রাত ১০টার পরে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্রামটি আশপাশের এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে নির্বিঘ্নে যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য স্থানীয়দের উদ্যোগে তৈরি করা এক হাজার ফুট লম্বা ভাসমান সেতু, যা এখন চালুর অপেক্ষায়।
সরেজমিনে জানা যায়, ঝাঁপা গ্রামটিকে ঘিরে রাখা ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং পৌনে এক কিলোমিটার প্রস্থ মিলে ৬৪০ একর জলাকারের ঝাঁপা বাঁওড়ের মধ্যভাগে ১৮ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত গভীরতা রয়েছে। সরকার বাঁওড়টি ইজারা দিয়ে বছরে অর্ধকোটিরও বেশি টাকা আয় করলেও ঝাঁপাবাসীর কষ্ট লাঘবে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সমস্যা সমাধানে স্বপ্নও দেখায়নি কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক দলের নেতারা। তবে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে নানা প্রতিকূলতায় টিকে থেকে কৃষি, মৎস্য এবং বৈদেশিক আয়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখন অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট সাবলম্বী। গ্রামটিতে চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দু’টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং দু’টি মাদ্রাসা রয়েছে। এ গ্রামের শিক্ষার হারও বেশ ভালো।
বিভিন্ন সময় এলাকাবাসী বাঁওড়টির উপর সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে এলেও সংশ্লিষ্টরা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে স্থানীয় যুব সমাজ ও গ্রামবাসীর উদ্যোগে বাঁওড়ে ভাসমান সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। একপর্যায়ে স্থানীয়দের অর্থায়নে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এক হাজার ফুট লম্বা ভাসমান সেতু।
সরেজমিনে দেখা যায়, মণিরামপুরের রাজগঞ্জ বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে ঝাঁপা বাঁওড় খেয়াঘাটে গিয়ে দেখা গেলো উৎসুক মানুষের ভিড়। বহিরাগতদের মোটরসাইকেল রাখার জন্য স্থানীয় কয়েকজনে একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজ গড়ে তুলেছেন, সেখানে টাকার বিনিময়ে মোটরসাইকেল রাখা হচ্ছে। এরপর খেয়া পার হয়ে ওপারে গেলে দেখা গেলো বাঁওড়ের ধার দিয়ে লম্বাভাবে রাখা ভাসমান সেতু। সেতুর মূল কাঠামোসহ ৯৫ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে, এখন দিন-রাত রংয়ের কাজ ও কিছু ওয়েল্ডিংয়ের কাজ চলছে। তবে ভাসমান সেতুটি একনজর দেখতে নৌকা-ট্রলার ভাড়া নিয়ে শত-শত মানুষ ভিড় করছে।
ভাসমান সেতু নির্মাণের অন্যতম উদ্যোক্তা ঝাঁপা গ্রামের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, নদ-নদীতে ভাসমান প্লাস্টিকের ড্রামের উপর ড্রেজার মেশিন রেখে পানি-বালু উত্তোলনের দৃশ্য দেখে প্রশ্ন জন্মে, অধিক ওজন সম্পন্ন মেশিনটি যদি প্লাস্টিকের ড্রামের উপর থাকতে পারে, তাহলে এমন পদ্ধতিতে অল্প ব্যয়ে আরও সেতু তৈরি সম্ভব কি না? পরবর্তীতে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা এলাকায় সেনাবাহিনীর তৈরি ভাসমান সেতু এবং ভারতের বনগাঁতে ছোট আকৃতির ভাসমান সেতু আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, একপর্যায়ে ইন্টারনেটে সার্চ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্মিত ভাসমান সেতু দেখে যাচাই-বাছাই করি, পরে পরিচিত কয়েকজন প্রকৌশলী আর স্থানীয় ওয়ার্কশপে কথা বলে আমরা সেতু তৈরির স্বপ্ন দেখি। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়নের বড় বাধা অর্থায়নের বিষয়ে চলতি ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে প্রথম আলোচনা সভায় মিলিত হয়। সেদিনই সবাই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখালে এরপরে আরও কয়েকটি আলোচনা সভা করে অর্থায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
তিনি আরও বলেন, সেতু তৈরির উদ্দেশে ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ৬০ জন সদস্য মিলে ৫০ লাখ টাকার ফান্ড গঠন করা হয়। এরপর প্লাস্টিকের ড্রাম-রড কিনে বাঁওড়ের পাশে কাজ শুরু করি। প্রথমদিকে, কিছু লোক না বুঝেই মন্তব্য শুরু করলেন- ‘এভাবে সেতু তৈরি সম্ভব না, সেতু হলেও যাতায়াত সম্ভব না’ এমন অসংখ্য বক্তব্য। তবে আমরা ভেঙে পড়িনি। বর্তমানে সেতুর শতকরা ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে, চলছে রংয়ের কাজ। আশা করছি, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই চালু হবে দেশের বৃহত্তম এই ভাসমান সেতু।
ভাসমান সেতু তৈরির কাজে নিয়োজিত স্থানীয় রাজগঞ্জ বাজারের বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এক হাজার ফুট লম্বা ও চার ফুট চওড়া ভাসমান এ সেতু নির্মাণে ৮৩৯টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮০০ মণ লোহার পাত ও ২৫০টি লোহার অ্যাঙ্গেল সিটের ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও ভাসমান সেতুটিকে একইস্থানে আটকে রাখতে দুই ধারদিয়ে ৬০টি নোঙ্গর বসানো হচ্ছে। এর আগে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও উদ্যোক্তাদের পরামর্শে তিনি এ কাজ বাস্তবায়ন করেছেন বলেও জানান। ৫০ লক্ষাধিক টাকা খরচে নির্মিত এই ভাসমান সেতু উন্মুক্ত হলে, বাই সাইকেল, মোটরসাইকেল, ভ্যান, ইজিবাইক ও নসিমন চলাচল করবে। তবে প্রাইভেট কার চলাচলের সক্ষমতা থাকলেও সেতুর দীর্ঘস্থায়ীত্বের কথা বিবেচনা করে প্রাইভেট কার চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে।
ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক লিটন হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভাসমান সেতুটি গ্রামবাসীর চলাচলের সুবিধার্থে করা হয়েছে। এতে, বাণিজ্যিক কোনো চিন্তা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এতোদিন নৌকায় পারাপারের জন্য মাঝিদের গ্রামবাসী সপ্তাহে পাঁচ টাকা করে নগদ এবং বছরে এক মণ করে ধান ও ইচ্ছামাফিক মৌসুমি ফসল দিতেন। একই খরচে গ্রামবাসী ভাসমান সেতু ব্যবহার করতে পারবেন। তবে বাইরের এলাকার লোকজন আগের নৌকার মতো নির্ধারিত টাকা দিয়ে সেতু পার হবেন। এই ঘাটে তিন পুরুষ ধরে দায়িত্বে থাকা চার মাঝি ওই টাকা সংগ্রহ করবেন। এতে মালিকদের নির্দিষ্ট বেতন এবং সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলবে। তেমনি, ধীরে ধীরে উদ্যোক্তারা তাদের বিনিয়োগ করা মূলধন ফেরত পাবেন। এভাবে সেতু নির্মাণের খরচ উঠানোর পরে এলাকাবাসী বিনামূল্যে সেতু ব্যবহার করবে, আর বহিরাগতদের কাছ থেকে যৎসামান্য টাকা নিয়ে সেতু রক্ষণাবেক্ষণ আর মাঝিদের বেতন দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
ঘাটের মাঝি অসিম দে বাংলানিউজকে বলেন, তিনিসহ চার মাঝি তিন পুরুষ ধরে নৌকায় পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে ভাসমান সেতুতে এলাকাবাসীর সুবিধার স্বার্থে তারাও অখুশি নন। এমনকি, সেতু হলেও তাদের কর্মসংস্থান টিকে থাকবে সেই আশায় সেতু তৈরিতে ৩০ হাজার টাকা করে সহযোগিতা করেছেন প্রত্যেক মাঝি।
ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘যশোরের জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমাদের যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন, তবে ভাসমান সেতু নির্মাণে আমরা কখনো সরকারি সহযোগিতা চাইনি। তিনি আরও বলেন, ‘বাঁওড়ের একপাশে সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে, এখনও চালু হয়নি। তবুও দূর-দূরন্তের লোকজন নৌকা কিংবা ট্রলার ভাড়া দিয়ে একনজর সেতু দেখতে আসছেন। প্রতিদিন, হাজার-হাজার দর্শনার্থী আসছে, এতে নির্মাণকাজের বাধাগ্রস্ত হয়, তবুও কিছুই বলার নেই বরং আমাদের ভালো লাগে। নিজেরা সার্থক মনে করি। তিনি আরও বলেন, পুরোপুরি প্রস্তুত করে রাখা সেতুটি বাঁওড়ের মধ্যে সেটিং করা হবে, তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে সেতু উন্মুক্ত করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
এসএইচ