কুমিল্লা: দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে বাঙালি পেয়েছে স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা অর্জনে প্রাণ দিতে হয়েছে ৩০ লাখ বাঙালিকে, সম্ভ্রম হানি হয়েছে হাজার হাজার মায়েদের।
বধ্যভূমি গুলোতে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে লাখ লাখ বাঙালিকে। এসব শহীদদের পরিচয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবার অজানা। এসব বধ্যভূমিগুলো পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-হত্যাযজ্ঞের জ্বলন্ত সাক্ষী।
কুমিল্লা জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি। এসব বধ্যভূমির সঠিক সংখ্যা জানা নেই কারোরই। কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডও দিতে পারেনি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য।
কুমিল্লা জেলাজুড়ে রয়েছে কমপক্ষে ৫০টি বধ্যভূমি। এদের অনেকটিরই চিহ্ন নেই। বধ্যভূমিগুলোতে সমাহিত শহীদদের সংখ্যাও কারো জানা নেই। যথাযথ সংস্কার ও পরিচর্যার অভাবে বধ্যভূমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের সিংহভাগই জানে না এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও ভয়ানক স্মৃতির কথা।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল প্রায় ৩০টির মত বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে ফলক উন্মোচন করেছেন।
বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য কুমিল্লার কয়েকটি বধ্যভূমির ইতিহাস তুলে ধরা হল।
বেলতলী বধ্যভূমি
লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি। ৭১’র যুদ্ধকালীন সময়ে কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে দক্ষিণে বেলতলীর এ বধ্যভূমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার পর মরদেহ মাটিচাপা দিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকার সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ঘাঁটি করে। এ ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করে এর ৫শ গজ দূরে বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটিচাপা দিত পাক হানাদার বাহিনী।
পাক সেনাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের নিরব সাক্ষী লাকসাম রেলওয়ে জংশন কলোনীর শ্রীধাম চন্দ্র দাশ, তার মামা সুরেন্দ্র দাস ও উপেন্দ্র দাস বাংলানিউজকে জানান, পাক বাহিনী ওইসময় সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে নারী-পুরুষের হাজার হাজার মরদেহ নিয়ে বধ্যভূমিতে গর্ত করে মাটিচাপা দিয়েছে।
দেবিদ্বার বধ্যভূমি
কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাক বাংলোর সামনে অবস্থিত বধ্যভূমিটি পাক হায়ানাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই পাক হায়ানারা মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামে এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৪২জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়। এরপর ২৩ জন নিরীহ বাঙালিকে এ বধ্যভূমিতে ধরে আনে হানাদার বাহিনী। পথিমধ্যে ৩ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাকী ২০জনকে দিয়ে উপজেলা সদরের ডাকবাংলোর পাশে গর্ত খুঁড়ে। পরে তাদের চোখ বেঁধে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এসব নিরীহ লোকদের। ভাগ্যক্রমে একজন বেঁচে গেলেও বাকি ১৯ জনকে ওই গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল।
নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি
মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত জানা-অজানা শহীদদের পবিত্র রক্তে সিক্ত কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমি। এ বধ্যভূমিতে নোয়াখালী, নাঙ্গলকোট ও আশেপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করে তিনটি কবরে গণসমাহিত করে পাক হানাদার বাহিনী।
ওই এলাকার নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, সংগ্রামের সময় আমি ৭ দিনের জন্য ভারতের কাঁঠালিয়া এলাকায় প্রশিক্ষণের জন্য যাই। আমার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ভাদ্র মাসের ১৫/১৬ তারিখে বাড়িতে আসি। খবর পেয়ে পাক হানাদার বাহিনীরা ওই রাত ২টার দিকে আমার বাড়ি ঘেরাও করে ভোরবেলায় আমাকে এ বধ্যভূমিতে এনে একটি বটগাছের সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতন চালায়।
একদিন পর তারা নোয়াখালী থেকে আরো ২ জনকে এখানে ধরে নিয়ে আসে। তখন আমি দেখি মিলেটারিরা ৩টি কবর খুঁড়ছে। ওই দিন রাতেই নোয়াখালী থেকে নিয়ে আসা ২ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর আমাকে কবরের সামনে নেওয়ার সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি আমার মৃত্যু হয়নি। লাকসাম থেকে একজন মিলিটারি এসে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তখন তারা আমাকে ছেড়ে দেন। এ বধ্যভূমিতে কতজনের মরদেহ সমাহিত হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।
রামমালা বধ্যভূমি
নগরীর রামমালা এলাকায় অবস্থিত সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতরে পুকুর পাড়ে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাক হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ করে, তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরপরই পাক হানাদার বাহিনী ওই ইনস্টিটিউটটির চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে। তখন এর ভেতরে আনসার ক্যাম্প ছিল। তখন পাকবাহিনী ব্রাশফায়ার করে গণহারে সাধারণ মানুষ, আনসারদের হত্যা করে গর্ত করে গণকবর রচনা করে যায়। নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, শাহজাহান, বিল্লাল হোসেন ও রাজা মিয়া।
ওই সময়ের কালসাক্ষী স্থানীয় বাসিন্দা আলম মিয়া জানান, ওই ভোরে মানুষের আর্তনাদ-বুলেটের শব্দে সার্ভে ইনস্টিটিউট কেপে উঠেছিল। ঘটনার ১০/১২ দিন পর আনসার ক্যাম্পের ভবনের নিচতলার সিঁড়ির নিচে ৭/৮টি কংকাল পাওয়া যায়। বর্তমানে এ ভবনটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ১৯৯৪ সালে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল এ বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক স্থাপন করেন।
স্থানীয় সূত্র মতে, এই বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫শ লোকের সমাধি। তবে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল জানান, কমপক্ষে তিনশ মানুষের কবর রয়েছে এখানে। এদের মধ্যে আনসার, সাধারণ মানুষও রয়েছে। বছর জুড়ে এ বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভটি ময়লা-আর্বজনার স্তপে পরিপূর্ণ থাকলেও বিজয় দিবস এলে এটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রং করা হয়।
চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা
১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা এলাকায় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন যোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন।
বেতিয়ারায় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নিহতরা হলেন- ছাত্রনেতা নিজাম উদ্দিন আজাদ, সিরাজুল মনির, জহিরুল হক দুদু, মোহাম্মদ সফি উল্যাহ, আওলাদ হেসেন, আবদুল কাইউম, বশিরুল ইসলাম, শহীদ উল্ল্যাহ ও কাদের মিয়া। বেতিয়ারার শহীদদের কবরটি এখন পূর্বের স্থানে নেই। মহাসড়কের চার লেনের কাজ হওয়ায় বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা বধ্যভূমির ইতিহাস
কুমিল্লার নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীর কাছে জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও ভয়ানক স্মৃতির কথা অজানা রয়ে গেছে। কুমিল্লা সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতরে অবস্থিত রামমালা বধ্যভূমি ও আনসার ক্যাম্পে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বিষয়ে জানে না ওই জায়গার যুব সমাজ।
ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বিএসএসের শিক্ষার্থী সাইফ উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, আমরা এ পুকুর পাড়ে প্রায় আড্ডা দেই। একটি কবরের মত দেখি। এ বধ্যভূমির ইতিহাস আমাদের অজানা। কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও জেলা প্রশাসনের উচিত প্রত্যেকটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে এর ইতিহাস ফলকে লিখে দেওয়া। এতে করে আমরা যারা নতুন প্রজন্ম, তারা এর ইতিহাস জানতে পারবে।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল বাংলানিউজকে জানান, প্রায় ৩০টির মত বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে ফলক উন্মোচন করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি বধ্যভূমির ইতিহাস টিকিয়ে রাখার জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
এসএইচ