ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আসুন দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের একসঙ্গে ঘৃণা করতে শিখি

মোঃ রওশন আলম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১২
আসুন দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের একসঙ্গে ঘৃণা করতে শিখি

দুর্নীতি বা করাপশন হচ্ছে একটি ইউনিভার্সাল ক্যান্সার যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। দুর্নীতির ফলে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ আরেক শ্রেণীর দ্বারা শোষিত হয় আর এই শোষণকারীর দল বা দুর্নীতিবাজরা রাতারাতি বনে যায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।



দুর্নীতির প্রভাব উন্নত ও তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি বিদ্যমান। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই সামাজিক ব্যাধির প্রভাবটি অত্যন্ত বেশি। দরিদ্রতম দেশ আমাদের বাংলাদেশ দুর্নীতির এই অভিশাপ থেকে মোটেই মুক্ত নয় বরং এর প্রভাব প্রকট এবং এটাকে এখন ক্রনিক বললেও খুব একটা বেশি বলা হবে না।  

বাংলাদেশের উন্নয়নে দুর্নীতি যে কতোটা অন্তরায় এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় এর ব্যাপকতা কতো যে গভীরে, তা আমরা গত দশ বছরের ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনালের (টিআই) রিপোর্টগুলোর ওপর একপলক চোখ বুলিয়ে নিলেই সহজে অনুধাবন করতে পারি (http://www.transparency.org/policy_research/surveys_indices/cpi)।

এখানে বলে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল হচ্ছে একটি অলাভজনক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা, যা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে  জরিপের মাধ্যমে দুর্নীতির ওপর একটি ইনডেক্স তৈরি করে এবং দুর্নীতির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলক একটি ঙ্কিং করে এবং তা প্রতি বছর প্রকাশও করে থাকে। দুঃখজনক বা আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এবং একথা হয়তো এখন আর কারো অজানা নয় যে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচটি বছর পৃথিবীর প্রায় সবকটি দেশের মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ শীর্ষ বা চ্যাম্পিয়ন হয়। এর মধ্যে কেবল ২০০৪ ও ২০০৫ সালে যথাক্রমে হাইতি এবং শাদের সঙ্গে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়নশিপ উপাধি লাভ করে।

ছিঃ ছিঃ ছিঃ। হায়রে লজ্জা! হায়রে অর্জন! হায়রে আমাদের স্বনামধন্য আমলা ও রাজনীতিবিদরা, যারা আমাদের জন্য এ লজ্জাজনক অর্জন করেছেন এতোদিন!

বিগত বছরগুলোর দুর্নীতি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের শাসনামলের দুর্নীতিকেও হার মানিয়েছে কি না, তা হয়তো গবেষণার বিষয়। তবে আমাদের দেশে দুর্নীতি যে দৈনন্দিন জীবনে, কর্মস্থলে ও মানুষের চলার পথকে প্রতিনিয়ত স্থবির করে দিচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০০৬ সালের পর থেকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবটি না পেলেও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিটি দুর্নীতির বিষবাস্প বা কলঙ্ক থেকে যে মুক্ত হয়েছে, তা কিন্তু নয়। আমরা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টের কথা মাথা থেকে আপাতত ঝেড়ে ফেলে দেই।   বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পরে ও বর্তমান আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকারের আগে মাঝখানে চিপার মধ্যে পড়ে ফখরুদ্দিন আহমেদের সেনাপরিবেষ্টিত ১/১১ এর মাধ্যমে সৃষ্ট সরকারের কথা যদি গণনায় আনি, তাহলেও আমরা আমাদের দেশের দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারি। ফখরুদ্দিন আহমেদ সরকারের মেয়াদকাল ছিল প্রায় পাকা দু’বছর। এই দু’বছরে যা কিছু ঘটেছিল, তা কি আমরা এই অল্প সময়ের ব্যবধানে ভুলে গিয়েছি?
 
সে সময় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অনেক বড় বড় হোমরা-চোমরাদের কিসের জন্য আটক করা হয়েছিল? পার্থক্য ছিল শুধু এই যে, সংখ্যায় দুর্নীতিবাজরা কোনো দলের হয়তো বেশি, আর অন্য দলের হয়তো কম হবে এই যা। হাওয়া ভবনের উদ্ভাবক, তার বন্ধু-বান্ধব ও সাঙ্গোপাঙ্গকে কেন সে সময় ধরা হয়েছিল তা কি আজ অজানা আছে কারো? তা কি দুর্নীতির বাইরে কিছু ছিল? মি. তারেক রহমান অ্যান্ড ব্রাদার্সকে কি শুধু চিকিৎসার জন্যই সেদিন বিদেশে পাঠানো হয়েছিল? তাছাড়া সিঙ্গাপুর ও ঢাকার হাসপাতালগুলোতে গ্রেফতারকৃত রাজনীতিবিকদের চিকিৎসার জন্য হঠাৎ করে ভিড় জমেছিল কেন সে সময়ে?

ঢাকার আদালতপাড়ায় স্ট্রেচারে করে দুর্নীতিবাজদের হাজিরার দৃশ্যগুলো এখনো চোখে ভেসে ওঠে। তারা কি দুর্নীতির কারণে সে সময় অভিযুক্ত ও আটক হননি? সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তাদের কাউকে কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় আনা হয়েছিল কেন, তা কি কারো আজানা? বিচার সম্পন্ন না করে পরে ছেড়েও দেওয়া হয়েছিল কেন তাদের? তাছাড়া হ্যামার, বিএমডব্লিও, পোরশেসহ অনেক নামি ব্র্যান্ডের দামী গাড়িগুলো রাস্তায় রাস্তায় ফেলে দিয়ে কারা সেদিন পালিয়েছিলেন বা আত্মগোপনে গিয়েছিলেন? এতো দামি গাড়ি কেনার টাকা কোথা থেকে এসেছিল তাদের কাছে? কারা ছিলেন তারা? এই দুর্নীতিবাজরা কি দুর্নীতির মাধ্যমে সমাজ ও দেশের বিশুদ্ধতা নষ্ট করেননি?

ওপরের এতো সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর বর্তমান বিএনপির সবচেয়ে বেশি জানা থাকার কথা। কারণ, পরবর্তী নির্বাচনে তাদেরকেই চরম খেসারৎ দিতে হয়েছিল। সেই নির্বাচনে মানুষ বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোটকে ভোটের মাধ্যমে চরম জবাব দিয়েছিল এবং আশায় বুক বেঁধে আওয়ামী লীগের গড়া মহাজোটকে বিপুলভাবে ভোটযুদ্ধে জয়ী করেছিল।

কিন্তু দুর্নীতির প্রেক্ষাপটে কি দেখে আসছে মানুষ গত সাড়ে তিন বছর ধরে? শেয়ার কেলেঙ্কারির খলনায়করা হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে তুলে নিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলেন! কিছুই হলো না তাদের! পথে বসলো সব আমজনতা। কষ্ট ও লোকসান সইতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যাও করলেন!

এক দুই করে বাংলাদেশের মানুষের প্রায় সাড়ে তিন বছর কেটে গেল ঘোরের মধ্যে থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে। সাড়ে তিন বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থ ও এর কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাওয়া গেল না। মেড ইন বাংলাদেশ, মেড ইন ইন্ডিয়া, মেড ইন চায়না, আমেরিকা, জাপান ইত্যাদি শব্দগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ বা পৃথিবীর যে কোনো দেশের মানুষের কমবেশি পরিচয় থাকলেও ডিজিটাল বাংলাদেশের আকার, আকৃতি, আয়তন বা এর গুণগত মান সম্পর্কে আমার মতো গোবেচারাদের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়।

তবে বাংলা ডিকশনারি থেকে ডিজিটালের যথার্থ অর্থ জানার চেষ্টা করেছি। বাংলা অভিধানে ডিজিট শব্দের দুটি অর্থ দেওয়া আছে। ১. শুন্য থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যার যে কোনো একটি এবং ২. হাত বা পায়ের আঙ্গুল, প্রধানত বুড়ো আঙ্গুল। আর ডিজিটাল শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ১. সংখ্যাঘটিত বা ২. অঙ্গুলিসংক্রান্ত।
 
এখন ডিজিটাল নিয়ে মহাজোট সরকারের কাছে আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্মা সেতু নিয়ে মহাজোট সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির যেসব চলমান অভিযোগ এখনো বিদ্যমান এবং গত কয়েকদিন ধরে ঢাকায় রেলমন্ত্রীকে নিয়ে যে সব ঘটনা ঘটে গেল, বিশেষ করে রেলমন্ত্রীর এপিএস ও রেলের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালককে বিজিবির চতুর্থ গেটে রাত সাড়ে দশটায় বস্তাভরা টাকাসহ (৭০ লাখ) আটকে রাখা হল এবং তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে সকালের নাশতার পরে ওপরের ফোনের চাপে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হল- এসবকে কি সংখ্যাঘটিত নাকি অঙ্গুলিসংক্রান্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ বলবো? নাকি দু’টোই?

এটা ঠিক যে, দুর্নীতিবাজরা যখন দুর্নীতি করেন, তখন তাদেরকে সংখ্যা এবং অঙ্গুলির ব্যবহার যথার্থভাবেই করতে হয়।   দুর্নীতির পরিমাণ যে কত হবে, তা হিসাবের জন্য একমাত্র সংখ্যা (০ থেকে ৯) বা ডিজিটই ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ০ থকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা দ্বারা হাজার, লাখ, কোটি, মিলিয়ন, বিলিয়ন বা যে কোনো পরিমাণের দুর্নীতি হিসাবযোগ্য। আবার হাতের অঙ্গুলি দ্বারাই এই দুর্নীতি সাধিত হয়। সুতরাং দেশে ‘ডিজিটাল’ স্লোগানটির ব্যবহার কি যথার্থই শিরোধার্য?

তাছাড়া যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের ব্যাপক অভিযোগ থাকা এবং রেলমন্ত্রীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গের টাকাসহ হাতে নাতে ধরা পড়া সত্ত্বেও ওই দুই মন্ত্রী অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনরায় অন্য মন্ত্রণালয়ে বা দপ্তরবিহীন মন্ত্রণালয়ে বহাল তবিয়তে রয়েই গেলেন! কালো বেড়ালরা তো কালোই থেকে গেলেন। এসব দুগ্ধপোষ্য কালো বিড়ালদের দুধসহ মাছ, মাংস, কোপ্তা, বিরিয়ানি ও অন্যান্য চর্বিযুক্ত খাবারের স্বাদ থেকে কিঞ্চিত সময় বঞ্চিত রাখলে মহাজোট সরকারের কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?

হায়রে ডিজিটাল! তোমার পূর্ণাঙ্গ শাব্দিক অর্থ জানতে হয়তো আমার মতো গোবেচারাদের আরো অনেক দিন বা দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে!

কিন্তু দেড় বছর পরেই বা কোথায় যাবো আমরা? কে পারবে কালো বেড়ালদের গলায় ঘণ্টা বেঁধে টেনে আনতে?
কার কাছে আমরা চাইতে পারবো একটি দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলাদেশ? কে পূরণ করবে আমাদের সেই চাওয়া, তৃষ্ণা ও আশা? আমরা কি দিক হারিয়ে ফেলেছি? একবার এদিকে তাকাই আশায় আশায়, আর একবার ওদিকে- হয় জোট না হয় মহাজোটে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই যেন দুর্নীতির গন্ধ। গন্ধ সইতে সইতে এখন প্রায় অসুস্থ। চিকিৎসা দরকার, সুচিকিৎসা। নইলে এতো বিপুল সংখ্যক অসহায় জনগোষ্ঠী এই দুর্নীতির ভার আর সইতে পারবে না।

ঢাকাসহ সারা দেশেই তো দুর্নীতির গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। কোথায় যাবে এই অসহায় জনগোষ্ঠী? ছোট বেলার একটা ভাব সম্প্রসারণের দু’লাইন টাইটেল মনে পড়লো। ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। ‘ এটি শুধু আশারই বাণী। কারণ আশাতেই যে সর্বসুখ নিহিত রয়েছে- সুধীজন বলেছেন।

সবশেষে বলি, আমরা তো সাধারণ মানুষ। দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতা ও পেশিশক্তির কাছে আমরা নিতান্তই নিরীহ। তারপরেও আমরা কি ওদের ঘৃণা করতে পারি না?

আসুন, ওদেরকে আমরা ঘৃণা করতে শিখি, চরম ঘৃণা। এখন থেকেই, আজ থেকেই। আন্তরিক ঘৃণা, মন থেকে ঘৃণা। অফিসে-আদালতে, রাস্তায় যেখানে ওদের চেহারা দেখা যাবে সেখানেই ঘৃণা। তবে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সালাম জানাতে ভুলব না তাদেরকে, যারা প্রতিদিন মানসিক যন্ত্রণা সয়ে সয়ে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

এই লেখাটি সমাজের ও সরকারের সর্বস্তরের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে।   হোক সে আমলা, রাজনীতিবিদ বা সরকারের যে কোনো উঁচুপদের কেউ। সব দুর্নীতিবাজদের প্রতি সমান ঘৃণা।


মোঃ রওশন আলম : সায়েন্টিস্ট, যুক্তরাষ্ট্র
e-mail: [email protected]

বাংলাদেশ সময় : ২০৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১২

এমএম
সম্পাদনা : অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।