তবে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তা বলছেন, এ রোগে আক্রান্ত গরুর মৃত্যুহার খুবই কম তাই এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই লিফলেট বিতরণসহ উঠান বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর ও কালাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জেলায় ব্যাপক হারে এ রোগ দেখা দেয়। রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে পশুর জ্বর, ব্যথা, খাবার গ্রহণে অরুচি দেখা দিচ্ছে। আক্রান্ত পশুর শরীরের বিভিন্ন অংশে গোলাকার গুটি বা ফোস্কা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি পায়ে এবং শরীরের নিচের অংশ ফুলে পানি জমা হচ্ছে। শেষ পর্যায়ে কয়েকটি গুটি বা ফোস্কা ফেটে যাচ্ছে ও ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে।
পাঁচবিবি উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. হাসান আলী বলেন- রক্ত চোষা আঠালী, মাইট, মশা ও মাছির মাধ্যমে রোগটি দ্রুত এক পশু থেকে অন্য পশুতে ছড়ায়। আক্রান্ত পশু এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহনের মাধ্যমে রোগটি ছড়াতে পারে।
এছাড়াও আক্রান্ত পশুর লালা, দুধ এবং আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেন এর মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত পশু পরিচর্যাকারী, চিকিৎসক বা ভ্যাকসিন প্রদানকারীর মাধ্যমেও রোগটি অন্য সুস্থ পশুতে ছড়াতে পারে।
জয়পুরহাট সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, কোনো গাভী এ রোগে আক্রান্ত হলে গাভীর দুধের উৎপাদন কমে যায়, গর্ভপাত হয়, বন্ধ্যাত্বসহ ওজন অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়াও এ রোগে আক্রান্ত পশুর চামড়ার মান খারাপ হওয়ায় খামারিরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জয়পুরহাট সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মামুনুর রশিদ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ হিসেবে জানান, খামারের জীবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, খামার ও এর আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণ করা। খামারে আক্রান্ত পশুর জন্য মশারির ব্যবস্থা করা এবং আক্রান্ত পশু দ্রুত অন্য স্থানে সরিয়ে পৃথকভাবে চিকিৎসা ও পরিচর্যা করা। আক্রান্ত অঞ্চলে পশুর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা এবং সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চারণ ভূমিতে না নেওয়া। গোট পক্স বা শিপ পক্স ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি আক্রান্ত পশুর ক্ষতস্থান টিংচার আয়োডিন বা পভিসেপ দ্বারা পরিষ্কার করা। পরিশেষে রোগটি দেখা দিলে দ্রুত পরামর্শ অথবা চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
আক্কেলপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. তরিকুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন গড়ে ২৫/৩০টি আক্রান্ত গরুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো গরু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
জয়পুরহাটের বিভিন্ন গ্রাম, পাড়া ও মহল্লা ঘুরে দেখা গেছে, আক্রান্ত গরুর শরীরে বিভিন্ন স্থান ফুলে যাচ্ছে। পরে সেখানে মারাত্মক ক্ষত হচ্ছে। ক্ষতস্থান থেকে চামড়া ও মাংস পচে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে আক্রান্ত গরু। এ বিরল রোগ সম্পর্কে ধারণা নেই খামারিদের। একই সঙ্গে এ রোগের কোনো প্রতিষেধক না থাকলেও ছাগলের ভ্যাকসিন হিসেবে পরিচিত ‘গোট পক্স ভ্যাকসিন’ এসব আক্রান্ত গরুকে প্রয়োগ করা হচ্ছে। খামারিরা এসব আক্রান্ত গরুগুলো নিয়ে প্রতিদিন ভিড় করছেন স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে। এরপরও কিছুতেই তাদের আতঙ্ক কাটছে না।
জয়পুরহাট সদরের গৌরীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জাহেরা বেগম, মাদারগঞ্জের রবি, নতুন হাট সরদার পাড়া মহল্লার আব্দুল লতিফ, সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকালে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে ‘লাম্পি স্কিন’ ডিজিজে আক্রান্ত গরুগুলো নিয়ে এসেছেন চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। তারা সবাই বলেন, হঠাৎ করেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গরুগুলো খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। পুরো শরীরে চাকা চাকা দাগ দেখা দিয়েছে।
একই অবস্থা আক্কেলপুর উপজেলার কানুপুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস, রাজকান্দা গ্রামের শাহানুর রহমান, ঠেংগাপুরের আলা উদ্দীনসহ অনেকের গরুর। তারা সবাই আক্রান্ত গরুগুলোকে নিয়ে পড়েছেন বেকায়দায়।
পাঁচবিবি উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের কাঁসড়া গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা তাহেরা বেগম জানান, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ মাস বয়সের একটি বাছুর রেখে আমার একটি গাভী মারা গেছে। দুধ খাওয়া বাছুরটি নিয়ে আমি এখন বিপাকে পড়েছি।
একই উপজেলার বাগজানা ইউনিয়নের পূর্ব রাম চন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা আনিছুর রহমান অনেকটা আক্ষেপের সূরে জানান, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পেটে ৬ মাসের বাচ্চাসহ আমার একটি গাভী মারা গেছে। এতে আমার অন্তত ৮০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হলো।
অন্যদিকে গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা মমিনুর রহমান বলেন, অনেকটা গুটি বসন্তের মতো দেখতে হলেও এ রোগের চিকিৎসা দিতে পারছেন না প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। এতে করে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি।
তিনি আরও বলেন, এ রোগে আমার বাড়ির ২টি গাভী ও ২টি বাছুর আক্রান্ত হয়েছে।
একই অবস্থা মহিপুর গ্রামের বাসিন্দা খালেদা, রেনু, রুবি, বরণ গ্রামের একরামুল হোসেন, সিথা মাথখুর গ্রামের দুলাল হোসেনসহ বিভিন্ন পরিবারের। এসব পরিবারের সদস্যরা প্রতিদিনই তাদের আক্রান্ত গবাদী পশুগুলোকে নিয়ে ভিড় করছেন স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরে।
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. ইসমাইল হক জানান, এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা না থাকলেও ভয়ের কিছু নেই। কারণ এ রোগে আক্রান্ত গরুর মৃত্যুহার খুবই নগন্য। তাই আক্রান্ত গরু নিয়ে খামারিদের আতঙ্ক হওয়ার কিছু নেই। তারা সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই টিম গঠন করে মাঠ পর্যায়ে লিফলেট বিতরণের পাশাপশি উঠান বৈঠকের কাজ শুরু করেছেন।
নভেম্বরের ৭ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত জয়পুরহাট জেলার ৫টি উপজেলায় ৭শ’র মতো গরু ‘লাম্পি স্কিন’ ডিজিজে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি গরু মারা গেছে বলে খবর রয়েছে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
আরএ