চলনবিল থেকে ফিরে: ঐশ্বর্যময় জলরাশির পরিপূর্ণ ভাণ্ডার আমাদের এ মাতৃভূমি। এ জলপথকে ঘিরেই এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক সভ্যতার উন্বেষ ঘটেছিল প্রাচীন কালে।
প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দেশের জলসম্পদকে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে বিপন্ন করে তুলছেন কিছু স্বার্থবাদী মানুষ। সেসব মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে বিপন্ন দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিলের বিশাল জলরাশিও।
তারপরও অনেক সৃষ্টি ও ধ্বংসের সুখ দুঃখ নিয়ে আজও টিকে আছে সমৃদ্ধতম জলাভূমি খ্যাত চলনবিল।
ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয় তখনই চলনবিলের সৃষ্টি। করতোয়া ও আত্রাই নদীর পরিত্যক্ত গতিপথ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একটি ব্যাপক বিস্তৃত হ্রদে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি সম্ভবত একটি পশ্চাৎ জলাভূমি ছিল।
চলনবিলের গঠন ঐতিহাসিকভাবেই আত্রাই ও বড়াল নদীর সংকোচনের সঙ্গে সম্পর্কিত। চলনবিলের প্রধান সংযোগকারী প্রণালী ছিল আত্রাই নদী। যা বৃহত্তর রাজশাহী জেলার উত্তরাংশ ও দিনাজপুর এলাকার পানি নিষ্কাশন কাজে ব্যবহৃত হতো। আর বড়াল চলনবিল থেকে পানি নির্গমণের পথ হিসেবে কাজ করে এবং বিলের পানি বহন করে যমুনাতে ফেলে।
সরেজমিনে ঘুরে প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে চলনবিলকে আবাদিকরণের যোগ্য করে তুলতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
তাড়াশ উপজেলার বাসিন্দা প্রবীণ সাংবাদিক রুহুল আমীন বাংলানিউজকে জানান, ১৯৫৪ সালের দিকে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকার চলনবিলকে জাগিয়ে তুলতে খাল খনন প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চলনবিলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর সঙ্গে সংযোগ রেখে একাধিক খাল খনন করা হয়। সেসব খাল দিয়ে বিল ভর্তি পানি নদীতে নেমে যায়। এ খাল খনন কর্মসূচি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।
ফলে বাষট্টির আগ পর্যন্ত বর্ষা ও শুকনো- উভয় মৌসুমেই পানিতে টইটুম্বর থাকতো চলনবিল। তবে এরপর থেকে শুকনো মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে বিলটি।
অনেকগুলো ছোট ছোট বিলের সমষ্টি দেশের সর্ববৃহৎ এ বিলটি। যা বর্ষাকালে একাকার হয়ে প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়। বিলটি রাজশাহী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার অংশ বিশেষ এলাকাজুড়ে অবস্থান করছে। বিলটি দক্ষিণ-পূর্বে পাবনার নুননগরের কাছে অষ্টমনীষা, উত্তর সীমানা সিংড়ার পূর্ব থেকে ভাদাই নদী পর্যন্ত বিস্তৃত।
সব মিলিয়ে তাড়াশ, আত্রাই, সিংড়া, উল্লাপাড়া, গুরুদাসপুর, চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুরা ও শাহজাদপুর উপজেলার অংশবিশেষ জুড়ে বিলটির অবস্থান।
তবে মনুষ্যসৃষ্ট নানামুখী সমস্যার কারণে বিলটি তার অতীত যৌবন হারাতে বসেছে। বর্তমানে বিলটি দ্রুত ভরাট হয়ে আসছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দেড়শ’ বছরে চলনবিল তার অবস্থান থেকে অন্তত ১৯ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দক্ষিণে সরে গেছে। প্রতি বছর গঙ্গা থেকে পলি এসে পড়ায় এমনটি হয়েছে।
চলনবিলের পানি নিষ্কাশন প্রণালী এবং পলি পড়ার বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য ১৯০৯ সালে গণপূর্ত বিভাগ থেকে একটি জরিপ কাজ চালানো হয়। সেই জরিপ কাজের ফলাফলে বলা হয়, চলনবিল তার আগের আয়তন থেকে ১০৮৫ বর্গকিলোমিটার সংকুচিত হয়ে ৩৬৮ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।
শুকনো মৌসুমে চলনবিলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ১৯১০ সালে আরো একটি অনুসন্ধান চালানো হয়। একইভাবে ১৯১৩ সালে আবারো অনুসন্ধান চালিয়ে পর্যবেক্ষণকারী একটি দল দেখতে পায়, তৎকালীন সময়ে পুরো বছরজুড়ে বিলটির মাত্র ৩১-৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পানি ছিল। এছাড়া বিভিন্ন পুনরুদ্ধার কর্মসূচির জন্য ১৯৫০ সালে বিলের আয়তন আরো কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৫ দশমিক ৯ বর্গকিলোমিটারে।
সর্বশেষ ১৯৮৭ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, শুকনো মৌসুমে মানুষের তৈরি কিছু কিছু ছোট পুকুর ছাড়া চলনবিলের কোথাও পানি থাকে না। ফলে এ সময় থেকেই চলনবিল শুকনো মৌসুমে একটি জলশূন্য নিচু এলাকায় পরিণত হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় চলনবিলে জেগে ওঠা জমিতে রকমারি ফসল চাষ আর বিলের বিভিন্ন পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে একাধিক গ্রাম। সেখানে শুষ্ক মৌসুমে চলে বোরো ও উচ্চ ফলনশীল ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ। একইভাবে বর্ষায় সেখানে গভীর পানির বোনা আমনের চাষ করা হয়ে থাকে।
উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছের চাহিদা পূরণে চলনবিল এক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে প্রাকৃতিক এই মৎস্যভাণ্ডারের জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বিলটি থেকে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ প্রায় হারিয়ে গেছে। যেগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ কোনো উদ্যোগে নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
এমবিএইচ/এএসআর