ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

ইলিয়াস আলীর অপেক্ষায়

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১২
ইলিয়াস আলীর অপেক্ষায়

ইলিয়াস আলীর ফেরার অপেক্ষায় বসে আছেন তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী-সন্তানেরা, নির্বাচনী এলাকার ভোটার, সমর্থক, সমালোচক এবং গুণমুগ্ধরা। তারা চান ইলিয়াস তাদের মধ্যে জীবিত-সুস্থ ফিরে আসুন।

কিন্তু তার নিখোঁজ ইস্যুতে এম কে আনোয়ারের মতো বিএনপির কিছু নেতার নিয়ত যে সাফ না, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট! তারা ধরে নিয়েছেন ইলিয়াস আর ফিরবেন না! তিনি গুম হয়ে গেছেন! অতএব তার গুম হবার ইস্যু নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করা যাবে! একজন মানুষ খুন হয়ে যাবার পর যখন লাশ পাওয়া যায় না, অথবা লাশ লুকানো হয়, সেটিকে বলা হয় গুম। বিএনপির এক শ্রেণীর নেতা যেন সেটাই চাইছেন। কিন্তু তার পরিবার তাকে জীবিত ফেরত চায়। গুম নিয়ে আন্দোলনের ইস্যু নয়।

ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হবার পর তার নির্বাচনী এলাকার থানায় দু’যুগের পুরনো একটি ঘটনা নিয়ে মামলা হওয়াতে তার জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা বেড়েছে। যারা তাকে তুলে নিয়ে গেছে লুকিয়েছে তারা তাকে বের করা অথবা কোর্টে নিয়ে আসার জন্যে হয়তো একটি পথ তথা ওয়েআউট খুঁজছে। প্রধানমন্ত্রীর  বক্তব্যেও ইঙ্গিত আছে ইলিয়াস জীবিত আছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইলিয়াস হয়তো তার নেত্রীর নির্দেশে লুকিয়েছেন! ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাও ইলিয়াসের বাসায় গিয়ে তার পরিবারকে দুশ্চিন্তা না করতে বলেছেন। এসবের যোগফল পজিটিভভাবে চিন্তা করলে আশাবাদী হতে হয়। এখন এই আশাবাদ সত্য হয়ে ইলিয়াস ফিরে আসলেই ভালো। সবচেয়ে ভালো তার পরিবারের জন্য। কী যাতনা বিষে, এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়লে কী মানসিক অবস্থা হয়, তা ইলিয়াস পরিবার ছাড়া কেউ জানে না।
 
ইলিয়াস আলীর  নিখোঁজ হওয়ার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। কথাটা এমন রূঢ়ভাবে বলা হয়েছে যে, সমালোচনা হতে বাধ্য। বিএনপি আমলে চট্টগ্রামের বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী জামালউদ্দিনকে অপহরণ, খুন, গুমের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন ইলিয়াসকে লুকিয়ে রেখে ইস্যু তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। বলেছেন, এ ব্যাপারে বিএনপির পারঙ্গমতার বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু এটা কী এভাবে এখন বলার সময়?  আমি নিশ্চিত খালেদা জিয়ার নিখোঁজ থাকার বিষয়টি সম্ভবত ভুলে যাওয়াতে প্রধানমন্ত্রী এখানে বলেননি বা উল্লেখ করেননি! এরশাদ আমলে একবার ক’দিন আত্মগোপন করেছিলেন খালেদা জিয়া। গোয়েন্দা সংস্থার যারা তাকে পরামর্শটি দেয়, তারা এ নিয়ে ডুয়েল গেম খেলে। খালেদাকে বলে তিনি এভাবে ক’দিন লুকিয়ে থাকলে তার পক্ষে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটে যাবে! আবার এই গ্রুপটিই এরশাদকে বোঝায়, উনি(খালেদা জিয়া) নিজেকে সেনাবাহিনীতে খুব পপুলার মনে করেন, উনি যে তা না,  তা প্রমান করে দিই। এরপর ঢাকার বাইরের সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পথে কালিয়াকৈরের কাছে গাড়ি সমেত নিখোঁজ হয়ে যান খালেদা জিয়া। সঙ্গে ছিলেন আজকের এলডিপি নেত্রী অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম। প্রচার আছে ওই সময়ে কালিয়াকৈর এলাকার একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের গেস্ট হাউসে সমঝোতায় লুকিয়ে থাকেন বিএনপি নেত্রী। তখন বিএনপির তরফে অভিযোগ করে বলা হয়, সরকার তাকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রেখেছে। তারেক রহমান তখন মায়ের নিখোজ থাকার খবর দিতে প্রথম প্রেসক্লাবে আসেন।
 
কিন্তু কয়েকদিন এমন আত্মগোপন অবস্থায় থাকার পরও তার পক্ষে অভ্যুত্থান হচ্ছে না দেখে এক পর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন খালেদা জিয়া। প্রথমে বায়তুল মোকাররম এলাকায় তার নিখোঁজ থাকার প্রতিবাদে এক সমাবেশে তার আত্মপ্রকাশের কথা ছিল। এ উপলক্ষে খালেদা-জাহানারা দু’জনে বোরকা পরে প্রথম এক জায়গায় আসেনও। কিন্তু পরে কী এক সংকেতের কারণে তারা সেখান থেকে ফিরে যান। পরের দিন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এসে হাজির হয়ে খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেন, এরশাদের গোয়েন্দারা তাকে অজ্ঞাতস্থানে আটকে রেখেছিল। তার আটক অবস্থার বিস্তারিত নিয়ে সাংবাদিকদের জেরার জবাবে সেদিন খালেদা জিয়া বিরক্ত-ক্ষুদ্ধও হন। ওবায়েদুর রহমানের নেতৃ্ত্বে বিএনপিতে ভাঙ্গন দেখা দিলে সে দলের সঙ্গে যাওয়া বিএনপি নেত্রী  শাহিনা ইসলাম সে ঘটনাটি এই প্রতিবেদকের কাছে ইন্টারভ্যুতে প্রথম ফাঁস করেন। বিএনপিও নানা দিবস পালন করলেও ঈমানি কমজোরির খালেদা জিয়ার সেই অন্তর্ধান থেকে ফিরে আসার দিনটি কিন্তু কখনো পালন করে না! শেখ হাসিনার ঘটনাটি মনে  থাকলে হয়তো, এ সময়ে এই সুযোগে বলে দিতেন!

 যদিও খালেদা জিয়ার ওই ঘটনার সঙ্গে ইলিয়াস আলীর ঘটনা মেলানোর সুযোগ নেই। নানাকিছুতে স্পষ্ট ইলিয়াস স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেননি। তাকে পথ থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। এরপর আবার স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে দিয়ে বিস্মৃতপ্রায় পুরনো একটি ঘটনার সূত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় মনে হচ্ছে, তাকে যারা নিয়ে গেছে তারা তাকে বের করে আনার ওয়ে আউট খুঁজছে। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হবার পর কালের কন্ঠের রিপোর্টে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, অনেক সময় অনেক গোয়েন্দা সংস্থার অনেক কার্যক্রমে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ঘটনার পর বিব্রত-উদ্বিগ্ন মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া দুশ্চিন্তা দেখেও মনে হয়েছে, সরকার শুরুতে বিষয়টা জানতো না। যেভাবে ঘটুক না কেন এখন পুরো দায়দায়িত্ব সরকারের কাঁধে বর্তেছে। এখন তারা ইলিয়াস পরিবারকে স্বজন ফেরত, না তার দলকে ইস্যু দেবেন, এ সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে। শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ফিরে আসুন ইলিয়াস আলী। আপনার মা, স্ত্রী,  সন্তানেরা আপনার অপেক্ষায়। ইলিয়াস জীবিত ও নিরাপদে ফিরলে তার আদ্যোপান্ত আরও অনেক লেখা যাবে। আগে চাই তার নিরাপদে ফিরে আসা। যেখানে মানুষ ঘরে ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে যায়, সরকার নির্লিপ্ত বলে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, বিরোধীদল অপেক্ষা করে গুম বিষয়ক আন্দোলন ইস্যুর, এমন দুর্বৃত্তশাসিত দেশ চাই না। ছি!!!

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।