সাম্প্রতিক দিন ও মাসগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। নিয়ন্ত্রণহীন মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে ২২ শতাংশের বেশি আবাসিক খাতের জ্বালানি ও শিল্প কারখানায় সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাস।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্য মতে মার্চ ২০২২- এ মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ আর এপ্রিল মাসে যা ঠেকেছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে। এটা গত ১৮ মাসের মধ্যে বৃদ্ধির রেকর্ড। বিশ্লেষকদের ধারণা মে মাসেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি। এ মূল্যস্ফীতির অতিশয় যন্ত্রণার মধ্যে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলারের মান বৃদ্ধি। সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে টাকার মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে যৌথভাবে কাজ করছে।
টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণটি হলো আমদানির বিপরীতে পরিশোধিত ডলারের ওপর অতিরিক্ত চাপ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং করোনা পরবর্তী বিশ্ববাজারে মন্দার সঙ্গে রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যযুদ্ধ। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের নাম ডলার। তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সুযোগ সুবিধা মতো মুদ্রার অবমূল্যায়ন নীতি না মানার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময় ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। ঐ দিন মুদ্রা বিনিময় হার সমঝোতা আনার জন্য ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে শিল্পোন্নত ১০টি দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা মিলিত হয়েছিল কিন্তু কোনো সুফল আনতে পারেনি। মূলত নিক্সন ১৯৭১ এর আগস্টে একতরফাভাবে তার ব্রেটনউডস ব্যবস্থা বাতিল করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের একচেটিয়া আধিপত্যের পথ যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে ডলার নামক অস্ত্রটি ব্যবহার করায় মুদ্রা বাজারে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত হচ্ছে।
করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ যখন শুরু ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিত রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রাণঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত। যার জন্য ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে সংকট আরো ঘনীভূত হয় এবং বাধাগ্রস্ত হয় অর্থনৈতিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। একই সময়ে দেশের আমদানি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৬ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের তুলনায় খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয় চরমভাবে। টানাটানির অর্থনীতিতে সংকটে পড়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে ও কমেছে বৈদেশিক রেমিট্যান্স। প্রায় ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রিজার্ভ সত্বেও এই সংকট মোকাবিলায় আমদানির লাগাম ধরার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীসহ একাধিক অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী বিলাশী পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ ও সবকিছুতে সাশ্রয়ী হতে দেশের সর্বস্তরের জনগণ কে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন।
বৈশ্বিক কভিডের কারণে ২০২০ সাল থেকে টানা দুই বছর ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ি থাকায় জরুরি বিদেশ গমন ও ভ্রমণপিপাসু মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়াতে প্রায় সবদেশে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ও ভিসা প্রাপ্তি শিথিল করায় গত ইদুল ফিতরের ছুটিতে প্রচুর মানুষ বিদেশে যাওয়ার কারণেও ডলারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়। তাৎক্ষণিক বিপর্যয় সামাল দিতে মে ১২, ২০২২ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা-৬ অধিশাখা, পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্র জারি করেছে। এর সঙ্গে মে ১৮ তারিখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ এক নির্দেশনায় তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজস্ব অর্থায়নে ও আংশিক অর্থায়নে বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মে ২২, ২০২২ তারিখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখিত আরেকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সকল প্রাইভেট ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে এক কর্ম দিবসের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে আরেকটি পরিপত্র প্রকাশ করে বলা হয় যে, পবিত্র হজ্জ পালন ও চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়াও আয়োজক সংস্থার সম্পূর্ণ অর্থায়নে পরিচালিত প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও স্টাডি ট্যুরেও ব্যাংক কর্মকর্তারা অংশ নিতে বিদেশে যেতে পারবেন।
এত সতর্কতামূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দেশের স্বার্থে, যাতে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকে। সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারের দাম বৃদ্ধির পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখাযায়: গত মার্চে দাম ছিল ৮৬ দশমিক ২০ টাকা। এপ্রিল মাসেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুরূপ দামে বিক্রি করে। আন্তব্যাংক রেট ছিল ৩/৪ টাকার ব্যবধান। একই সময়ে আমদানিকারকদের ৮৯ টাকা ২৫ পয়সা দরে ডলার কিনতে হয়েছিল। এমন করেই ডলারের চাহিদা যত বাড়ে, ক্রমান্বয়ে এর দামও তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডলার ক্রয় করে, আর সংকট দেখা দিলে তা বিক্রি করে ব্যাংকগুলোর কাছে। ২০২১-২২ অর্থবছর ১১ মাসের হিসেবে প্রায় ৬০০ কোটি (৬ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটেও প্রথমে ৯৫ টাকায় কিনে ৯৬/৯৭ টাকা দরে বিক্রি করে। অসাধু ও অতি মুনাফালোভী মুদ্রা ব্যবসায়ীরা তেলের তেলেসমাতির মতো ডলারেও সিন্ডিকেট করে এর দাম ১০০ টাকা পার করে।
এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কেট জরিপ ও তদারকি করে সিন্ডিকেট থেকে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে আন্ত:ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার বিক্রির দাম (বিসি/সেলিং) নির্ধারণ করে দেয় ৮৯ টাকা ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৮৯ দশমিক ১৫ টাকা । মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে এই দামের মধ্যেই সমন্বয় করে ডলার বিক্রির নির্দেশনা দেয়া হয়। এই দাম নির্ধারণের পর ব্যাংকগুলো নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। নির্দিষ্ট দামে না পারছে কিনতে আবার না পারছে বিক্রি করতে। তাই তারা ডলার বিক্রি করায় অনাগ্রহ দেখায়। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কেনা বেচার রেটের নিয়ম তুল নিয়ে তা বাজারের উপর ছেড়ে দেয়। তবে বাজারের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলশ্রুতিতে ডলারের বিনিময় মূল্য এককভাবে জোগান ও চাহিদার ওপর নির্ভর করবে না।
অথচ ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অতীত ইতিহাস এতো নাজুক ছিল না। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইডের তথ্য মতে, ১৯৪৭ সালের পূর্বের সময় ১ ডলার সমান ৩ দশমিক ৩৪ টাকা ছিল। এরপর ক্রমান্বয়ে টাকার মান কমতে থাকে। ১৯৭২ সালে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৭ দশমিক ৮৮ টাকা। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তেল সংকট দেখা দিলে টাকার মান আরো কমতে শুরু করে এবং ১৯৭৫ সালের ১৭ মে একসঙ্গে ৫৮% শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। আর ১ পাউন্ডে ৩০ টাকা পাওয়া যেত। তখন বাংলাদেশের মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল পাউন্ড। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রা বিনিময় সহজ হওয়াতে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে অন্তর্ভুক্তি হয় মার্কিন ডলার ও ১৯৯৩ সালের জুলাইতে টাকাকে চলতি মুদ্রা হিসেবে রূপান্তরিত করে।
উন্নত বিশ্বেও মূল্যস্ফীতি থেমে নেই। যুক্তরাষ্ট্রে ৮ শতাংশের বেশি যা ৪ দশকে সর্বোচ্চ। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ইতোমধ্যে সুদ হার বাড়িয়েছে, তাদের অবস্থা অনেকের চাইতে সুসংহত । অন্যদিকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের তথ্য মতে: যুক্তরাজ্যে ৯% মূল্যস্ফীতি হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে ১০℅ হতে পারে যা গত ৪০ বছরে সর্বোচ্চ। এমন চিত্র পৃথিবীর সবদেশেই।
তবে অতীতে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে মূল্যস্ফীতি, মন্দা কিংবা মহামন্দা যা এসেছিল, তারা বিকল্প পথে ভিন্ন উপায়ে মোকাবেলা করে কাটিয়ে উঠেছে। কারণ তাদের মধ্যে রয়েছে সর্বোচ্চ দেশপ্রেম ও স্বচ্ছতা। আর আমাদের মতো অভাগা দেশে কোনো কিছু শুরু হলে সেটি আর ছেড়ে যেতে চায় না এবং সুযোগ সন্ধানীরা আখের গোছাতে উঠে পড়ে লাগে। অর্থনীতির ভাষায় দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রের আড়ালে দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, অর্থ পাচার, রাজনৈতিক দোষারোপ, অব্যবস্থাপনা যেন তাজরিন ফ্যাশন থেকে রানা প্লাজার দুর্ঘটনা, চকবাজারে আবাসিকে কেমিক্যাল গোডাউন থেকে সীতাকুন্ডের ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে ভয়ানক প্রাণহানি। সাভার মহাসড়কে ফিল্মি স্টাইলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের স্টাফ বাসের সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় মূল্যবান সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানীদের প্রাণহানিসহ ইত্যাদি অব্যবস্থাপনা যেন ডাকাতের দুষ্টু চক্রে আটকে গেছে। আর মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় সীমিত আয়ের মানুষেরা সাশ্রয়ী হওয়ার মনোভাবে কষ্টের যাঁতাকল থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চোখের লোনাজলে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে সুদিনের জন্য বুকভরে অপেক্ষা করছে।
লেখক: মিজানুর রহমান, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক, এডিসি বিভাগ, ব্যাংক এশিয়া।