ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিটিশ দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ

গাজী মহিবুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১২
বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিটিশ দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ

ম্যানচেস্টার থেকে: গ্যারি লিনেকার একজন সাবেক ইংলিশ ফুটবলার। ফুটবলার হিসেবে তার বেশ খ্যাতি রয়েছে।

১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে আজ পর্যন্ত একমাত্র ইংলিশ ফুটবলার হিসেবে গোল্ডেন বুট জেতার কৃতিত্ব তারই। বর্তমানে বিবিসি টেলিভিশনের জনপ্রিয় ফুটবল শো ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’ সঞ্চালনা করে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। একজন সফল ফুটবলার হিসেবে ফিফা ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ডসহ নানা পুরস্কার জিতেছেন বার্সেলোনার সাবেক এই স্ট্রাইকার। ব্যক্তিগত জীবনে প্রথম স্ত্রীর চার ছেলে সন্তান থাকলেও বর্তমানে দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার করছেন ব্রিটিশ মডেল, অভিনেত্রী ডেনিয়েল লিনেকারের সঙ্গে। ডেনিয়েল লিনেকার বর্তমানে অভিনয়ের পাশাপাশি বিবিসির হয়ে স্পোর্টস রিলিফ-২০১২ এর জন্য কাজ করছেন। এরই অংশ হিসেবে তার সাবেক ফুটবলার স্বামীকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ সফরে। সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের অধিকারবঞ্চিত শিশুদের জন্য, চোখের পানি ফেলেছেন তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম দেখে। আবার এইসব অধিকারবঞ্চিত শিশুর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বানও জানিয়েছেন সমাজের বিত্তবানদের প্রতি।

ধন্যবাদ গ্যারি এবং ডেনিয়েলকে তাদের এই অকৃত্রিম সহমর্মিতার জন্য। কিন্তু সবকিছুর পরে গত ২৩ মার্চ ডেইলি মেইল পত্রিকায়, বিবিসিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে যেখানে শিরোনাম করা হয়েছে ‘ওয়েলকাম টু হেল’। এটা আমি ভালোভাবে নিতে পারিনি বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে। আপনাদের সহানুভূতি, চোখের জল, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সবকিছুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেই বলছি, বাংলাদেশের মতো একটি দারিদ্রপীড়িত দেশে এই দৃশ্য খুব একটা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। তাই বলে আপনারা বলতে পারেন না যে ``ওয়েলকাম টু হেল`` (নরকে স্বাগতম)। নরক বলতে যদি বাংলাদেশকে বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে আমি এর ঘোর বিরোধিতা করছি। বাংলাদেশকে নরক হিসেবে আখ্যায়িত করার অধিকার আপনারা রাখেন ‍না। এইসব অধিকারবঞ্চিত শিশুর কী দোষ, তারা তো শখে এসব করছে না, পেটে দুমুঠো ভাত তো দিতে হবে। ধিক জানাবেন? হ্যাঁ, অবশ্যই তা জানাতে পারেন আমাদের শাসক গোষ্ঠীকে, যারা এসব শিশুদের হাতে বই-খাতা, ভাত-রুটি দেওয়ার বদলে ইট ভাঙার হাতুড়ি তুলে দিয়েছেন কিংবা ডিসিসির ময়লার স্তুপকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন জীবিকা আহরণের ক্ষেত্র হিসেবে।

২.
বিলেতে না এলে হয়তো অজানাই থেকে যেত বিলেতের আপামর মানুষ কতটা উদার ও গণতান্ত্রিক। একই সাথে আরেকটি ব্যাপার অজানা থেকে যেত যে ব্রিটিশ মিডিয়া কতটা আত্মকেন্দ্রিক এবং পরনিন্দায় মত্ত। এ দেশে না এলে হয়তো কখনই বিশ্বাস করতাম না যে ব্রিটেনের রাস্তায়ও ভিক্ষুক পাওয়া যাবে যাকে পঞ্চাশ পেনির একটি কয়েন দিয়ে আত্মঅহংকার বোধ করি এই কারণে যে, কোনো ব্রিটিশকে ভিক্ষা দিলাম। কিংবা এই দৃশ্যও দেখতে পাবো ব্রিটেনের হিমশীতল আবহাওয়ায় কোনো মানুষ ঘরবাড়িহীন রাস্তায়, বাসস্টপে, ট্রেনস্টেশনে রাত কাটাচ্ছে। আর পুরো ইউরোপের চিত্র যদি বলি অনেকটা অবিশ্বাস্যই মনে হবে অনেকের কাছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক আরিস্তোতল, প্লাতো, সক্রেতিসদের জন্মভূমি গ্রিস এখন ইউরোপের বোঝা। এই লেখাটা যখন লিখছি ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা আগে গ্রিসের পার্লামেন্ট ভবনের সামনে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পৌঢ়। সরকার অবসর ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় তার জীবন অনেকটা হুমকির সম্মুখীন হয় যার দখল নিতে না পেরে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন দিমিত্রিস ক্রিস্তোউলাস(Dimitris Christoulas)। কে হতে যাচ্ছেন পরবর্তী ক্রিস্তোউলাস এই প্রশ্ন এখন গ্রিসে অনেকের মুখে মুখে। ব্রিটেনের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিষাদের ছায়া লক্ষ্য করছি তা যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হবার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এক সময়ের দুনিয়াজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে এখন একটি দ্বীপে পরিণত হয়েছে এই দ্বীপও আবার ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্কটল্যান্ডের বর্তমান সরকার এরই মধ্যেই ঘোষো দিয়েছে তাদের স্বাধীনতার জন্য ২০১৪ সালে দেশটিতে গণভোটের ব্যবস্থা করা হবে যার মধ্য দিয়ে স্কটল্যান্ডের নাগরিকদের কাছে প্রশ্ন থাকবে তারা কি স্বাধীন স্কটল্যান্ড চায় নাকি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্কটল্যান্ড চায়।
এসব দেখে বারবার সেই ‘টাইম ইউ আর ওল্ড জিপসিম্যান’ কবিতার কথাই বারবার মনে পড়ছে। সময় হলো এক বৃদ্ধ জিপসি। তা না হলে একসময়ের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কোথায় আছে যে সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যেত না, সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য এখন চাঁদের মতো অন্যের আলোতে আলোকিত। যুক্তরাষ্ট্রের লেজুড় হয়ে অনেকটা ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর মতো জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি হয়ে গেছে। যা হোক সময়ই বলে দেবে কার সূর্য কখন উঠবে আর কখন অস্ত যাবে নাকি ডুবে যাবে।

৩.
বাংলাদেশ একটি নব্য স্বাধীন দেশ। যদিও স্বাধীনতার ৪১ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু একের পর এক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে দেশটিতে রাজনৈতিকভাবে উন্নয়নবান্ধব পরিবেশ কখনই ছিল না। রাজনৈতিক নেতারা যেখানে উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্নিত করার কথা সেখানে রাজনীতিই বরং উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। আজ হরতাল তো কাল বিক্ষোভ মিছিল। রাস্তায় মিটিং তো গাড়ি চলা বন্ধ, হরতাল মারামারি তো দোকানপাট বন্ধ। যা ব্যক্তি পর্যায়ের উন্নয়নকেও করছে বাধাগ্রস্ত। এসব কিছু সাথে নিয়েই বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে-বিদেশে সবার মুখে মুখে একটি কথা এখন খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ। শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দেশটির উন্নয়নের ধারা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। যা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়।

অধিকারবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত, শিক্ষাবঞ্চিত এমনকি দু’বেলা পেট ভরে ভাত-রুটি খাওয়ার অধিকার থেকেও যারা বঞ্চিত, সেই কোমলমতি শিশুরা গ্যারি-ডেনিয়েলদের বিবিসির ক্যামেরায় বন্দি হবে, একটু সহানুভুতি পাবে, খবরের কাগজে ফিচার হয়ে থাকবে, টিভিওয়ালাদের একটু ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের উপজীব্য হবে কিংবা আমার মতো নালায়েক কোনো সাংবাদিক এসব দেখে কিছু করতে না পেরে অবশেষে নিজেকেই ধিক জানাবে। আর শাসকেরা নিরুর মতো বাঁশি বাজাবে। আমি সত্যিই তোমাদের (যেসব শিশুদের কথা বলা হয়েছে) কাছে লজ্জিত, তোমাদের জন্য কিছু করতে পারলে একটু হলেও দায়মুক্তি পেতাম। তোমরা ভালো থেকো।
                      
লেখকঃ সাংবাদিক, ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য
[email protected]                  

গ্যারি এবং ডেনিয়েল লিনেকারের বাংলাদেশ সফরের সময় ধারণ করা ভিডিও চিত্র দেখার লিংক নিচে দেওয়া হলো।
1.
http://www.sportrelief.com/whats-on/video-vault/gary-danielle-lineker-visit-bangladesh-rubbish-dump?page=5
2.
http://www.sportrelief.com/whats-on/video-vault/gary-danielle-lineker-meet-working-children-in-bangladesh?page=5

গ্যারি ও ডেনিয়েল লিনেকারের বিবিসিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি ইংল্যান্ডে ডেইলি মেইল পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হয়। সেটার লিংকও নিচে দেওয়া হলো।

http://www.dailymail.co.uk/tvshowbiz/article-2119547/Gary-Lineker-wife-Danielle-reduced-tears-trip-Bangladesh-Sport-Relief.html

বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।