ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

মনোনয়ন বঞ্চনার পর এ কোন চেহারা হাসিনা দৌলার!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৬
মনোনয়ন বঞ্চনার পর এ কোন চেহারা হাসিনা দৌলার!

ম্যাকাও পাখিটার কণ্ঠেও আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সেই জায়গাটা আজ কাকের দখলে। বেশ কর্কশ স্বরের কাক ডেকে যাচ্ছে কা কা। কুসংস্কারের বশেই কাকের ডাকের সাথে "কুসময়ের" হিসেবটাই যেন মেলাতে বসেছে প্রকৃতি।

ঢাকা: ম্যাকাও পাখিটার কণ্ঠেও আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সেই জায়গাটা আজ কাকের দখলে।

বেশ কর্কশ স্বরের কাক ডেকে যাচ্ছে কা কা।

কুসংস্কারের বশেই কাকের ডাকের সাথে "কুসময়ের" হিসেবটাই যেন মেলাতে বসেছে প্রকৃতি।

দুর্লভ অর্কিডে মোড়ানো মাটির ঘর। তার ভেতরেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ আধুনিকতার জৌলুস।

দাওয়ায় বসে হাতে গোনা কর্মী। সাকুল্যে চার। তিনিই মধ্যমনি। এর মাঝেই প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বেজে ওঠছে আইফোন প্লাসের টিউন।
একের পর এক ফোন। কোন কলারই বাদ গেলেন না। কারো প্রশ্ন। কারো হতাশা। কারো বা আক্ষেপ। জবাবে সবাই উত্তরটাও পেলেন একই রকম।

"না আমি নমিনেশন পাইনি। দেয়নি আমাকে। না না কষ্টের কি আছে। আরো ভালো হয়েছে। মৃত্যুশয্যায় থাকা মেয়েটাকে এখন সময় দিতে পারবো"।
সব ফোন যে সমবেদনার। তাও নয়। অন্তত সাভারের রাজনীতির চিত্রটা তা সমর্থন করে না। অনেক ফোন যেন হাসিনা দৌলার বুকে বিদ্ধ করার তীর। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতোন।

তবে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা সত্ত্বেও অনেকটা আবেগ ভরা কণ্ঠে কলারদের উদ্বেগ আর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন ঢাকা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হাসিনা দৌলা।

যিনি সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দুই মেয়াদে টানা ১৪ বছর এ দায়িত্বে। ৫ বছর ধরে ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক। অনির্বাচিত। এবারও মনোনয়ন দৌড়ে ছিলেন সর্বাগ্রে। ছিটকে পড়েছেন।

৫ বছর আগের কথা, যখন এ পদে এলেন। পেলেন গাড়ি। সঙ্গে চালক। সম্মানী। ক্ষমতা। সরকারি সুযোগ সুবিধা। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন। দল মূল্যায়ন করেছে। জেলা প্রশাসক পদবী দিয়েছে।

এবার তো জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নই পেলেন না। এই না পাওয়াকে দলের "অবমূল্যায়ন" মনে করছেন কি না? আর সেটা না পাবার বিষয়ে নিজস্ব উপলব্ধি কি? এ সব জানতেই হাসিনা দৌলার মুখোমুখি হয় বাংলানিউজ।

প্রথমের তীব্র অস্বস্তি। হাতের কাছে পানের বাটি। সেখান থেকে একের পর এক পান মুখে পুরছেন। চিবুচ্ছেন। পান নয়। যেন কষ্টকে চিবিয়ে আড়ালে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা। অসংলগ্ন কণ্ঠে অসহ্য রুক্ষতা। কুঁচকে গেছে কপাল। নিদ্রাহীন দুটো চোখ।

বললেন, নমিনেশন দেয়নি। ভালোই হয়েছে। মেয়েকে সময় দিতে পারবো। মেয়েটা আমার ক্যান্সারে মৃত্যুশয্যায়। ফোর্থ স্টেজ। আবার ধরা গলায় আক্ষেপ জড়ানো কণ্ঠেও বলছেন, সাভারবাসী বুঝলো না। তারা কি হারালো। ভাবছি, সাভারটা ছেড়েই চলে যাবো। কিছুটা দিন মেয়ের শয্যাপাশে থাকবো। রাজনীতি তো অনেক দেখলাম।

শান্ত কথাতেও আবার গর্জে উঠছেন। মেজাজকে সপ্তমে চড়াচ্ছেন। খেই হারাচ্ছেন। সামান্য ভুলভ্রান্তিতে চাকর বাকর বা দারোয়ানদের গালমন্দ করছেন। কাউকে বাপ মা তুলে গালাগাল দিতেও কসুর করছেন না।

তবে অনেকে আবার গালি খেয়েও হাসছেন মুখটিপে। বলছেন, সাম্রাজ্য হারানোর শোক!

কর্মীদের কেউ যখন সান্ত্বনার সুরে বলছেন, নিশ্চয় নেত্রী বড় কোন জায়গায় আপনাকে ভাবছেন। জায়গাটি কোথায়? সেটা বলতে বা ধারণাও করতে পারছেন না কেউ।

পানের বাটি থেকে কিছুটা সুপারি তুলে নিয়ে দাঁতে দাঁতে পিষে উত্তরটা দিলেন, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যেই করেন।

"নমিনেশন পেলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। আমি কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম। আমিই নমিনেশন পাচ্ছি। ডিক্লেয়ার করার মাত্র আধাঘণ্টা আগে জানতে পারলাম। তালিকা থেকে আমার নাম বাদ। ’

সব কিছুর নেপথ্যে দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টাকে।

নমিনেশন না পেয়েই কি তবে অদ্ভুত অস্থিরতা?

"না তা হবে কেন! কোন অস্থিরতা নেই। নমিনেশন না পেয়ে বরং শান্তি পাচ্ছি। তবে হ্যাঁ। কাল বাদ পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চরম অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম। এখন সেটা নেই। " জানান হাসিনা দৌলা।

মূলত সেই ঘোষণার পরই ওলটপালট হয়ে যায় হাসিনা দৌলার ফের জেলা পরিষদের শীর্ষ পদে ফেরার স্বপ্ন। চেনা মানুষগুলোকে ঠেকে অচেনা। জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বির্তক ছাড়েনি হাসিনা দৌলার।

বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্পের নামে ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জেলা পরিষদের প্রশাসক হাসিনা দৌলাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ দিয়ে দপ্তরে তলব করে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। তবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুদকের মুখোমুখি হননি হাসিনা দৌলা। এই অভিযোগ খোদ তার দলের একাধিক নেতার।

তার আগেই খবরের কাগজ আর টেলিভিশনে শিরোনাম হয়ে আসা ঢাকা জেলা পরিষদ দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যের খবরে বিব্রত হয় আওয়ামী লীগ।
মূলত তখন থেকেই রাজনীতির অন্দর বাইরে চাউর হতে থাকে। হাসিনা দৌলা আর জেলা পরিষদে ফিরছেন না। ঢাকা জেলা পরিষদের শীর্ষস্থান থেকে ছিটকে পড়ার বিষয়ে ভাগ্য নির্ধারিত হয় তার।

হাসিনা দৌলার ভাগ্য বিড়ম্বনা থেকে কি শিখবে আওয়ামী লীগ?

উত্তরে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার বাংলানিউজকে জানান, তিনি যে মর্যাদা পেয়েছিলেন। অযোগ্যতার কারণে তা ধরে রাখতে পারেন নি। নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেননি। যে কারণে আমরা সমর্থন দিয়েছি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানকে। যিনি মুক্তিযোদ্ধা। দলের ত্যাগী নেতা।

ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ফিরোজ কবির বাংলানিউজকে জানান, হাসিনা দৌলার অবস্থা হয়েছে ‘জয়কালে ক্ষয় নাই। মরণকালে ওষুধ নাই’ পরিস্থিতির।

তিনি যাদের নিয়ে চলতেন। আড়ালে তারাও বিরোধিতা করেছেন। আর শুনেছি নেত্রীর কাছে তার সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্টও ছিলো নেতিবাচক।
হাসিনা দৌলার সরকারি গাড়িটি যেমন অলস পড়ে ছিলো গ্যারেজে। চালক মিজানুর রহমান মাছি মারছিলেন। নতুন মর্যাদায় পরের আরোহীকে নিয়ে কি ভাবছেন?

"আমি সরকারি চালক। উনারা আজ আছে। কাল নেই। আমি থাকবো। নতুন যে আসবে। তাকে বরণ করে নেবো। এটাই তো আমাদের জীবন। "
সোটা সাপ্টা জবাব মিজানুর রহমানের।

হাসিনা দৌলার বাসভবনে প্রবেশ করতেই একটি নয়। পিতলের পিঠে খোদাই করা দুটি নাম ফলক।

"অল্প ক'দিনের মাথায় সরকারি গাড়ির সাথে সাথে নাম ফলক দুটোও সরে যাবে। তবে শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা হারানো হাসিনা দৌলারা কি কখনো বুঝতে পারবেন নেতাকর্মী বা জনতার মুখের ভাষা। নাকি হঠাৎ শূন্যতার সুযোগে সব পেয়ে তা হারিয়ে উন্মত্ততার গ্রাসে বিলীন হবেন?

ক্ষমতা এমনই অন্ধ। থাকতে কেউ বোঝে না। আবার হারালে জনসমর্থন হারানোর কারণও বিবেচনায় নিতে চায়না। শুধরাতে চায় না ভুলক্রুটিগুলো। উল্টো খোঁজে বিচিত্র সব সান্ত্বনা। এটাই রাজনীতি আর তার অদ্ভুত খেলা। "

হাসিনা দৌলাকে সান্ত্বনা দেয়ার ছলে দেখা করে ফেরার পথে বিড়বিড় করে এই কথাই বলছিলেন এক নেতা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৬
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ