ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ মে ২০২৪, ০০ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

বাংলাদেশে আইসের বাজার তৈরির চেষ্টায় মিয়ানমারের চক্র

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২২
বাংলাদেশে আইসের বাজার তৈরির চেষ্টায় মিয়ানমারের চক্র ফাইল ছবি

ঢাকা: এক সময় দেশে মাদক হিসেবে পরিচিত ছিল—মদ, গাঁজা ও ফেনসিডিল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তৈরির পর ফেনসিডিল বাংলাদেশে আনা হতো।

নব্বই দশকে ফেনসিডিল ভয়াবহ মাদক হিসেবে বহুল প্রচলিত থাকলেও ধীরে ধীরে সেই জায়গা দখল করে নেয় ইয়াবা ট্যাবলেট। এক দশকের ব্যবধানে দেশে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে ইয়াবা। দেশের আনাচে কানাচে সহজলভ্য হয়ে ওঠে এই মাদক। মিয়ানমার থেকে সীমান্তবর্তী নাফ নদী পার হয়ে প্রতিনিয়ত ঢুকতে থাকে ইয়াবা ট্যাবলেট। অসাধু চক্র ও রাজনৈতিক প্রভাবে তৈরি হয় মাদকের বড় বড় সিন্ডিকেট।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানে এই সিন্ডিকেটের অনেককে আইনের আওতায় আনা গেলেও বন্ধ হয়নি ইয়াবার কারবার। তবে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের রুটেই আসছে আরও ভয়াবহ মাদক ক্রিস্টাল মেথ (আইস)। এরই মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বে প্রচলিত নানা ধরনের ভয়াবহ মাদকের (এনপিএস, এলএসডি) আবির্ভাব ঘটতে থাকে বাংলাদেশে। কতিপয় উচ্চবিত্তের মাধ্যমে তা দেশে বাজার তৈরির চেষ্টাও করছে অসাধু মাদক কারবারিরা। এতে দিনের পর দিন বাংলাদেশে বেড়েই চলছে মাদকের আগ্রাসন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেটের পর বাংলাদেশে আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) বাজার তৈরি করতে নানা পাঁয়তারা করছে মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা। এর সঙ্গে দেশি কারবারিরা অধিক লাভের আশায় ঝুঁকে পড়ছে এই অপকর্মে। যারা ইতোপূর্বে ইয়াবা কারবারে জড়িত ছিল তারাই আইস মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আইস মাদকের বাজার তৈরি করতে মিয়ানমারের সিন্ডিকেট বর্তমানে বাকিতে আইসের চালান পাঠাচ্ছে। কারবারিরা দেশে আইস মাদক বিক্রির টাকা হুন্ডি অথবা হাতে হাতে মিয়ানমারে পৌঁছে দিচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে যেভাবে আসছে আইস
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মাঝে নাফ নদী। মিয়ানমারের সিমকার্ড ব্যবহার করে মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগযোগ হয়। তারা চালানের পরিমাণ জানায়। এরপর রাতে মিয়ানমার থেকে বোটে করে কারবারিরা আইস মাদক নিয়ে নাফ নদী অথবা গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে। তাদের হাতে থাকে টর্চলাইট। এই পাশে কারবারিদের কাছেও থাকে টর্চলাইট। বোট থেকে টর্চের আলো জ্বালিয়ে সিগন্যাল আদান-প্রদান করে উভয় দেশের মাদক সিন্ডিকেট। সিগন্যালে মিলে গেলে তাদের মধ্যে চালান আদান-প্রদান হয়ে থাকে। কারবারিদের আগেই কোডিং করা থাকে। এই কারবার চলছে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার থেকে। শাহপরীর দ্বীপ, হাতিয়া হয়ে নৌ-পথ ব্যবহার করে মুন্সিগঞ্জ হয়ে ঢাকায় আইস আসছে। আবার হাতিয়া থেকে নৌপথে বরিশাল ও পটুয়াখালী পর্যন্ত যাচ্ছে আইস মাদক।

সম্প্রতি র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১৫ এর অভিযানে গত ২ মার্চ রাতে ঢাকার মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১২ কেজি আইসসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে বিপুল পরিমাণ আইস ছাড়াও ১ লাখ পিস ইয়াবা, ৪ হাজার ৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন, ২টি বিদেশি পিস্তল, ৯ রাউন্ড গোলাবারুদ, ২টি টর্চলাইট, ১ লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশি টাকা, ১ লাখ বার্মিজ মুদ্রা ও ৫টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

এই চক্রের মুলহোতা জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম (৩২)। তিনি লবণ ব্যবসার আড়ালে ভয়াবহ আইস মাদকের কারবার করে আসছিলেন। গ্রেফতার বাকিরা হলেন—মকসুদ মিয়া (২৯), রিয়াজ উদ্দিন (২৩), শাহিন আলম (২৮) ও সামছুল আলম (৩৫)। মিয়ানমার থেকে আইস ও ইয়াবা সংগ্রহ ছাড়াও জসিম রাজধানী থেকে চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন সংগ্রহ করে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন।

র‌্যাব বলছে, এই চক্রের মূলহোতা জসিম আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে সমুদ্র পথ ও নৌপথে ঢাকার মুন্সিগঞ্জে আইস মাদকের চালান নিয়ে আসতেন। আবার মিয়ানমার থেকে আইস ও ইয়াবা সংগ্রহ করে সোনাদিয়া হয়ে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় সেগুলো নানা কৌশলে পাঠাতেন। আইস মাদক সংগ্রহ, আনা ও সরবরাহের কাজে জসিমের নেতৃত্বে এই চক্রে আরও ১৪-১৫ জন সদস্য রয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে মিয়ানমারের মাদক চক্রের সদস্যরা এই চক্রের কাছে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করে। মাদকের চালান সমুদ্র থেকে স্থলে আনতে কম করে হলেও ২০/২৫ দিন সময় লাগতো। মালামাল গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে যেতেন। পরে ইয়াবা ও আইসের চালান সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়াতে আইস ও ইয়াবার চালান নিয়ে আসতো। হাতিয়া থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া/ঢাকার আশেপাশে অথবা সুবধিাজনক স্থানে আইস পৌঁছাতো চক্রটি।

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলানিউজকে বলেন, চক্রটির নেতা জসিম গত ৫-৭ বছর ধরে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। তিনি লবণ ব্যবসার আড়ালে আইসের কারবারে জড়িত। তিনি মিয়ানমারের মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রথমে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসতেন। সম্প্রতি রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছর থেকে আইসও নিয়ে আসা শুরু করেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উপঅঞ্চলের সহকারী পরিচালক (এডি) মেহেদী হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৯ সালে প্রথম বাংলাদেশে আইস মাদক পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রথম আইস তৈরির ল্যাবসহ আসামি গ্রেফতার করে। আমরা প্রতিনিয়ত আইস মাদকসহ অন্যান্য মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। আইস মাদক যাতে ইয়াবার মতো বিস্তার ঘটাতে না পারে, সেজন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ভয়াবহ মাদক আইস (ক্রিস্টাল মিথাইল অ্যামফিটামিন) ১০ থেকে ১২ বার সেবনে একজন মানুষের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে। স্মরণশক্তি, মনোযোগ হ্রাস পাওয়াসহ কলহ প্রবণতা ও আক্রমণাত্মক মনোভারের সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, আইস মাদক সেবনে বেড়ে যায় আত্মহত্যার প্রবণতাও। ইয়াবা ট্যাবলেট থেকেও ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী ও ক্ষতিকর আইস মাদক।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২২
এসজেএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।