ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দান-খয়রাত নয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলো চায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির অধীনে পাওনা

তপন চক্রবর্তী, ডেপুটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৩ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২৩
দান-খয়রাত নয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলো চায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির অধীনে পাওনা

কাতারের রাজধানী দোহায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পঞ্চম সম্মেলনে (এলডিসি-৫) যোগদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে কয়েক ধাপ এগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহণে কাতারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে।

সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ উদ্বোধনী সভায় দেওয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাঠামোগত রূপান্তর এর অঙ্গীকার পূরণ ও নবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। উন্নত দেশগুলোকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো দরকষাকষিতে তাদের পক্ষ নেবে। এই দেশগুলো দান-খয়রাত চায় না, চায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির অধীনে পাওনা।

২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যোগ্যতা অর্জন করেছে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে। করোনা মহামারির পর বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সম্মেলনে এলডিসির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।  

বৈশ্বিক বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অংশ দ্বিগুণ করার জন্য টেকসই সহায়তা প্রয়োজন এবং উন্নত দেশগুলো থেকে এলডিসির জন্য ওডিএ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঋণের স্থায়িত্বকে সমর্থন করার উপায় রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নকে নমনীয় ও অনুমানযোগ্য করা, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তর বাস্তব ও অর্থবহ করার কথা উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে।  

তিনি অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণের জন্য সুরক্ষার কথা বলেছেন। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ২২ কোটি ৬০ লাখ তরুণের ভবিষ্যতের কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা বৃদ্ধির স্বার্থে প্রণোদনা চালুর বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।  

বিশ্বের ৪৬টি দেশের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ এলডিসির অন্তর্ভুক্ত, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ। এদের ৭৫ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য অন্যতম প্ল্যাটফরম  ‘এলডিসি সম্মেলন’।

সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রোহিঙ্গা সমস্যা’ নিয়ে কথা বলেছেন। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান ছাড়াই কাজ করার কথা উল্লেখ করেছেন। এর আগেও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়াসহ পাঁচটি পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য তিনি পাঁচটি প্রস্তাব দেন।  

প্রস্তাবগুলো হলো- রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান। আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়াকে সমর্থন করাসহ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতীয় আদালতের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করা। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। আসিয়ানের পাঁচ-দফা ঐক্যমত মেনে চলার অঙ্গীকার পূরণে মিয়ানমারকে দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানানো। মিয়ানমার যাতে বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকারে রাজি হয় সেজন্য উদ্যোগ নেওয়া।

প্রধানমন্ত্রী এলডিসি-৫ সম্মেলনে গুরুত্ব দিয়েছেন ‘সাউথ সাউথ কো অপারেশন’ বিষয়ে।  উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণের চাপে পড়ছে। চলমান বৈশ্বিক সংকটকালে এসব দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর সাহায্যের হাত বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারব্যবস্থায় স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবেশ ও অংশগ্রহণও সহজ করা দরকার বলে মত প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘বৈশ্বিক বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অংশ দ্বিগুণ করার জন্য টেকসই সহায়তা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঋণের স্থায়িত্বকে সমর্থন করার উপায় রয়েছে’।

জ্বালানির সমস্যা সমাধানে বিশ্বনেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কোভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এর ফলে অধিকাংশ দেশে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু সংকট এবং কিছু স্বল্পোন্নত দেশে দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব। এসব বিষয়ে উন্নত বিশ্বের অনেক কিছু করার আছে’।

এর আগে ইয়ুথ কপ সম্মেলনেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণরা ৬ দফা দাবি পেশ করেন। তারা বিশ্বনেতাদের কাছে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা, জীবাশ্ম পোড়ানো বন্ধ করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান, উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দাদের জলবায়ু রক্ষার দায়িত্ব প্রদান, জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করাসহ অভিযোজনের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা।

এলডিসি মঞ্চে প্রত্যেক স্বল্পোন্নত দেশের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, লিঙ্গসমতা, প্রাইভেট সেক্টরকে শক্তিশালীকরণ, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ, ক্ষুধা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের বিষয়ও উল্লেখ করেছেন। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে উত্তরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে অন্যান্য এলডিসি দেশগুলো কীভাবে অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে, সে বিষয়েও দিয়েছেন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২৩
টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।