ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণার নয়া কৌশল: সন্তান ‘অপকর্ম’ করেছে টাকা দিন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০২২
পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণার নয়া কৌশল: সন্তান ‘অপকর্ম’ করেছে টাকা দিন প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার আলামিন ও শরীফুল

ঢাকা : দিন যত আধুনিকতার দিকে যাচ্ছে, প্রতারণার পন্থাও নতুন হচ্ছে। নয়া এ মাধ্যম পরিচালিত হয় মোবাইলে ফোনে।

সাধারণ কোনো এক ব্যক্তিকে তার সন্তানের অপকর্মের কথা জানিয়ে একটি চক্র লাখ লাখ টাকা লুট করে আসছিল। তাদের গ্রেফতার করেছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্যরা।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- আলামিন ওরফে আমীন ওরফে বিনিয়ামিন ও শরীফুল ইসলাম। মোবাইল ফোনে তারা কাউকে নির্দিষ্ট করতেন। পুলিশ পরিচয়ে দিয়ে বলতেন, আপনার সন্তান অপকর্ম করেছে। টাকা দিন।

কারও সন্তান ছেলে হলে চক্রেরা সদস্যরা বলতেন, তিনি মাদকসহ ধরা পড়েছেন; মেয়ে হলে বলা হতো অসামাজিক কাজে ধরা পড়েছে। তাৎক্ষণিক লাখ টাকা পাঠানো না হলে কারাগারে পাঠানো হবে বলেও হুমকি দেওয়া হতো। উপায়ান্তর না পেয়ে, যাচাই-বাছাই ছাড়াই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দাবীকৃত টাকা পাঠিয়ে দিতেন অভিভাবকরা।

এমন অনেকেই আছেন, তারা জানতেনই আদৌ তার ছেলে বা মেয়ে কোনো অপকর্ম করেছিল কিনা। ডিবি পরিচয়েও আলামিন ও শরীফুল ইসলাম এমন প্রতারণা করতেন। দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম চালিয়ে আসা এ দুজন এখন পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। শুক্রবার থাকতো তাদের ডে-অফ। বাকি ছয় দিনের প্রতিদিনই দেড় থেকে দুই লাখ টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিতেন তারা।

নির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে চক্রের মূল হোতা আলামিন ও তার সহযোগী শরীফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি ম্যাগাজিনযুক্ত পিস্তল, ১ রাউন্ড গুলি, ১০০ বোতল ফেন্সিডিল, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ২টি মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা জব্দ করা হয়েছে।

শুক্রবার (১৯ আগস্ট) তাদেরকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডিবি গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ভুয়া ডিবির পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে ঢাকার বিভিন্ন থানায় একাধিক জিডি ও মামলা হয়েছে। বিষয়গুলো তদন্তের ধারাবাহিকতায় এ চক্রের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।

প্রতারণার অর্থে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ৫ তলা ফাউন্ডেশনের দুটি ভবন ও ১০ বিঘা জমির উপরে মাছের ফিসারিজ তৈরি করেছেন আলামিন। তার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ ও ঢাকার বিভিন্ন থানায় অস্ত্রসহ মোট ৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিসি মশিউর বলেন, এই প্রতারক তার নির্মাণাধীন পাঁচ তলা ভবনের আশেপাশের খেজুর, নারকেল গাছ ও কাঁঠাল গাছে ১৭টি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। যাতে তিনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাংবাদিকদের গতিবিধি দেখে পালিয়ে যেতে পারেন। এ কারণে দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না।

সন্তান ‘অপকর্ম’ করেছে টাকা দিন
আলামিনদের মূল টার্গেট ছিল ভিআইপি মোবাইল নম্বরধারীরা। দেশে প্রিপেইড-পোস্টপেইড যুগ শুরুর সময় থেকে যারা একই নম্বর ব্যবহার করে আসছেন, বা বড় ব্যবসায় করেন; তাদের নম্বর যোগাড় করতেন তারা। পরে নম্বরগুলোয় থাকা হোয়াটসঅ্যাপে বা ফেসবুক থেকে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতেন। এরপর আলামিন ফোন করে নিজেকে ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার পরিচয় দিয়ে নম্বরধারীর ছেলে বা মেয়ে অপকর্মের দায়ে আটক করা হয়েছে বলে জানাতেন।

ছেলে হলে মাদক বা ইয়াবা, মেয়ে হলে যৌন বা অসামাজিক কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে বলে তথ্য দিত চক্রের সদস্যরা। তাদের ছাড়িয়ে নিতে হলে বিকাশ বা নগদ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক লাখ টাকা পাঠিয়ে দিতে বলতেন চক্রের সদস্যরা। এ ছাড়া আটকের পর মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট বড় অংকের জরিমানা করছেন, টাকা দিন; নয়ত আপনার ছেলে/মেয়েকে কোর্টে চালান করে দেওয়া হবে বলেও জানাতেন তারা। মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় গণধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হতো।

এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন ভুক্তভোগীরা। দ্রুত বিকাশ বা নগদে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। ছেলে/মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে দূর থেকে আব্বু-আব্বু/আম্মু-আম্মু বলে চিৎকার করতেন চক্রের সদস্যরাই।

নির্ধারিত টাকা পাওয়ার পর আলামিক ভুক্তভোগীকে আবার কল করতেন। বলতেন, সাংবাদিকরা ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছে। তাদের ম্যানেজ করতে হবে। আরও টাকা লাগবে। তাদের কথায় রাজি না হয়ে পার পেতেন না ভুক্তভোগীরা।

নিজ এলাকায় অস্ত্র দেখিয়ে সাধারণ মানুষে আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগও আছে আলামিনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন অবৈধ কাজে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেন বলেও জানা গেছে।

প্রতারণা অর্থ পকেটে ঢোকে যেভাবে
গ্রেফতার শরীফুল ইসলাম ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে মোবাইল সিম ও ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট-পার্সোনাল নম্বর সংগ্রহ করে আলামিনকে দিতেন। তিনি নম্বরগুলো ভুক্তভোগীর কাছে পাঠাতেন। যেখানে প্রতারণার অর্থ যোগ হতে থাকতো। শরীফুল ইসলাম বিভিন্ন এজেন্ট থেকে টাকা তুলে আলামিনকে দিতেন।

শুক্রবার ডে অফ ছাড়া তাদের পকেটে প্রতিদিন দেড় থেকে ২ লাখ টাকা ঢুকতো। আলামিনের মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর যাচাই করে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্রেফতারের পর আলামিন ও শরীফুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়। ডিসি মশিউর রহমান বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এমন ফোন পেলে ক্রসচেকের পরামর্শ পুলিশের
ডিবির ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা বলেন, কোনো অভিভাবকের কাছে অপরিচিত নম্বর থেকে ডিবি, পুলিশ, র‍্যাব অথবা যেকোনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে ফোন আসলে তাৎক্ষণিক পুলিশকে জানান। সন্তান মাদকসহ ধরা পড়েছে, বন্ধু/বান্ধবীসহ ধরা পড়েছে, কান্না জড়িত কণ্ঠে কোনো ব্যক্তির অনুরোধ আসলে আগে সন্তান-সন্ততির সঙ্গে যোগাযোগ করতেও পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০১০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০২২
পিএম/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।