্জ্বা ও ধোয়া-মোছার কাজ চলে। আশেপাশে করা হয় আলোকসজ্জ্বাও। সারা বছর স্মৃতিস্তম্ভের খোঁজ-খবর কেউ না নিলেও বিজয় দিবসে থাকে মানুষের ভিড়। - জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা নিতাই চন্দ্র (৪৫)।
স্মৃতিস্তম্ভের অযত্ন-অবহেলা আর চারপাশের অবৈধ স্থাপনার বিষয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রব বলেন, এই স্মৃতিস্তম্ভে সারাবছর কোনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। তাই রাতে মাদকসেবীরা এখানে আড্ডা জমায়।
স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে চারপাশে। এতে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতীক প্রতিনিয়ত অবমাননা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
টিআই