ঢাকা, সোমবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

জন্মই যেনো তার আজন্ম পাপ!

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৬
জন্মই যেনো তার আজন্ম পাপ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিলেট: বাকশক্তি নেই, ডাক দিলে চেতনা ফিরে শিশু ফরহাদ। বিছানা থেকে উঠে বসার সক্ষমতাও নেই।

আর দশটি শিশুর মতো খেলার ইচ্ছে থাকলেও ফরহাদের নিয়তি বড়ই নির্মম। প্রতিবন্ধি তাই বাবা-মা তাকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে গেছেন। মা বাবার কথা বললেই ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে পাঁচ বছর বয়সের ফরহাদ।

শিশুটির এমন অসহায়ত্ব দেখে আবেগ সামলে রাখতে পারেননি হাসপাতালের অন্যান্য রোগীর স্বজনরাও।   ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২১ শিশু ওয়ার্ডের ৩৬ নম্বর এক্সট্রা শয্যায় চিকিৎসাধীন ফরহাদ। একমাস ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত চিকিৎসাধীন শিশুটিকে দেখতে আসেননি তার মা-বাবা বা স্বজনদের কেউ।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভর্তির কাগজপত্রও নিয়ে গেছে তারা। যারা ভর্তি করেছিলো তারা শিশু ফরহাদের সম্পর্কে কি হন বিষয়টিও অষ্পষ্ট। তার দেখাশোনা করছেন সিলেট ওসমানী হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন কর্মী মন্তাজ আলী। তিনি তার সম্পূর্ণ দেখাশুনা করেন। খাইয়ে দেন, কুলে তুলে নিয়ে প্রশ্রাব-পায়খানা করান।

মন্তাজ আলী বাংলানিউজকে বলেন, হতভাগা শিশুটি আমার পরিবারেও তো জন্ম নিতে পারতো। ভর্তির পর ফরহাদের গায়ে জামা ছিলোনা। ১৮০ টাকা দিয়ে তারজন্য জামা কিনে দিয়েছি। মুখে ঘা থাকায় প্রতিদিন জাউ বানিয়ে খাওয়ানো হয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছেন, ভর্তির সময় সম্ভবত ফরহাদের মা ও বাবা এসেছিলো। ছেলেটি প্রতিবন্ধি হওয়ায় ‘আপদ’ ভেবে ভর্তি করে পালিয়ে গেছেন তারা।

তবে কেউ বলছেন, এতোদিন ফরহাদকে হয়তো ভিক্ষাভিত্তি পেশায় নিয়োজিত রাখা হয়েছিলো। নিউমোনিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করে পেশাদার ভিক্ষুকের দালালরা পালিয়েছে। তাদের মতে, সন্তান প্রতিবন্ধী বা যাই হোক কোনো মা বাবার পক্ষে এভাবে ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়।

হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতার তথ্য অনুযায়ী ফরহাদের বয়স পাঁচ বছর। বাবার নাম গিয়াস উদ্দিন। গ্রামের নাম ডলি, উপজেলা বানিয়াচং, জেলা হবিগঞ্জ। ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। ওইদিন থেকে অভিভাবকহীন অবস্থায় তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, বলেও জানান ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স ফৌজিয়া খানম।

হাসপাতালের ২১ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ ডা. শাহরীন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ফরহাদ ‘সেরিব্রাল পলসি’ ও নিউমোনিয়ায় রোগে আক্রান্ত। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে কাশি-কফের সমস্যা। মুখে ঘা থাকায় খেতে পারেছে না শিশুটি। তবে জ্বর অনেকটা কমে গেছে, মোটামুটি সুস্থ। শয্যাশায়ী থাকাবস্থায় একমাসে ফরহাদের শরীরের ওজন প্রায় ৫ কেজি বেড়ে গেছে।

ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রভাত রঞ্চন দে বলেন, শিশুটি ‘সেরিব্রাল পলসি’র রোগে আক্রান্ত। প্রি-মেচুইড অবস্থায় জন্ম কিংবা জন্মগত সমস্যার কারণে তার ব্রেনের একটি অংশ নষ্ট। সেই সঙ্গে নিউমুনিয়া আক্রান্ত হয়ে তার হাত-পা বেকে গেছে। বাক শক্তিও নেই। চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় শিশুটি অনেক ভালো হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ দিন হাসপাতালে থাকায় অন্যান্য রোগাক্রান্ত হচ্ছে। তবে তার চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন।

হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে বলেন, অধৈর্য্য হয়ে জন্মদাতারা পালিয়ে গেলেও চিকিৎসক হিসেবে আমরা শিশুটিকে ফেলতে পারিনা। তার অভিভাবকদের সন্ধানে কোতোয়ালি থানার মাধ্যমে বানিয়াচং থানার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু খোঁজ মিলেনি। সিলেট সমাজসেবা অধিদফতরও প্রতিবন্ধি বাচ্চাদের নেয় না। তাই হাসপাতালের বিছানাই এখন তার ঠিকানা।

তবে ভিক্ষাভিত্তি করানোর জন্য দালালচক্র যাতে শিশুটিকে চুরি করে না পারে। সেদিকেও সতর্ক রয়েছেন বলে জানান হাসপাতালের এ কর্মকর্তা।

যোগাযোগ করা হলে বানিয়াচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অমুল্য কুমার চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, চিঠি পাওয়ার পর ওই ঠিকানায় শিশুটির বাবা-মায়ের সন্ধান করেও পাইনি।

সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের (১১ নম্বর মকরমপুর ইউপি) চেয়ারম্যান আহাদ মিয়া ও ওই গ্রামের ৫নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মতি মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ডলিয়া গ্রামে এ নামে কোনো মানুষ নেই। হয়তো ঠিকানা ভুল দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৬
এনইউ/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।