ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া প্রস্তুত

ইসমাইল হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া প্রস্তুত

ঢাকা: পরিকল্পিত ও আধুনিক নগর স্থাপন, নগরের ভূ প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা, অপরিকল্পিত নগরায়ন রোধ করা, তথ্যপ্রযুক্তি ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং উন্নতর নাগরিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে `রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২'  এর খসড়া প্রণয়ন করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

খসড়া আইনের অধীনে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন এবং তার কার্যাবলি উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ এবং আইন লঙ্ঘনে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সালে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে রংপুরসহ তিন সিটির জন্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  

সেই সময়কার সার-সংক্ষেপে বলা হয়, সিলেট, রংপুর ও বরিশাল জেলা শহর এবং সংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করছে। মূলত পরিবেশ-সংকটপূর্ণ এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্প বাস্তবায়ন, অপরিকল্পিতভাবে হোটেল/মোটেল, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ, বহুতল ভবন নির্মাণ, বিশেষত বেসরকারি পর্যায়ে অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার যেমন- হ্যাচারি নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ ইত্যাদি এ সমস্যার মূল কারণ। স্থানীয় পৌরসভা বেসরকারি পর্যায়ে নির্মিত ভবনের নকশা অনুমোদনসহ অন্যান্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। অথচ বহুতল বিশিষ্ট ইমারত বা নগরীর সৌন্দর্য রক্ষা করে নগর বিকাশের কোনো ধারণা বা কারিগরি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জনবল এসব পৌরসভার নেই। সম্ভাবনাময় ও বিকাশমান এ ধরনের পর্যটন অঞ্চলে অপরিকল্পিত উন্নয়ন সংঘটনের পর পরবর্তী সময়ে সংশোধনযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে এলাকার রাজনৈতিক নেতারা, স্থানীয় প্রশাসন, সুশীল সমাজসহ সচেতন নাগরিক সমাজ বিভিন্ন সময়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায়ও এর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এসব উদ্বেগ ও প্রকাশিত সংবাদের যথার্থতা রয়েছে। তাই জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে সিলেট, রংপুর ও বরিশাল এলাকার ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে যুক্তিসংগতভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সিলেট, রংপুর ও বরিশাল জেলায় উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা জরুরি। এ প্রেক্ষাপটে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ইত্যাদি মহানগরীর জন্য গঠিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুরূপভাবে সিলেট, রংপুর ও বরিশালকে আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে উন্নয়ন ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা অপরিহার্য।  

দীর্ঘ দিন পর এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া তৈরির পর সম্প্রতি তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এখন তা মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকা এবং সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংলগ্ন এলাকায় প্রযোজ্য হবে।  

আইন কার্যকর হওয়ার পর সরকার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করবে। নির্ধারিত তারিখ থেকে তা কার্যকর হবে। কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় সিটি করপোরেশন এলাকায় হবে।

কর্তৃপক্ষে কারা থাকছেন?

একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সরকার প্রেষণে নিয়োগকৃত চারজন সার্বক্ষণিক সদস্য, সরকার মনোনীত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রতিনিধি।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় মনোনীত উপসচিব পদমর্যাদার একজন করে প্রতিনিধি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় মনোনীত গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি।

পুলিশ কমিশনার মনোনীত উপপুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থাপত্য অধিদপ্তর মনোনীত নির্বাহী স্থপতি পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকায় বসবাসরত সরকার মনোনীত তিনজন বিশিষ্ট নাগরিক (একজন নারী), রংপুর শিল্প ও বণিক সমিতির একজন প্রতিনিধি, রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাদের মেয়াদ তিন বছর।

কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলি:

ভূমির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; ভূমি সংক্রান্ত জরিপ, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা ও গবেষণা; ভূমির ওপর যে কোনো প্রকৃতির অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় পর্যটন মহাপরিকল্পনায় প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণপূর্বক আধুনিক ও আকর্ষণীয় পর্যটন অঞ্চল ও নগর পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যাবলি গ্রহণ; সড়ক, মহাসড়ক, নৌপথ, রেলপথ নির্মাণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন; কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে বিধিবহির্ভূত স্থাপনা অপসারণ; অপরিকল্পিত, অপ্রশস্ত ও ঘনবসতি অপসারণক্রমে নূতন আবাসন প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং উক্ত এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; নিম্নবিত্ত, বস্তিবাসী এবং গৃহহীনদের আবাসন সমস্যার অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও উহার বাস্তবায়ন; উন্নয়ন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এরূপ কোনো এলাকার জন্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি এবং উক্ত এলাকার ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন বা কোনো ইমারত বা স্থাপনার পরিবর্তনের ওপর অনধিক এক বছর পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ; প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে পর্যাপ্তসংখ্যক বনায়ন ও সবুজ বেষ্টনী তৈরি ও সংরক্ষণ; কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে দেশি-বিদেশি বা অন্য কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পরামর্শ বা সহযোগিতা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; দেশি অথবা বিদেশি ব্যক্তি, সরকারি বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

এছাড়া, আধুনিক নগর-সংক্রান্ত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপের আয়োজন; টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন, ভূমিকম্প ও দুর্যোগ-সহনশীল প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নগরায়ণ, পরিবেশ উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ, কার্বন নিঃসারণ কমানো, খাল ও নালা নর্দমার উন্নয়ন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থাকরণ এবং যেকোনো পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ-সংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভূমি ব্যবহারের ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরি; কৃষি-ভূমি, বনভূমি, নিম্নভূমি, জলাভূমি এবং ভূমিকম্প ও পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণসহ ২২ দফা কার্যাবলি।

মহাপরিকল্পনা পরিপন্থি ভূমি ব্যবহারের দণ্ড:

যদি কোনো ব্যক্তি মহাপরিকল্পনা অধীন অনুমতি ছাড়া অন্য কেনো উদ্দেশ্যে ভূমি ব্যবহার করেন তাহলে অপরাধ স্বরূপ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ইমারত নির্মাণ, জলাধার খনন, চালা অথবা উঁচু ভূমি ইত্যাদি বিষয়ে বিধিনিষেধ: কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকার মধ্যে অনুমতি ছাড়া কোনো ইমারত নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ, পুকুর বা কৃত্রিম জলাধার খনন বা পুনঃখনন কিংবা চালা বা উঁচু ভূমি কাটা যাবে না। যদি কোনো ব্যক্তি এই ধারার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেন তাহলে তার দুই বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

কৃত্রিম জলাধার খনন, টিলা কাটা স্থগিতকরণ: কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে কোনো কৃত্রিম জলাধারের খননকাজ বা টিলা কাটার কাজ স্থগিত বা বন্ধ করতে মালিককে নির্দেশ দিতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি তা লঙ্ঘন করলে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তীতে একই অপরাধের জন্য কমপক্ষে দুই বছর এবং অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা কমপক্ষে দুই লাখ এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।  

নিচু ভূমি ভরাট বা প্রাকৃতিক জলাধারের পানি প্রবাহে বাধাদানে বিধিনিষেধ: কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো এলাকার নিচু ভূমি ভরাট বা প্রাকৃতিক জলাধারের পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত বা কোনো নদ-নদী,  খাল-বিল, জলাশয়, পুকুর, ডোবা, প্রাকৃতিক জলাধারের পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি তা লঙ্ঘন করলে প্রথমবার অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে এবং প্রতিবার অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই বছর, অনধিক ১০ বছর বা কমপক্ষে দুই লাখ টাকা এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
এমআইএইচ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।