ঢাকা, শনিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগ

সুমন কুমার রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২২
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগ

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগ দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে অধিকাংশ সড়ক নামেমাত্র সংস্কার করে (শতভাগ কাজ না করে) হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

আর এই টাকার ভাগ নিচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা।  

এমনই অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ঠিকাদার। আবার অনেক সময় বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ না করেই তুলে নেওয়া হচ্ছে বরাদ্দের সম্পূর্ণ টাকা।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মুহা. আলিউল হোসেন। অপরদিকে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য সিন্ডিকেটের কয়েকজন ঠিকাদার অনুরোধ জানিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেন।

অপরদিকে টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগে সাধারণ মানুষ বা পরিচিত কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয় না। এ কারণে সবসময় বন্ধ করে রাখা হয় প্রধান ফটক (গেট)।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মচারী জানান, ভেতরে প্রবেশ করতে হলে বড় স্যারের অনুমতি লাগবে। আর তা না হলে ভেতরে পরিচিত কোনো কর্মকর্তা আছে কি না তার নাম বললে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশলী মুহা. আলিউল হোসেন টাঙ্গাইলে যোগদান করেই কয়েকজন ঠিকাদার নিয়ে গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য নির্বাহী প্রকৌশলীর বন্ধু মিঠু, ঘনিষ্ট সহযোগী মো. আব্দুল আজিজ, সুমন ও মনোজ। আর এদের দিয়েই চলে পুরো জেলার সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন উন্নয়নের কাজ। এজন্য তারা বেছে নিয়েছেন নওগাঁর আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স। বিনিময়ে তাকে দেওয়া হয় দুই শতাংশ টাকা।

সম্প্রতি বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের জন্য ৩০ লাখ টাকার কাজ পান নির্বাহী প্রকৌশলীর ঘনিষ্ট বন্ধু মাস্ক লিমিটেডের স্বত্ত্বাধিকারী মিঠু নামের এক ঠিকাদার। তিনি ৪২ শতাংশ নিম্ন দরে কাজটি হাতিয়ে নেন। কাজ পাওয়ার প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো নির্মাণসমাগ্রী তিনি সরবরাহ করেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী নিজে ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেডের লাইসেন্সটি দুই শতাংশ টাকার বিনিময়ে ভাড়া নিয়ে নিজেরাই অংশগ্রহণ করেন। এরপর পছন্দমত ঠিকাদারদের কাছে লাইসেন্সে পাওয়া কাজগুলো বিক্রি করেন ৫ থেকে ৭ শতাংশ টাকায়। পরবর্তীতে ওই ঠিকাদারদের সঙ্গে আঁতাত করে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কাজ করে শতভাগ কাজ দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয় পুরো টাকাই। পরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কার্যালয়েই সন্ধ্যার পর কাজ করা ঠিকাদারকে নিয়ে আলোচনায় বসেন লাভের টাকা ভাগবাটোয়ারার জন্য। এরপর সিন্ডিকেটের সদস্যরা লাভের অর্ধেক টাকা রেখে বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে দেন ওই ঠিকাদারকে।

আরেক ঠিকাদার জানান, শতভাগ কাজ না করায় সড়ক নির্মাণ বা সংস্কার কাজ টেকসই হচ্ছে না। অল্প দিনের মধ্যেই সেইসব সড়কগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কাজ পাওয়ার পর এবং সেই কাজ শুরুর আগেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিতে হয় সাড়ে চার শতাংশ টাকা। এরপর আরও অন্যান্য খরচ। এ কারণে বেশি লাভের আশায় কিছু ঠিকাদার ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ নিচ্ছেন। এতে করে তিনিও লাভবান হচ্ছেন, আবার কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেটের সদস্যরাও বাড়তি টাকা পাচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা থেকে ভুঞাপুর হয়ে গোবিন্দাসি পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার সড়কের কাজ পান একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে সেই কাজটি কিনে নেন এমদাদুল হক সুমন। এরপর তিনি কাজটি শুরু করেন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকেই সড়কটির বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ সৃষ্টি হতে থাকে। বর্তমানে সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ভুঞাপুর, গোপালপুর, বাউসি, সখীপুর, দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, মির্জাপুর উপজেলার ওয়ার্শী ও মধুপুরেও একইভাবে কাগজে কলমে কাজ করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড। তবে এ সব কাজের তদারকিতে ছিলেন ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

অপরদিকে আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে পাওয়া মধুপুরে ড্রেন নির্মাণের কাজ করছেন মনোজ নামের ঠিকাদার। তবে তিনি এই কাজটি সাড়ে ৭ শতাংশ টাকায় নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া মির্জাপুরের গোড়াই-সখীপুর সড়কের কাজ পান একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা কাজ না করে সেই কাজের তদারকি করেন সিন্ডিকেটের সদস্য আব্দুল আজিজ। তবে ওই সড়কের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কাজ করেই বরাদ্দের পুরো টাকাই উত্তোলন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা।

ঠিকাদার মনোজ জানান, টাকা লাগলে নেন, কিন্তু আমাদের ক্ষতি করে লাভ কি। এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সটি আর আমরা পাবো না। তাই মীমাংসার প্রস্তাব দেন ওই ঠিকাদার।

সিন্ডিকেটের সদস্য ঠিকাদার এমদাদুল হক সুমন জানান, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করাই ভাল। তা না হলে ওই লাইসেন্সটি আর পাওয়া যাবে না। এজন্য সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান তিনি।

সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য মিঠু জানান, ৪২ শতাংশ নিম্ন দরে সরবরাহের কাজটি তিনি পেয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত তিনি কাজটি শুরু করেননি। তবে বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন।

আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মকর্তা মো. মুন্নাফ বাংলানিউজকে জানান, তারা সারা বাংলাদেশেই কাজ করেন। আর কাজ পেয়ে তা বিক্রি করেন না, নিজেরাই করেন। তবে অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং অফিসের কেউ লাইসেন্স চায়, এজন্য লাইসেন্স দিয়ে তাদের সহযোগিতা করেন। টাঙ্গাইলেও এমনই হয়েছে। তবে তিনি বা তার প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ টাঙ্গাইলে কোনো কাজের খোঁজ নেননি কারণ তিনি নওগাঁয় থাকেন। এতদূর যাওয়া সম্ভব হয় না। এজন্য এই লাইসেন্সটির বেশিরভাগ কাজ এমদাদুল হক সুমন, আব্দুল আজিজ, মিঠু ও মনোজই করে থাকেন। তবে তার লাইসেন্সটি নির্বাহী প্রকৌশলী নেন কি না এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহা. আলিউল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তিনি কোনো কাজ বিক্রি বা কারো লাইসেন্স নেন না। আর যে প্রতিষ্ঠান কাজ পায় সেই প্রতিষ্ঠানের লোকজনই কাজ করে থাকেন। এতে তার কোনো হাত বা সংশ্লিষ্টতা নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪,২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।