বাঙ্কারে পাক সেনাদের উপর্যুপরি নিপীড়ন আর নির্যাতনে যখন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে যান, তখনই বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি জাগে তার মনে। বাঁচার আশায়, মুক্তি পাবার আশায় অভিনব এক ফন্দি আঁটেন কাকন বিবি।
জেরার এক পর্যায়ে টেংরাটিলা ক্যাম্পের এক পাকিস্তানি অফিসার ‘সত্য তথ্য দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে’ বলে তাকে কথা দেয়। এ সুযোগে কাকন বিবি তাকে বলেন, ‘স্যার আমি মুক্তিবাহিনীর লোক না, আমি খাসিয়া জাত। আমি আইছি (এসেছি) আমার স্বামীর তালাশ করতে। আমার স্বামীরে খুঁইজা পাই না। তার নাম আব্দুল মজিদ। সে ইপিআর সদস্য। সিলেট সীমান্তে নিয়োজিত ছিল। ’
কাকন বিবির এই ঘটনার বয়ান দিচ্ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারিশ আলী।
পাশ থেকে কাকন বিবি ও আব্দুল মজিদের ধাঁধাটি ভাঙেন মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভারতের মেঘালয়ে জন্ম কাকন বিবির। তবে বাবা-মা খুব ছোট বেলাতেই মারা গেলে তার ঠিকানা হয় বোন-জামাইয়ের বাড়ি সুনামগঞ্জে।
ভারতের মেঘালয় সিলেট সীমান্তের খুব কাছাকাছি হওয়ায় জন্মভূমির সঙ্গে নিয়মিত যাতায়াত ছিল কাকন বিবির। সে সময়েই তিনি প্রেমে পড়েন পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী আব্দুল মজিদ খানের। এরপর বিয়ে। তবে আব্দুল মজিদ সিলেট থেকে বদলি হয়ে গেলে ধীরে ধীরে সম্পর্কও শিথিল হয়ে যায়।
কথায় কথায় মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারিশ আলী বলতে বলেন, কাকন বিবি আব্দুল মজিদের পরিচয় দিলে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা তাকে খুঁজে পান। এসময় আব্দুল মজিদ কাকন বিবিকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেন। তখন তার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ আসে। পাকিস্তানি অফিসারটি তখন তাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার শর্তে তাকে মুক্তি দেন। সঙ্গে পাকিস্তানি সেনার স্ত্রী হিসেবে লিখে দেন একটি চিরকুট। সেইসাথে এ-ও বলে দেন, মুক্তিবাহিনীর কাছে ধরা পড়লে চিরকুটটি গিলে ফেলতে। প্রাণে বাঁচার জন্য ও দেশের স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে আবার গুপ্তচরের কাজ করার জন্য সব শর্তই মেনে নেন কাকন বিবি।
মুক্তিযোদ্ধা ইল্লাছ আলী বলেন, পাকিস্তানিদের কাছ থেকে পাওয়া চিরকুটের সুবাদে শত্রুক্যাম্পে (পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে) যাতায়াত করা সহজ হয়ে যায় কাঁকন বিবির জন্য। তথ্য লাভের জন্য কখনো কখনো তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হয়েছেন। পূরণ করেছেন তাদের লালসা।
তার দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে ৫ নং সেক্টর অঞ্চলে বিভিন্ন যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অর্জন করেছেন অভাবনীয় সাফল্য। গোয়েন্দাগিরির পাশাপাশি তিনি এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র দেখাশোনা ও সংরক্ষণ করতে গিয়ে নিজেও সেগুলো চালানো শিখে নেন এবং বেশ ক’টি সম্মুখ সমরেও অংশ নেন।
কাকন বিবির বীরত্বের কথা তুলে ধরে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আগস্ট মাসে পাক সেনাদের সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ আগমন প্রতিরোধ করতে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জাওয়া সেতু’ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এসময় কাকন বিবি গভীর রাতে কলাগাছের ভেলায় চড়ে জেলেনীর ছদ্মবেশ নেন। মাইন ও গোলাবারুদসহ জাওয়া সেতুর কাছে গিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংকেত দেন। তার সংকেত মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধারা এ অপারেশনে সাফল্য লাভ করেন।
এই দেশের বিজয়ে এতবড় ভূমিকা রাখা মানুষটি আজ বড়ই একা। তাছাড়া তিনি এখন কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত। চলাফেরা করার ক্ষমতাও নেই। টাকার অভাবে তার যথাযথ চিকিসাও হচ্ছে না। তাছাড়া অসুস্থ এই নারী বীরপ্রতীক কষ্ট পাচ্ছেন খাবারের জন্যেও।
বাংলানিউজের সাথে আলাপকালে কাকন বিবির মেয়ে ছকিনা বলেন, মায়ের প্রতিমাসে এখন প্রায় ৩ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। তিনি দুধ ছাড়া আর কিছুই খেতে পারেন না। তিন বেলাই শুধু দুধ খান। এটি খেয়েই বেঁচে আছেন। দুধ বাবদ মাসে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা চলে যায়। বীরপ্রতীক খেতাব প্রাপ্ত হলেও গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই ভাতা পাচ্ছেন। সেই সামান্য ভাতায় মায়ের ভরণ পোষণ চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে দোয়ারাবাজার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার সফর আলী বাংলানিউজকে বলেন, কাকন বিবি’র পাশে আমরা সব সময় ছিলাম। সে যখন অসুস্থ ছিল তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড থেকে অর্থ সহযোগিতা দিয়েছি।
বিষয়টি অবহিত করে বাংলানিউজ কথা বলে সুনামগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নূরুল মোমেনের সঙ্গে। জবাবে তিনি বলেন, জেলা কমিটির মেয়াদ কয়েক মাস আগে শেষ হয়েছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক (সাবিরুল ইসলাম) এখন কমিটির সভাপতি পদে আছেন। তবে আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৭
এইচএমএস/জেএম