ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জুন ২০২৪, ১৮ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

হেফজখানা থেকে পালানো বিপ্লব এখন দুর্ধর্ষ ডাকাত

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২২
হেফজখানা থেকে পালানো বিপ্লব এখন দুর্ধর্ষ ডাকাত আবু জাফর বিপ্লব

ঢাকা: দরিদ্র ঘরের সন্তান আবু জাফর বিপ্লব (৩৮)। ছোট বেলায় সাতক্ষীরা নলতা দারুল উলুম মাদরাসার হেফজখানায় পড়াশোনা করতেন।

পবিত্র কোরআনের ২৭ পারা মুখস্ত করেন তিনি। বাকি ৩ পারা মুখস্ত করলেই পেয়ে যেতেন পাগড়ি। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি।  

মাদরাসা থেকে পালিয়ে সাতক্ষীরার কলরোয়া এলাকায় একটি হোটেলে কাজ শুরু করেন তিনি। মাসখানেক পর বিপ্লবকে ওই হোটেল থেকে ধরে নিয়ে স্থানীয় একটি মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি করে দেয় তার বাবা জাবেদ আলী।  

২০০২ সালে মাধ্যমিক (এসএসসি) পাসের পর পুনরায় তাকে মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। কিন্তু একদিন মাদরাসার হেফজখানায় নামাজের পেছনের কাতার থেকে পালিয়ে বিপ্লব চলে আসেন ঢাকায়। গাবতলী বাস টার্মিনালে গাড়ি পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন তিনি।  

সাত বছর পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগযোগ ছিল না তার। এ সময় নিজেকে বাসচালক হিসেবে তৈরি করে নেয়। এরপর সাভারের এক কুখ্যাত সন্ত্রাসী বিপুল ওরফে ডাকাত বিপুল এবং দিলিপের দীক্ষায় দুর্ধর্ষ ডাকাত হয়ে ওঠেন আবু জাফর বিপ্লব। বাস চালানোর পাশাপাশি রাতের বেলায় যাত্রী বেশে শুরু হয় তার ডাকাতি ও ছিনতাই কার্যক্রম।  

গত ২০ জানুয়ারি চিকিৎসক ও তার বন্ধুকে রাতভর বাসে তুলে ঘুরিয়ে মারধর করে সবকিছু লুটের ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) তেঁজগাও বিভাগের হাতে গ্রেফতার হওয়া ডাকাত দলের অন্যতম সদস্য আবু জাফর বিপ্লব ওরফে ডাকাত বিপ্লব রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতার বিপ্লব একটি ডাকাত দলের মূলহোতা। তার নেতৃত্বে একটি দল সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই, গাজীপুর ও রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাইভেটকার ও বাস রিজার্ভ (ভাড়া) নিয়ে ডাকাতি করে আসছিল।  

গত ২০ জানুয়ারি চিকিৎসক ও তার বন্ধুকে বাসে তুলে রাতভর মারধর ও টাকা লুটের ঘটনায় বিপ্লব সরাসরি জড়িত থাকার কথাও প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন। ওই ঘটনায় বিপ্লব ‘আর কে আর পরিবহন’র বাসটির চালক হিসেবে ছিলেন। তার সঙ্গে বাসের হেলপার হিসেবে ছিলেন গ্রেফতার আল আমিন। এই ঘটনায় তাদের দলনেতা ও ডাকাতির গুরু দিলিপ ওরফে সোহেল।

বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. শাহাদত হোসেন সুমা বাংলানিউজকে বলেন, বাসে ডাকাতির ঘটনায় ধারাবাহিক অভিযানের মাধ্যমে বিপ্লবসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথম দফায় ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দ্বিতীয় দফায় আরও সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

তিনি বলেন, গ্রেফতার আসামিরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ডাকাত সদস্য। তাদের প্রত্যেকের রিরুদ্ধে হত্যা, মাদক, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের একাধিক মামলা রয়েছে। এসব অপরাধের কারণে তারা বারবার কারাগারে গেলেও জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজে লিপ্ত হচ্ছেন।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রথম দফায় গ্রেফতার আটজনকে চারদিন করে এবং দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার ছয়জনকে তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তারা জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তবে তদন্তের কারণে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এই চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলেও জানান তিনি।  

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদে আসামি বিপ্লব জানান, তার পরিবারে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। তার অপকর্মের জন্য স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর বিপ্লব ঢাকার সাভারের সিঙ্গাইর বাস্তা স্ট্যান্ড এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। বিপ্লবের মেয়ে লামিয়া একটি মাদরাসায় হেফজ পড়াশোনা করছে।

যেভাবে দুর্ধর্ষ ডাকাত হয়ে ওঠেন বিপ্লব
সাতক্ষীরা হেফজখানা থেকে পালিয়ে ঢাকার গাবতলীতে চলে আসার পর তিনি প্রথম রাত বাসেই ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর ওই বাসের মালিককে ধরে বাসেই ঝাড়ু ও পরিষ্কারের কাজ নেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বাসের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন।  

দীর্ঘ সাত বছরে তিনি ভালো বাসচালক হয়ে ওঠেন। এ সময় বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল।  

বিপ্লবের দাবি, ঢাকা-আরিচা রুটে বিভিন্ন গাড়ি চালাতেন তিনি। গাড়ি চালাতে গিয়েই ২০১০-১১ সালে বিপুল ডাকাতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বিপুল খুনের আসামি, এখন ভারতে পালিয়ে আছেন। সেই বিপুলের হাত ধরে বাস নিয়ে ডাকাতির কাজ শুরু করেন তিনি। বেশিরভাগ সময় গাড়ির চালক হিসেবেই কাজ করতেন বিপ্লব। ডাকাতির পাশাপাশি মাদকাসক্তও হয়ে পড়েন।
 
আবির-শাকিল জোড়া খুনের প্রধান আসামি বিপ্লব
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে চলন্ত বাসে আশুলিয়ার কুঁড়গাওয়ের কলেজছাত্র আবির-সোহেল জোড়া খুনের মামলার প্রধান আসামি আবু জাফর বিপ্লব ওরফে ডাকাত বিপ্লব।  

ওই বছরের মে মাসে বিপ্লব পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এই ঘটনায় দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন তিনি।  

২০১৮ সালে হত্যা মামলায় জামিনে কারাগার থেকে বের হন বিপ্লব। এরপর হেরোইনসহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে আবার ধরা পরেন বিপ্লব। ওই মামলায় কারাগার থেকে বের হয়ে শুরু করেন ইয়াবা কারবারি।  

২০১৯ সালে ১ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন বিপ্লব ও তার সহযোগী হাসান। তবে তার অপরাধ জগতে বাসে ও প্রাইভেটকারে যাত্রী বেশে ডাকাতির ঘটনায় কোনো সময় গ্রেফতার হননি বিপ্লব। গ্রেফতারের পর তিনি কারাগারে বন্দিদের কাছে ভাত বিক্রি করে টাকা আয় করেন। সেই টাকা দিয়ে আদালতে আইনজীবী ধরে নিজের জামিনের ব্যবস্থা করেন বিপ্লব।

খুনের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে বিপ্লব বলেন, বাসে ডাকাতি করতে বের হয়েছিল তাদের চক্রটি। তাদের নেতা ছিলেন বিপুল ও দিলিপ। আরও ছিলেন বাহাদুর, মাসুম, আল আমিন ও বিপ্লব। চলন্ত বাসে টাকা ভাগাভাগিসহ আরও বিছু বিষয় নিয়ে তাদের দুই পক্ষের মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি। এতে বিপুল, বাহাদুর ও মাসুম মিলে তাদের দলের সদস্য আবির ও শাকিলকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে স্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এ সময় ওই বাসটি চালাচ্ছিলেন বিপ্লব এবং হেলপার ছিলেন আল আমিন। এরপর দুটি মরদেহ ওই বাসে রেখে তারা সবাই পালিয়ে যান।

প্রাইভেটকারে বিপ্লবের ডাকাতি
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আসামি বিপ্লব জানান, আগে বাসে ডাকাতি করলেও কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি নিজেই একটি ডাকাত গ্রুপ তৈরি কেরেন। ভাড়ায় একটি প্রাইভেটকার নিয়ে ঢাকা, সাভার, নবীনগর, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই ও ডাকাতি করতেন। বিপ্লবের সহযোগী ছিলেন ইলিয়াস ও শাকিল। তারা রাতের বেলায় প্রাইভেটকার নিয়ে বের হতেন। যাত্রী তুলে মারধর ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টাকা ও মালামাল লুট করে নিতেন।

চিংড়ির ব্যবসার আড়ালেও বিপ্লবের অপকর্ম
গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বিপ্লব বলেন, মদক (ইয়াবা) মামলায় ২০২০ সালে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে স্ত্রী-সন্তানের নামে ‘এলটি চিংড়ি হাউজ’ নামে মাছের ব্যবসা শুরু করেন বিপ্লব। অনলাইয়ে অর্ডার নিয়ে চিংড়ি সরবরাহ করতেন তিনি। একই সঙ্গে জাল নোটের কারবারও চালিয়ে যেতে থাকেন। কৌশলে বিভিন্ন ক্রেতা-বিক্রেতাদের আসল টাকার সঙ্গে জাল নোট দেন। বিভিন্ন দোকান থেকে পণ্য কিনে জাল নোট দিতেন।  

এদিকে, চিংড়ি ব্যবসার পাশাপাশি রাতে তাদের চক্রের সদস্যদের সঙ্গে বাসে ও প্রাইভেটকারে করে ছিনতাই ও ডাকাতি করতে বের হতেন বিপ্লব।

গত ২০ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে আর কে আর পরিবহনে ওঠার পর ভয়ানক এক ডাকাত চক্রের কবলে পড়েন চিকিৎসক মো. শরিফুল ইসলাম ও তার বন্ধু। ডাকাতরা তাদের ১২ ঘণ্টা বাসে ঘুরিয়ে মারধর করে কাছে থাকা নগদ ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা, মোবাইলের বিকাশ থেকে ৫ হাজার ও দুটি এটিএম কার্ড থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও অন্য জিনিসপত্র লুটে নেন। এরপর মাতুয়াইলে সড়কের পাশে তাদের ফেলে পালিয়ে যান।  

ভুক্তভোগী মো. শফিকুল ইসলাম টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) হিসেবে কর্মরত।

এই ঘটনাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে ৩০ জানুয়ারি রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তঃজেলা ডাকাত চক্রের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২২
এসজেএ/জেএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।