ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কুক্ষিগত ক্যাম্পাসে মুক্ত জ্ঞানচর্চা হয় না

হারুন-অর-রশিদ ও কামরান সিদ্দিকী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১২
কুক্ষিগত ক্যাম্পাসে মুক্ত জ্ঞানচর্চা হয় না

আলোকিত মানুষ গড়ে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে সচ্ছল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। কোটি কোটি বাঙালিকে পরিচালিত করার জন্য যারা নিয়োজিত, তারা দেশের কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।

নেতৃত্ব নাজিল হয় না বা কাউকে হঠাৎ নেতা বানিয়ে পাঠানো হয় না। একটা পরিবেশে চর্চার মাধ্যমে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা সেই চর্চারই প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহীসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় আজ নেতৃত্ব ধ্বংসের কারখানায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা জিম্মি হয়ে পড়েছে বিশেষ অঞ্চলের হাতে, বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে। যার ফলে সব ক্যাম্পাসে এখন নানা দাবি নিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছেন। কেউ খুন, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি ঠেকাতে, কেউ নিজের অধিকার আদায় করতে, কেউবা গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন করছেন। দীর্ঘদিন স্বৈরাচারী শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই ক্যাম্পাসেেএতো আন্দোলন-- এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্প্রতি যে স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার নেপথ্য কারণ সচেতন মানুষমাত্রেরই বুঝতে পারার কথা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক নির্বাচনের ব্যবস্থা না থাকায় স্বৈরাচারী একনায়কের মতো আচরণ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একজন অনির্বাচিত উপাচার্য কিভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখেন, তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গত তিন বছরের দৃশ্যপট সামনে নিয়ে এলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান উপাচার্যকে রাষ্ট্রপতি অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেন। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়োগ পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং পদ ধরে রাখতে একটি অনুগত শিক্ষক সম্প্রদায় তৈরিতে শুরু থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিন বছরে দলীয়, আঞ্চলিকতা ও আত্মীয় কোটায় তিনি প্রায় দুইশ’ শিক্ষক নিয়োগ দেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বয়স ৪১ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ বছরে প্রায় ৩৪০ শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও গত তিন বছরে নিয়োগ পেয়েছেন ১৯৩ জন। বিগত তিনটি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগের দিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ায় বিষয়টি দৃষ্টিকটুভাবে সামনে চলে আসে। বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ, কর্মঘণ্টা অনুযায়ী অপ্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, অপেক্ষাকৃত যোগ্যপ্রার্থীকে বাদ দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে। সর্বশেষ গণিত বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে উপাচার্য যে ‘টম অ্যান্ড জেরি’ খেলা দেখালেন, তা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বিবেকবান মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে।

ক্যাম্পাসে নিজের আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে তিনি ছাত্রলীগের মধ্যেও নিজের অনুসারী একটি গ্রুপ তৈরি করে নিয়েছেন, যারা ভিসিলীগ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ভিসিলীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রঘোষিত গ্রুপের সংঘর্ষে একাধিকবার ক্যাম্পাস রক্তাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি ভিসিলীগের কর্মীদের হাতে নিহত হন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমদ। উপাচার্য তার অপছন্দের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপকে বের করে দিয়ে ভিসিলীগ দিয়ে এখনো ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করছেন। গত ১৭ মার্চ ভিসি তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের থামাতে সেই ভিসিলীগকেই নির্দেশ দিয়েছেন। একজন
উপাচার্য কতটুকু স্বৈরাচারী হলে গডফাদারের মতো একটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে লালন করতে পারেন, তা ভাবতেই লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয়।

শুধু এগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের একটি অপচেষ্টা আমরা গত তিন বছর লক্ষ্য করেছি। বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী দুটি লেকে ১৯৮৫ সালের পর এই প্রথম অতিথি পাখির দেখা মেলেনি। ফোটেনি জাতীয় ফুল শাপলা। কারণ হিসেবে লেকগুলোতে মাছ চাষের জন্য অতিমাত্রায় চুন ব্যবহারকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঝোপঝাঁড় পরিষ্কার করে হলুদচাষের জন্য লিজ দিয়ে ১১০ প্রজাতির প্রজাপতি ও বিভিন্ন পতঙ্গের আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে।

ক্যাম্পাসে ভিসিপন্থি ছাত্রলীগের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চাই। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থী বরাদ্দকৃত নিজের কক্ষে অবস্থান করার সুযোগ পাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। হলের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে না দিয়ে কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য বা কাউকে স্বাগত জানানোর জন্য মিছিল করতে বাধ্য করা আমাদের প্রত্যাশিত নয়। সম্প্রতি ক্রিকেট  খেলায় শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করে বাংলাদেশ এশিয়া কাপে ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীরাও ক্যাম্পাসে আনন্দমিছিল বের করে। কিন্তু তারা উচ্ছৃঙ্খল ভিসিপন্থি ছাত্রলীগের অযাচিত আচরণে হলে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আমরা কখনো এ আচরণ প্রত্যাশা করি না। শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থী হিসেবে নিরপেক্ষ স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি কামনা করাটাই স্বাভাবিক চাহিদা।

এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কেন একজন উপাচার্য শিক্ষক হয়েও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগে এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, মানুষ গড়ার কারিগর হয়েও গডফাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন? কারণ অনির্বাচিত অবস্থায় তাকে কোনো না কোনো খুঁটি ধরে টিকে থাকতে হবে। শিক্ষক সমিতি, ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেট প্রভৃতি নির্বাচনে নিজ পছন্দের লোকদের জিতিয়ে এনে প্রতিবাদহীন স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠা করতেই যোগ্যতার তোয়াক্কা না করে গণনিয়োগ দেওয়া হয়।

ছাত্রদের মধ্য থেকে নায্য বিষয়গুলোতে যাতে কোনো প্রতিবাদ না হয়, সেজন্য নিজেই ছাত্ররাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান এবং নিজস্ব গ্রুপ তৈরি করেন। পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে এসব গ্রুপকে টেন্ডারবাজির ভাগ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবে আশার কথা হলো, অতীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন অনির্বাচিত উপাচার্যের কেউই টিকে থাকতে পারেননি। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পদচ্যুত করেছিলেন। বর্তমান উপাচার্য গত ৩ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে যে অনিয়মের রাজত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার বিরুদ্ধে সকল মতাদর্শের শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেছেন। তার পতন আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষকদের নীরব সমর্থন গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষদের আশাবাদী করে তুলেছে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিকভাবে সিনেট, সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতি ও উপাচার্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ছাত্র সংসদগুলোকে কার্যকর করে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি তৈরির ব্যবস্থা আবার চালু করা চাই। তাহলে যেমন আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরি হবে তেমনি

গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যাও বাড়বে। অতীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত উপাচার্যদের সফলতার পরিমাণ পর্যালোচনায় আনলেই নির্বাচিত উপাচার্যের প্রয়োজনীয়তা আরো জোরালো হয়ে উঠবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক নির্বাচিত উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরীসহ দেশবরেণ্য এসব উপাচার্যের অবদান যুগ যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে উৎসাহ যোগাবে।

তাই সরকারের কাছে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিসি প্যানেলসহ সব ক্ষেত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চার তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানাচ্ছি।  স্বাধীনতার মাস। তাজা রক্ত দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই দেশের মানুষ গড়ার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি মানুষের আকাঙ্খার প্রতীক না হতে পারে, তাহলে ১৬ কোটি বাঙালি কোথায় যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে স্বপ্নের বাংলাদেশের মডেল। যারা গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখবেন, তাদেরকে গণতান্ত্রিক পরিবেশে গণতন্ত্র অনুশীলনের মাধ্যমে আগেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক গতিশীলতা, নিয়মিত নীতিকে লঙ্ঘন করার রেওয়াজ শুরু হয়ে গেলে বাঙালি জাতিকে তার কঠিন মূল্য দিতে হবে।

লেখকদ্বয় : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময় : ০৯০০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১২
সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।