ঢাকা: জিগাতলা থেকে মিরপুরের দিকে ছুটছে ‘স্টার লিংক’ লেগুনা। মোহাম্মাদপুরের শিয়া মসজিদ পার হয়ে লিংক রোড।
'পরের বার, পরের বার’ করে চিৎকার দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকেন চালক হাসান মাসুদ। কিন্তু পিছন থেকে গালিগালাজ দিতে দিতে লেগুনায় বাড়ি দেন শাহিন। লেগুনা থামাতে বাধ্য হন মাসুদ। লাইনম্যান শাহিন সামনে এসে বলেন বলেন, ‘খাঁড়া, কোনো মাফ নেই’।
কিছু সময়ের জন্য তাদের মধ্যে চলতে থাকে তর্ক। লেগুনার ভেতর থেকে যাত্রীদের তাড়া। পরে কিছু টাকা শাহিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকেন মাসুদ। পেছন থেকে লাইনম্যান শাহিনের হুমকি- পরেবার সম্পূর্ণটা না দিলে আর চলতে পারবি না।
ঝিগাতলা থেকে মিরপুর রুটে চলাচলকারী লেগুনায় এভাবে লাইনম্যানের মাধ্যমে চালকদের কাছ থেকে জোর জবরদস্তি ও হুমকি ধামকি দিয়ে প্রতিদিনই তোলা হচ্ছে চাঁদা।
বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) সরজমিনে এমন চিত্রের দেখা মেলে।
দেখা যায়, লাইনম্যানদের এমন জোর জবরদস্তিতে অভ্যস্ত চালক থেকে মালিক। কেউ করছেন না এর প্রতিবাদ। এতে একে তো সময় নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
কারণ লাইনম্যানদেরকে দেওয়া বাড়তি অর্থ যোগ হচ্ছে যাত্রীদের দেওয়া ভাড়া থেকে।
চালক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন জানা যায়, এই রুটে চলাচলকারী লেগুনাগুলোকে প্রতিদিন ৮০০ টাকা করে লাইনম্যানকে দিতে হয়। আর লাইনম্যানদের তোলা এ টাকাগুলো চলে যায়, স্থানীয় থানা-পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে। এর কিছু অংশ লাইনম্যানরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন-বলে জানান তারা।
তারা আরও জানান, ঝিগাতলা থেকে মিরপুর রুটে চার স্থানে লাইনম্যানদের টাকা দিতে হয়। এগুলো হলো: ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, শিয়া মসজিদ, শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড ও মিরপুর এক নম্বর। এর মধ্যে মিরপুর ১৪০ টাকা, শ্যামলীতে ৩৪০ টাকা, শিয়া মসজিদে ১০০ টাকা, জিগাতলায় ১৭০ টাকা। সব মিলিয়ে সারাদিনে প্রায় ৮০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
জানা যায়, এই রুটে প্রতিদিন স্টার লিংকের ৮০টি, একিউটের ৭০টি লেগুনা চলাচল করে। একবার চাঁদাবাজি বন্ধ করতে ধর্মঘাট পালন করেও কোনো লাভ হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসা এই চাঁদাবাজি কোনো ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন চালক ও মালিক জানান, এই চাঁদাবাজির সঙ্গে বেশ কিছু ‘মাথা’ জড়িত। তাদের মধ্যে আনসার ও সাধারণ জনগণের জনসেবায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরাও রয়েছেন। প্রতিদিন এ চাঁদা তুলে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিবাদ করলে গাড়ি আটকে দেয়।
তাদের এই অভিযোগের সত্যতা মেলে ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে।
সেখানে দেখা যায়, তনু নামে এক চালককে লেগুনাসহ দাঁড় করিয়ে কাগজ দেখতে চান দায়িত্বরত পুলিশের সার্জেন্ট। কাগজে সমস্যা আছে বলে জানান তিনি।
উত্তরে তনু তার লেগুনার হেলপারকে বলে, 'লাইনম্যান রনিকে ফোন লাগাও’। হেলপার মোবাইলে কথা বলার কিছু সময় পর সার্জেন্টের মোবাইলে ফোন আসে। এরপর সার্জেন্ট লেগুনা ও তনুকে ছেড়ে দিয়ে চলে যান।
হাসান নামে অপর একজন লেগুনার চালক বাংলানিউজকে বলেন, এ রুটে চলাচলকারী অনেক গাড়ির কাগজ পাতির ঠিক নাই। পুলিশ আটকালে লাইনম্যানরা ম্যানেজ করে। এলাকার রাজনৈতিক নেতাদেরও তারা ম্যানেজ করে। তবে পুলিশ, নেতারা নিজে কোনো চাঁদা নেয় না,লাইনম্যানরা টাকা তুলে ভাগ করে তাদেরকে দেয়।
‘এছাড়া এমনি সময়ে নানা অজুহাতে ট্রাফিক পুলিশেরাও ৫০-১০০ টাকা করে নিয়ে থাকে। ’, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সারাদিনে একটা গাড়ি ৫/৬ টিপ দিতে পারে। এসব টিপে যত টাকা ওঠে এগুলোর মধ্যে চাঁদার টাকার পাশাপাশি তেল খরচ ও হেলপারের বেতন আছে। সব শেষে যা থাকে তাতে চালকদের পকেটে খুব কম টাকা ঢোকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মালিক জানান, আমার মনে হয়, রোডে অন্য ট্রান্সপোর্টের থেকে লেগুনা সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজির শিকার হয়। লাইনম্যানরা টাকা ইনকাম হোক আর না হোক তাদের দিতেই হবে। নাহলে থানায় ওই গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, স্থানীয় নেতাদের তোপের মুখে পড়তে হয়। এ কারণে আমরা ম্যানেজ করে চলি।
এদিকে ওই লাইনম্যান শাহিনের দাবি, তিনি মালিকের হয়ে টাকা উঠাচ্ছেন। কোনো চাঁদাবাজি করছেন না তিনি।
লাইনম্যানের বিষয়ে মিরপুর লেগুনা সমিতির সভাপতি শাহরিয়ার হোসেনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
তিনি বলেন, যারা ছোট খাটো ইনকাম করে তাদের পেছনে আপনারা লাগতে গেছেন কেনো। আপনারা তো বড়দের পেছনে লাগতে পারেন না। আপনারা তো পারেন না বাস চালকদের পেছনে লাগতে।
চাঁদার অর্থের বিষয়ে তিনি অনেকটা হুকমির গলায় বলেন, আপনি সামনে আইসেন। সামনা-সামনি কথা হবে আপনার সঙ্গে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৬ ঘন্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৬
এমসি/আরএইচএস