ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

হুমায়ুন কবির বালু: সাংবাদিকদের সাহসিকতার বাতিঘর

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৮ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৪
হুমায়ুন কবির বালু: সাংবাদিকদের সাহসিকতার বাতিঘর সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু

খুলনা: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হুমায়ুন কবির বালু একটি নাম, একটি আন্দোলন ও একটি বিস্ময়কর প্রতিভা। যুগ নয়, শতাব্দীর ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ।

বিরল প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি ছিলেন আপসহীন ও নির্মোহ এক সৃজনশিল্পী।

সৌভাগ্যক্রমে তার মালিকানাধীন পত্রিকা ‘সান্ধ্য দৈনিক রাজপথের দাবি’-তে আমার কিছুদিন কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মূলত নতুন প্রজন্মের কাছে তার সাহসিকতার কিছু গল্পই আজ অবতরণ করতে চাই।

মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সাংবাদিক বালু যে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুগ যুগ অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সাংবাদিকতায় তার অবদান নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তবে যেটুকু না বললেই নয়, তা হলো তিনি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। ভিন্ন রূপ দিয়েছিলেন সেই সময়ে ‘সান্ধ্য দৈনিক রাজপথের দাবি’ প্রকাশের মাধ্যমে। সাংবাদিক হিসেবে বিপদে–আপদে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নানা সংকটে সাংবাদিকরা তার কাছে ছুটে যেতেন সমাধানের পথ খুঁজতে। পরিবারের প্রতিও তিনি ছিলেন যত্নশীল। যে কারণে আজ বালুর পরিবার শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞানে সব দিক থেকে এগিয়ে।

খুলনার কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার পেছনে দৈনিক রাজপথের দাবির সাহসী প্রতিবেদনগুলো অনন্যা ভূমিকা রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হাতে রেখে এরশাদ শিকদার একের পর এক মানুষ হত্যা করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটি কাঁপিয়েছেন। তার হাতের মুঠোয় ছিল জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। এরশাদ টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে রেখেছিলেন। ঠান্ডা মাথায় মানুষ হত্যার পর খুনি এরশাদ দুধ দিয়ে গোসল করতেন। তার হত্যার নিজস্ব কৌশল ছিল। স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই তিনি গলায় রশি পেঁচিয়ে মানুষ হত্যা করতেন। পরে জমাট বাধা সিমেন্ট দিয়ে বেঁধে লাশ ভৈরব নদে ফেলে দিতেন। এভাবেই এরশাদ শিকদার কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা করেছেন। বেশিরভাগ লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি।  

তার সেই কুকীর্তি সেই সময় পত্রিকার পাতায় তুলে আনা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি সংবাদমাধ্যম ততটাই সাহসী, যতটা তার সম্পাদক - এই কথাটির যথার্থ প্রমাণ করেছেন প্রয়াত সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু।

সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালুর সব মহলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এটা একজন ভালো সম্পাদকের যোগ্যতাও বটে। তবে অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে অনেক অনুরোধও তাকে রাখতে হয়েছে। কিন্তু কোনো অন্যায় অনুরোধ তিনি রাখতেন না। অনুরোধ উপেক্ষা করার মত সাহস, সততা তার ছিল। সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন পক্ষপাতহীন। অসংখ্যবার তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে।  
মৃত্যুকে পরোয়া না করে দৃঢ়চিত্তে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু। একজন ভালো সংগঠক ছিলেন বালু ভাই, ভালো অভিভাবকও ছিলেন। পেশার প্রতি তার যে আত্মনিবেদন তার কোনো তুলনা হয় না। সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে কখনো তিনি আপস করেন নাই। যে কারণে অকালে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

হুমায়ুন কবীর বালু এবং ১৯৭২ সালের একটি পুলিশ প্রতিবেদন এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধে তার জ্যেষ্ঠ ছেলে দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক আসিফ কবীর লিখেছেন –

১৯৭২ সালেও একবার তার জীবন বিপন্ন হতে বসেছিল। এ বিষয়ে স্বাধীনতা পদক ও পদ্মশ্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীকের মাধ্যমে একটি গোয়েন্দা নথি হুমায়ুন কবীর বালুর পরিবারের হাতে আসে।  

‘ইনডেক্স টু দ্য বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাব্সট্রাক্ট সাপ্লিমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স’ শিরোনামে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২-এর ভলিউম-১ ভুক্ত ৪২ পাতার ৩২২ নম্বরে খুলনা উপ-শিরোনামে প্রতিবেদনটি বিবৃত হয়েছে। খুলনা পুলিশ স্টেশন কেস ১২নং ৫ মার্চ ১৯৭২-এ রেকর্ডকৃত। ৪৫৭/৩৭৬ একটি বাংলাদেশ পুলিশ কেস চালু হয়।  

রিপোর্টে দেখা যায়, খুলনার ইকবালনগর এলাকার কাজী শওকত আলী মামলাটির বাদী। হুমায়ুন কবীর বালু (বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা), বিবাদীকে (একজন ইউনিফর্ম অফিসার) ধর্ষণ চেষ্টাকালে হাতেনাতে স্থানীয় আরও কয়েকজনের সহায়তা নিয়ে ইকবালনগর এলাকায় ধরেন ও পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে বিবাদী জামিন লাভ করেন।

জামিনে মুক্তি পেয়ে বিবাদী কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ৯ মার্চ ১৯৭২ রাত আনুমানিক ১২টা ৪৫-এ (আগে-পরে) হুমায়ুন কবীর বালুকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ইকবাল নগরে তার পৈতৃক বাড়ি ভাঙচুর করেন বিবাদী ও তার সঙ্গীরা। পরিবারের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তার খোঁজ শুরু করে। পরদিন সকালে শহরের জোড়াগেট এলাকায় তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রসমাজ ক্ষিপ্ত ও প্রতিবাদী হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২৮ জুন হুমায়ুন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের পরদিনই বিশেষ প্রোগ্রামে খুলনা আসেন। তখন তিনি বিরোধী দলের নেতা।  

তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, প্রায় ছয় মাস আগে যখন তিনি সাংবাদিক মানিক সাহা নিহত হলে একইভাবে এসেছিলেন ও খুলনা প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সভায় যোগ দিয়েছিলেন; তখন (সভার সভাপতি) হুমায়ুন কবীর বালু তার নিজের জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে শেষবার দেখতে আসার অনুরোধ করেছিলেন বলেও ওই প্রবন্ধে তার ছেলে উল্লেখ করেন।

বৈরী পরিবেশে সাংবাদিকতায় যারা সাহসের পরিচয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, সফলও হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু। সাংবাদিক বালুর জীবনকর্ম, সাংবাদিকতা, রাজনীতি এসব নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তিনি সংবাদপত্র পাঠক এবং রাজনীতি সচেতন মানুষকে শুধু দিয়েই গেছেন। কি পেয়েছেন সেদিকে দৃষ্টি দেননি কখনও। সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি করে তিনি কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা বা আগ্রহ নিজের মধ্যে স্থান দেননি। তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন বনেদি পরিবারের সন্তান। আভিজাত্য ছিল তার সহজাত। কিন্তু অভিজাত্যকে তিনি ছুড়ে ফেলে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন দেশপ্রেম ও জাতিগঠনমূলক সাংবাদিকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শের রাজনীতিতে। এটা তার সময়ের বিবেচনায় ছিল খুবই সাহসী পদক্ষেপ।

বৃহত্তর খুলনা তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনমানুষের সমস্যা তুলে ধরে তিনি সমাধানের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তার পত্রিকার মাধ্যমে। খুলনার উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি অন্যতম একজন রূপকার। তার মতো সৎ ও সাহসী সাংবাদিক এখন বিরল। অনেকের সাহস নেই, তাই তারা সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে না বরং তাদের তোষামোদি করে চলে।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার থাকার কারণে ২০০৪ সালের ২৭ জুন খুলনার শান্তিধাম মোড়ে দৈনিক জন্মভূমি অফিসের সামনে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় ‘দৈনিক জন্মভূমি ও রাজপথের দাবি’র সম্পাদক এবং খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি হুমায়ুন কবীর বালু নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের পরদিন ২৮ জুন খুলনা থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মারুফ আহমদ বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক ধারায় দুইটি মামলা দায়ের করেন। হত্যা মামলায় ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৭ আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন আদালত।

হুমায়ুন কবির বালু হত্যায় চরমপন্থি দল ‘জনযুদ্ধ’ জড়িত। দলটির বিরুদ্ধে লেখালেখি এবং বিভিন্ন সভা সমাবেশে তাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় টার্গেট হন বালু। হুমায়ুন কবির বালু হত্যার বিস্ফোরক অংশের রায়ে এ কথা বলা হয়।

সাংবাদিক বালুর মৃত্যু হিমালয়ের মতোই ভারী। তার মৃত্যুতে অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে সাংবাদিকতা পেশায়। তিনি বেঁচে থাকলে সাংবাদিক হিসেবে জাতিকে রাজনীতির অনেক দিকনিদের্শনা দিতেন। তিনি যে চেতনা ও স্বপ্ন বুকে ধারণ করতেন, আমরা তা ধারণ করে একটি সুন্দর সাংবাদিক সমাজ গড়ে তুললে তবেই তার আত্মা শান্তি পাবে।

হয়ত তাকে হারানো যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবে না। তবে তার ভালো গুণগুলো আমাদের সকলের স্মরণ রাখা দরকার। তার সাহস, দেশপ্রেম, বস্তুনিষ্ঠতা, সাংবাদিক শ্রেণির জন্য তার দরদ-অবদানকে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।

শহীদ সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালুর আজ বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, সাংবাদিক বালু ছিলেন সাংবাদিকদের সাহসিকতার বাতিঘর। খুলনাবাসীর অন্তরাত্মায় সদা সর্বদা সর্বাগ্রে জাগ্রত থাকবেন তিনি। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি, জানাই অন্তরমথিত ভালোবাসা।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৭,  ২০২৪
এমআরএম/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।