মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাক হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর স্বাধীনতার পতাকা ওঠে কালকিনির আকাশে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এসে কালকিনিতে পাক বাহিনীর প্রবেশ ঘটে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে কালকিনির ভুরঘাটা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে পাক হানাদার বাহিনী। ক্যাম্প করেই নিরীহ মানুষদের হত্যায় মেতে ওঠে তারা। শুরু হয় ঘরে ঘরে লুটপাট ও নির্যাতন। ভুরঘাটার পাশে একটি ব্রিজের কাছে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতে থাকে পাক বাহিনী। নিরীহ মানুষের রক্তে লাল হয়ে যায় খালের পানি!
জানা গেছে, কালকিনির ভুরঘাটা সংলগ্ন লালব্রিজ নামক স্থানটি গণহত্যার অন্যতম সাক্ষী হয়ে আছে। যুদ্ধকালীন মাদারীপুরের মধ্যে কালকিনিতেই সবচেয়ে বেশি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষদের ধরে এনে লালব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে গুলি ও জবাই করে হত্যা করতো শত্রুরা। অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ব্রিজটি। এ কারণেই যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ‘লালব্রিজ’ নামে পরিচিতি পায় স্থানটি। স্বাধীনতার পরে কলংকিত ওই ব্রিজটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। পরে আবার তৈরি করা হয় সেটি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, শত শত মানুষকে হত্যার ভয়ংকর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ লালব্রিজে। নিরীহ মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে ব্রিজের ওপর থেকে জবাই করে, গুলি করে নিচের পানিতে ফেলে দিতো হানাদাররা।
কালকিনির ফাসিয়াতলা গণহত্যা আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় কালকিনি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের ফাসিয়াতলা বাজারে পাক বাহিনী ও রাজাকার মিলে গণহত্যা চালায়। রাজাকার ও পাক বাহিনী মিলে একটি দল ফাসিয়াতলা বাজারে আক্রমণ করে। প্রথমে আল শামস ও রাজাকাররা মিলে পালরদী নদীর পাড় খোলা রেখে স্থলভাগের তিনদিক ঘিরে রাখে। ওই সময় দু’টি বড় নৌকা নিয়ে পাকিস্তানি মেজর পায়েন্দা খানের নেতৃত্বে ৫০ পাকসেনা ও রাজাকার-আলবদরের ৩০/৩৫ সদস্য মিলে একযোগে ফাসিয়াতলা বাজারে আক্রমণ করে। বাজারে প্রবেশ করে ব্রাশফায়ার করে হত্যা শুরু করে তারা।
পরে দোকানপাট লুট ও বাজারসহ আশেপাশের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় কমপক্ষে সাতশ’ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা। দিনটি ছিল হাটের দিন। নৌকায় করে হাটে আসা মানুষদের ধরে ধরে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ফাসিয়াতলা বাজার সংলগ্ন ঘোষ পাড়ায় চলে হত্যাযজ্ঞের মহোৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল তাদের ঘরে আটকে রেখে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
উপজেলার সিডিখান, এনায়েত নগর, সমিতির হাট ছাড়াও পাশের বরিশালের গৌরনদী, মুলাদী উপজেলা ও কালকিনির সীমান্তবর্তী তিনটি স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ হয় পাকবাহিনীর সঙ্গে। এ সম্মুখ যুদ্ধে পাক বাহিনীকে পরাজিত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এভাবেই ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুরের কালকিনি।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। এ এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়েছিল তখন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ইতিহাস, কালকিনিবাসীর আত্মত্যাগ বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয় না তেমন ভাবে। বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে কালকিনিবাসীর আত্মত্যাগের ইতিহাস জানাতে হবে। হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেন তারা লালন করতে পারে সে লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি পালন করতে হবে। তৈরি করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিস্তম্ভও। এমন দাবি মুক্তিযোদ্ধাসহ সুধীজনদের।
কালকিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মালেকুজ্জামান বলেন, ১৫টি সম্মুখযুদ্ধসহ অসংখ্য সংঘর্ষ হয় কালকিনিতে। এখানে বহু সাধারণ মানুষ হত্যার শিকার হয়। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে কালকিনি শত্রুমুক্ত হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কালকিনি মুক্তদিবসে উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৯
এফএম