ঢাকা, সোমবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ভয়াল ১২ নভেম্বর, আজো আঁৎকে ওঠেন উপকূলের মানুষ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
ভয়াল ১২ নভেম্বর, আজো আঁৎকে ওঠেন  উপকূলের মানুষ

লক্ষ্মীপুর: পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের উপকূলে সংঘঠিত হওয়া ভয়াবহ ঝড় ‘সাইক্লোন ভোলা’। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ঝড়টি বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় কয়েক জেলায় আঘাত হানে।

ঝড়ে লক্ষ্মীপুরের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসল, গবাদিপশু ও মানুষের সম্পদ।  

ওই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত, স্বজন হারানো এবং প্রত্যক্ষদর্শী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার উপকূলীয় কয়েকজন বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে মিতালী ক্লাব নামের একটি সামাজিক সংগঠন ঝড়ের পর উদ্ধার, ত্রাণ কাজ, ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় এবং বিদেশি সাংবাদিকদের তথ্য দানের জন্য চালু করেছিল ‘মিতালী ইনফরমেশন সেন্টার’। সেই সেন্টারের পরিচালক ছিলেন, বর্তমান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপ-এর নির্বাহী পরিচালক এএইচএম নোমান।

নোমান গণমাধ্যমকে জানান, তৎকালীন নোয়াখালীর উপকূলীয় জেলায় ঝড় আঘাত হানে। বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ছিল তার একটি। রামগতির (রামগতি-কমলনগর) চর আবদুল্লাহ, বড়খেরী, চরগাজী, চর রমিজ, চর আলগী, চর কাদিরা, চর বাদাম, চর ফলকন, চর কালকিনি ইউনিয়নে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর জরিপ তারা ওই ক্লাবের উদ্যোগে করেছিলেন। তিনি জানান, ঝড়ে সকল এলাকা ১০ থেকে ২০ ফুট পানিতে পুরো তলিয়ে যায়। স্রোতে ভেসে যায় সম্পদসহ হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষ।

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটি সিপিপির রামগতি উপজেলা টিম লিডার মো. মাইন উদ্দিন খোকন জানান, চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষই মারা গিয়েছিল। সে ইউনিয়নে শূন্য থেকে ১৫-১৬ বছর বয়সি কেউ বেঁচে ছিল না। এছাড়া বড়খেরী, চর বাদাম, চর সীতা এবং চর কাদিরা ইউনিয়নের অর্ধেক মানুষ মারা গিয়েছে ভয়াল সেই ঘূর্ণিঝড়ে।  

প্রস্তুতি কমিটি সিপিপির কমলনগর উপজেলা টিম লিডার মো. শামছুদ্দোহা খোকন জানান, ঝড়ে তার আত্মীয় স্বজনের অনেকেই মারা যায়। তার বাবা গোলাম মোস্তফা মিয়াকে ১৫ দিন পর বরিশালের একটি খালে জীবিত ভাসতে দেখে স্থানীয়রা উদ্ধার করে। মোস্তফা মিয়া রেড ক্রসের সদস্য ছিলেন।  

ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গবন্ধুর গঠিত ত্রাণ কমিটির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান কমলনগরের হাজী নুরুল ইসলাম জানান, ঝড় থেমে যাওয়ার পর চারিদিকে পড়েছিল শুধু লাশ আর লাশ। লাশের গন্ধে মানুষ কাছে যেতে পারেনি। ২০ ফুটের জলোচ্ছ্বাসের পানির কারণে কয়েক দিন পর্যন্ত মাটি দেওয়া যায়নি মৃত মানুষগুলোকে। পরে গণকবরে অনেককে দাফন করা হয়। অনেকের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সাইক্লোন ভোলার মৃতদেহ উদ্ধার কর্মী মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার মফিজ উল্লাহ জানান, ১২ নভেম্বরের পর কত মৃতদেহ উদ্ধার ও দাফন করেছি তার হিসাবে নেই। এতবড় প্রাণহানি এবং ধ্বংসযজ্ঞের পরেও কোন সরকারই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এদিনকে স্মরণের কোনো উদ্যোগ নেই।

তিনি আরও জানায়, ঝড়ের ২য় দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাতিয়া হয়ে রামগতি এসেছিলেন। সে সময় তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য সিরাজুল ইসলামের জিপে চড়ে বর্তমান কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ পর্যন্ত এসে আবার রামগতি ফিরে ভোলায় যান।  

একটি মাত্র ঝড়ে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার পরেও গত ৫২ বছরে তাদেরকে স্মরণের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ না থাকায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে উপকূলীয় লক্ষ্মীপুরের সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজ। তবে রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগ না থাকলেও বিভিন্ন সময় অনেক সংগঠনের উদ্যোগে ১২ নভেম্বরকে স্মরণ করা হয়।  

এদের মধ্যে উপকূলে কর্মরত সাংবাদিকদের কোস্টাল জার্নালিষ্ট নেটওয়ার্ক নামের একটি সংগঠন ২০১৭ সাল থেকে এদিনকে উপকূল দিবস ঘোষণা দিয়ে ১৯ জেলায় তা পালন শুরু করেছে।  

কোস্টাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু এ বছর বিশ্বের ১শ প্রভাবশালী জলবায়ু যোদ্ধার তালিকায় তার নাম এসেছে।  

তিনি জানান, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ধ্বংসযজ্ঞকে কেন্দ্র করে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস থাকলে উপকূলবাসীর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে সচেতনতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।  

১১ নভেম্বর এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই ১২ নভেম্বর উপকূলে আঘাত হানে ‘ভোলা সাইক্লোন’।

জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। একটি এলাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারানোর ঘটনা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
এসআইএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।