খুলনা: ভূত! শুনেই গা ছমছম করে। অশুভ প্রেতাত্মা কিংবা ভূত যাই বলেন না কেন, কেউ ভূতে বিশ্বাস করে, কেউ আবার খুব জোরের সঙ্গে বলে ভূত বলে কিছু নেই।
ভূতে বিশ্বাস থাকুক বা না থাকুক, ভূতের কল্পনা করে ভয় আমরা সবাই কম-বেশি পাই। গল্পের বইতে ভূতের বাড়ির কথা পড়ে শিহরিত হই। ভূতের বাড়ি কি কেবল কল্পনাতেই আছে? একদম নয়! পৃথিবী জুড়ে আছে ভয়ঙ্কর সব ভূতের বাড়ির গল্প। সেগুলোর অন্তরালে আছে ভয়ানক গা শিউরে উঠা সব কাহিনী। আসুন, আজ শোনা যাক সেরকমই ভূতের বাড়ির গল্প। আর এ গল্পটি খুলনা মহানগরীর একটি ভূতের বাড়ির গল্প।
খুলনার ভূতের বাড়িটির অবস্থান:
খুলনা শহরের খানজাহান আলী রোডের টুটপাড়া কবরস্থানের পাশে বাহাদুর লেনে এ বাড়ির অবস্থান। ভূতের বাড়িটি আসলে এখন আনসার ও ভিডিপি কমান্ড্যান্টের কার্যালয়। তাই চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে নিরাপত্তায় ঘেরা।
ভূতের বাড়ির ইতিহাস:
খুলনার ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক এ এইচ এম জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, কুখ্যাতর দিক দিয়ে ভুতের বাড়িটি এক নম্বরে রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয় তার যাত্রা শুরু হয় এ বাড়ি থেকে। আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ও পাকিস্তান আমলে পিরোজপুরের সংসদ সদস্য মাওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে এটা গঠন করা হয়। রাজাকার নামটিও তার দেওয়া। এটাই একাত্তরের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প। বর্তমানে আনসার ও ভিডিপি কমান্ডারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাড়িটি। এ বাড়ির ইতিহাস নিয়ে নানারকম জনশ্রুতিও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ বাড়িতে নয়টি নির্যাতন সেল তৈরি করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে আনসার ও ভিডিপি কমান্ড্যান্টের কার্যালয়ের সীমানার বাইরে খুলনায় একাত্তরের প্রথম রাজাকার ক্যাম্পের পরিচিতিমূলক ফলক স্থাপন করা হয়।
এছাড়া জনশ্রুতি রয়েছে, নাটোরের দীঘাপতিয়া রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারাম ১৭১৪ সালে খুলনা ও যশোরের অনেক জমি দখল করেন। আর রাজা দয়ারামের বোনের মেয়ে ছিলেন শীলা। শীলা খুবই সুন্দরী ছিলেন। তার মামা বাড়িতে অবস্থানকালে রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত যাত্রা দেখতে গিয়ে অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েন নিশিকান্ত নামে এক যাত্রাশিল্পী। গোপনে তারা অভিসারে বের হতেন। এমনই চলতে থাকে। একদিন তারা পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান দয়ারামের কর্মচারীর কাছে। বিষয়টি জানাজানি হলে দায়ারাম শীলাকে বিয়ে দেন নিধুরাম নামে এক যুবকের সঙ্গে। একপর্যায় তাদের খুলনায় পাঠিয়ে দেন এবং আশ্রয় হয় এই বাড়িতে। শীলা এ বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। নিধুরামকে কখনও স্পর্শও করতে দেননি। একসময়ে শীলা আত্মহত্যা করেন। একই সময় নিধুরামও। সেই থেকে কখনও নারীকণ্ঠে হাসির শব্দ, আবার কখনও ছায়ামূর্তি দেখা যায় এ বাড়িতে। আর এখান থেকেই ভৌতিক গল্পের শুরু।
আবার কারও কারও মতে, বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন জনৈক দীননাথ সিংহ। তিনি ছিলেন কুখ্যাত নীলকর উইলিয়াম রেনির অন্যতম সহযোগী। পাকিস্তান আমলে জনৈক মোক্তার এ বাড়িতে বসবাস করতে আসেন। তার এক ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাড়িতে মারা যান। এরপর গোলাম জব্বার নামে এক ডাক্তার এ বাড়িতে বাস করতে এলে তার এক চাকরও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সাধারণ লোকজনের ধারণা, এগুলো সব নাকি ভূতের কাজ। এ বাড়িটিতে এতো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে ভবনটি ভীতিকর ও রহস্যময়।
ভূতের বাড়ি দেখতে যেমন:
একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে টিকে থাকা জল্লাদখানা ‘ভূতের বাড়ি’র অবস্থা এখন বেশ শোচনীয়। দীর্ঘদিন কোনও সংস্কার না হওয়ায় এটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শত শত বছরের প্রাচীন ভূতের বাড়ির এ ভবনে দীর্ঘদিন থেকে বেড়ে উঠছে বিশাল বিশাল বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের শিকড় বড় হয়ে দেয়ালে ফাটল ধরাচ্ছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে ভবনটি। ভগ্ন পরিত্যক্ত কোলাহলমুক্ত বাড়িটিতে প্রবেশ করলেই যে কারও গা ছমছম করবে। অনেকটা বন-জঙ্গল পরিপূর্ণ ভৌতিক পরিবেশ। ইট সুরকির দালান থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। কোথাও কোথাও খসে পড়েছে দেয়ালের ইটও। ভগ্ন দশাগ্রস্ত, ভবনটিতে এখন আরও কেউ বাস করে না।
ভূতের উপদ্রব আছে কিনা:
এই ডিজিটাল যুগে ভূতপ্রেত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। অথচ লোকমুখে এ বাড়িটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ভূতের বাড়ি নামে পরিচিত।
এখানে বসবাসকারী আনসার ক্যাম্পের সদস্যরা জানান, তারা কখনো ভূত দেখেননি। তবে তাদের অনেকের একটু ভয় হয় ভবনের মধ্যে উঠতে। বিশেষ করে রাতের বেলায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
এমআরএম/আরআইএস