পার্বতীপুর (দিনাজপুর): দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই বাঙালি সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে স্থানীয় বীর ছাত্র-জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল সন্ধ্যায় পার্বতীপুর শহরের চতুরদিকে অবস্থান গ্রহণ করে।
২ এপ্রিল ভোরে শহরে রকেট লাঞ্চার নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে পাকহানাদার বাহিনী ও অবাঙালিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হয়।
১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনা এবং অবাঙালিরা শেষ রাতে সৈয়দপুরে পালিয়ে গেলে পার্বতীপুর শত্রু মুক্ত হয়।
১৫ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর জনতা শহরে প্রবেশ করে বড় বড় ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে বিজয়োল্লাস করেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত ট্রেনিংয়ের অপেক্ষায় না থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, যুবসমাজ সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ২৫০ জন সদস্য খোলাহাটির নুরুল হুদা হাইস্কুলে এসে অবস্থান নেয়।
১ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা লাঠি, দা, বল্লম, ছোরা নিয়ে শহরের চারপাশে অবস্থান নেয়। বৃত্তিপাড়ায় বসানো হয় রকেট লাঞ্চার।
২ এপ্রিল ভোর ৬টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে রকেট লাঞ্চার নিক্ষেপ করলে পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। এ ঘটনার পর হানাদার বাহিনী ও তাদের সহচর অবাঙালিরা হিংস্র হয়ে ওঠে।
৮ এপ্রিল সবচেয়ে বেশি গণহত্যার ঘটনা ঘটায় হানাদার বাহিনী। এদিন খোলাহাটিতে হানাদার বাহিনী নারী শিশুসহ শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনা, মিলিশয়া, অবাঙালি বাচ্চু খান, কামরুজ্জামান, জাকির খান ও স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বর্বর নির্যাতন-নিপীড়ন দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে লোকজনকে ধরে এনে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুটপাট শুরু করে।
৯ মে হাবড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম সরদার, মফিজ মণ্ডল, খলিল মণ্ডল, আবুল, কমরেড গোলাম মর্তুজার বাবা মেহের আলীসহ ৩৫ জনকে ধরে ভবানীপুর রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রেনে করে পার্বতীপুর নিয়ে এসে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে হাকিম চেয়ারম্যানকে কয়লায় চালিত রেল ইঞ্জিনের (বাষ্পীয় ইঞ্জিন) বয়লারে পৈশাচিকভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। জুন মাসের দ্বিতীয়ার্ধে হানাদার বাহিনী এ প্রতিবেদকের মেজভাই আমজাদ হোসেন শাহকে ধরে নিয়ে গিয়ে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে হত্যা করে।
খিয়ারপাড়া গ্রামের ১৪ জন যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে এবং চৈতাপাড়ার আব্দুস সামাদ, অছিউদ্দিন, কাছিমুল্লাহ, তার ছেলে, ছেলের স্ত্রী, ফারাজের স্ত্রী, রফউদ্দিন হাজীর স্ত্রী, খতিমের দাদী, বাজারপাড়ার মোস্তাহাজীসহ ১৯ জনকে জবাই করে। চৈতাপাড়ার মাঠিয়ালডাঙ্গা ও বুড়িরদোলা এলাকায় মরদেহগুলো পড়েছিল। হোসেনপুর গ্রামের আজিজার রহমান চৌধুরী, তার ভাই মতিয়ার রহমান চৌধুরী, দলাইকোটার শাহাবুদ্দিন, চাঁচেয়া গ্রামের ছহির উদ্দিনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এছাড়া, পার্বতীপুর দেশের বৃহত্তম রেল জংশন স্টেশন হওয়ায় বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত লোকজনকে ধরে ট্রেনে করে নিয়ে এসে পার্বতীপুর-দিনাজপুর রেলপথের টার্নিং পয়েন্টে রেল লাইন সংলগ্ন স্থানে হত্যা করে গণকবর দেয়।
আগস্টের শেষের দিকে পার্বতীপুরে গেরিলা হামলা তীব্ররূপ ধারণ করে। আনন্দবাজার, পাটিকাঘাট (গুড়গুড়ি) এলাকায় গেরিলা ক্যাম্প বসানো হয়। হাবড়া আমবাগান, সাঁকোয়ার ব্রিজ ও মনমথপুর রেল স্টেশনে বড় বড় যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে চৌহাটি, ঘুঘুমারি,আমডুংগির হাট, ভবানীপুর, হাবড়া, খোলাহাটি, বেলাইচন্ডি, হরিপুর, তাজনগর এলাকার পাকসেনা ও রাজাকার ক্যাম্পগুলো গুড়িয়ে দিলে অবাঙালিরা পার্বতীপুর ত্যাগ করতে শুরু করে।
মিত্র বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর পার্বতীপুরে বোম্বিং শুরু করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমাবর্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী-অবাঙালিরা শেষ রাতের মধ্যেই রেলপথ ও সড়ক পথে নীলফামারীর সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়।
পাক সেনাদের শেষ সামরিক গাড়িটি পালাবার পথে পার্বতীপুর-সৈয়দপুর সড়কের বান্নিঘাটে পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে উড়ে গেলে চালকসহ একজন কর্নেল, একজন মেজর ও একজন লেফটেন্যান্ট নিহত হয়।
১৫ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর জনতা পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করে রেলওয়ে থানা, শোয়েব ভবনসহ বড় বড় ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী শহরে ঢুকে কারফিউ জারি করে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
আরএ
** গাজীপুর হানাদার মুক্ত দিবস ১৫ ডিসেম্বর