ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ফেলানী হত্যার ৯ বছর, বিচারের আশা ছাড়েননি বাবা-মা

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২০
ফেলানী হত্যার ৯ বছর, বিচারের আশা ছাড়েননি বাবা-মা

কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে কিশোরী ফেলানী হত্যার নয় বছর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘকাল অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের সুবিচার মেলেনি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হলেও বিচারের আশা ছাড়েননি ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলাম ও মা জাহানারা বেগম। কোনো একদিন মেয়ের হত্যার কাঙ্ক্ষিত বিচার মিলবে এ অপেক্ষায় দিন গুনছেন তারা। 

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ীর উত্তর অনন্তপুর সীমান্তের ৯৪৭ নম্বর আন্তর্জাতিক পিলারের পাশে মই বেয়ে কাটাতাঁর পার হচ্ছিল ফেলানী। বাবার সঙ্গে দেশে ফিরছিল সে।

সে সময় টহলরত ভারতীয় চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে।

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) ফেলানী হত্যার ৯ম মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে কথা হয় তার বাবা ও মায়ের সঙ্গে। এ সময় দীর্ঘদিনেও ফেলানী হত্যার বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে তারা বলেন, মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মানবাধিকার সংস্থাসহ বহুজনের কাছে গেছি, ভারতের আদালতে স্বাক্ষী দিছি। চোখের সামনে কাঁটাতারের বেড়ায় পাখির মতো গুলি করে মারা হয় ফেলানীকে। কিন্তু সেই হত্যার ৯ বছর গেলেও বিচার পাওয়া গেলো না। এটা যে কতো বড় কষ্টের, কতো বড় বেদনার! মেয়ের হত্যার বিচারের আশায় এখনও অপেক্ষায় আছি।  

এ ব্যাপারে ফেলানী হত্যা মামলার বাদী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতির নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী মুঠোফোনে বাংলানিউজকে জানান, এখন পর্যন্ত ফেলানীর পরিবার ক্ষতিপূরণসহ স্বচ্ছ বিচার না পাওয়ায় ওই মামলার একজন বাদী হিসেবে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। আশা করছি আমরা কাঙ্ক্ষিত বিচার পাবো।

ফেলানী হত্যা মামলায় বাংলাদেশ পক্ষের আইনজীবি কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বাংলানিউজকে বলেন, ফেলানীর পরিবারের পক্ষ থেকে আনা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সুপ্রিমকোর্টে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রতিপক্ষ জবাব দাখিল করেছে বলে জেনেছি। ফলে আমি মনে করি, এখন রিটটির চূড়ান্ত শুনানি হতে পারে। ফেলানী হত্যার রিটের দ্রুত নিষ্পত্তি হলে সীমান্ত হত্যার বিচারের একটি দিকনির্শেনাও আমরা পেতে পারি।  

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় বিএসএফ’র ১৮১ সদর দপ্তরে স্থাপিত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচারকার্য শুরু হয়। কিন্তু ৫ সেপ্টেম্বর ওই আদালত ফেলানী হত্যায় অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। ১১ সেপ্টেম্বর ওই রায় প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে ফেলানী হত্যায় ন্যায় বিচার চেয়ে একটি চিঠি দেন ফেলানীর বাবা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনরায় ফেলানী হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে একাধিকবার তা স্থগিত হয়।  

এদিকে ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ফেলানী হত্যায় স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে বাদী হয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি ফৌজদারী মামলা করেন ফেলানীর বাবা ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী। ওই মামলায় আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া) সচিব ও বিএসএফ’র মহাপরিচালককে বিবাদী করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের ২১ জুলাই অন্তবর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ চেয়ে আরও একটি আবেদন করেন ফেলানীর বাবা।  

একই সালে আইন ও শালিস কেন্দ্র এবং ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ফেলানী হত্যায় আরও একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে। সে বছর ৩১ আগস্ট ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ লাখ রুপি দোয়ার অনুরোধ জানায় দেশটির সরকারকে। এর জবাবে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্টো ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলামকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়। ২০১৬ ও ১৭ সালে কয়েক দফা ফেলানী হত্যা মামলার শুনানি পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি মামলার শুনানির দিন ধার্য করা হলেও এখন পর্যন্ত শুনানি হয়নি।  

ফেলানী হত্যার নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবার ও বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজন

ফেলানী হত্যার নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার পরিবার ও ঢাকাস্থ নাগরিক পরিষদ দুইদিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।  

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারী) সকালে পারিবারিকভাবে ফেলানীর কবর জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন অরা হয়েছে।  

অন্যদিকে গুলশান-২-এর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পার্ক রোড অথবা কূটনৈতিক এলাকার একটি রাস্তার নাম ফেলানী সরণী করার আবেদন জানিয়েছে নাগরিক পরিষদ। এ উপলক্ষে সোমবার (৬ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে একটি স্মারকলিপি দিয়েছে এ সংগঠন।  

এছাড়া ফেলানী হত্যার দিন স্মরণে মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্বব্যাপী ফেলানী দিবস পালনের দাবিতে রাজধানীর তোপখানা রোডের নির্মল সেন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে নাগরিক পরিষদ। সংগঠনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীনের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত থাকবেন- বিএসএফের মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল রৌমারীর বড়াইবাড়ী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে বিডিআর ক্যাম্প আক্রমণের চেষ্টা চালায় বিএসএফ। লাল মিয়া ওই  আক্রমণ প্রতিরোধ করেন।  
ফেলানী হত্যা স্মরণে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচির ব্যাপারে নিশ্চিত করে নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক শামসুদ্দীন মুঠোফোনে বাংলানিউজকে জানান, গত কয়েক বছর ধরে এদিনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে তারা। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ৭ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী ফেলানী দিবস পালন, ফেলানী হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের ফাঁসি, তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তকে ফেলানী সীমান্ত হিসেবে নামকরণ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পার্ক রোড অথবা কূটনৈতিক এলাকায় যে কোনো একটি রাস্তার নাম ফেলানী সরণী করা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনচেষ্টা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে তারা।

শামসুদ্দীন আরও জানান, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও ৭ জানুয়ারি ফেলানী দিবস পালনের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করে নাগরিক পরিষদ। পরবর্তীতে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, এটি বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের সদস্য কোনো রাষ্ট্রকে প্রস্তাব তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ০৫৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২০
এফইএস/এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।