ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দুই দুগুণে পাঁচ, প্রতি ১৫ মিনিটে একটি অভিযান!

সাকির আহমদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪১ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১২
দুই দুগুণে পাঁচ, প্রতি ১৫ মিনিটে একটি অভিযান!

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে অনেক কিছুই বলা হয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তা, ডাব বিক্রেতা ও একটি রেস্তোরাঁর কর্মচারী এবং বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে যেসব কথা এতোদিন বলা হয়েছে, তার সত্যতা কতটুকু এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে এসে যায়।

তাদের উভয়ের ভাগ্যে কি ঘটেছে সে ব্যাপারে একমাত্র সরকারই ভালো এবং নিশ্চিত করে বলতে পারবে। আর এমনটি মনে করার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। গত ক`দিন ধরে যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে সে পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রশ্নের অবতারণা।

এপ্রিলের ১৭ তারিখ মধ্যরাতে ইলিয়াস ও তার গাড়ির চালক নিখোঁজ হন। একটি ঘটনা আরো অনেক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। দু’দফায় পাঁচদিনের হরতাল। আর এ হরতাল ছিলো কারো জন্য পৌষ মাস আর কারো জন্য সর্বনাশ।

এইচএসসি ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। হরতালে যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, হতাহত, মামলা ও গ্রেফতার। পূর্ব নির্ধারিত রুটিনে পাঁচদিনের পরীক্ষা না হওয়াতে ক্ষতির শিকার হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা।

যারা দিনের আয়ে সংসারের চাকা সচল রাখেন তারা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির কথা এরই মধ্যে এফবিসিসিআই’র নেতারা বলেছেন। বিক্রেতারা বাড়িয়ে দিয়েছিলো রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরের কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য।

এর বাইরেও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আরো অনেক ঘটনার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেসব ঘটনার অন্যতম হচ্ছে রাজনীতি, সরকার ও দায়িত্ববোধ। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিক নির্ভয়ে কথা বলতে পারেন। সরকারের সমালোচনা বিরোধী দল যেমন করবে, তেমনি সাধারণ নাগরিকরাও করবেন সেটিই স্বাভাবিক। এমনধারা আর কোনও ব্যবস্থায় নেই। তারপরও সবাইকে দায়িত্ববান হয়ে কথা বলতে হয়। কিন্তু বাস্তবে কি তেমনটি দেখা যায়?

চালকসহ ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ১৩ দিনের মাথায় সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ``ইলিয়াসকে উদ্ধারের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ১২০০ অভিযান পরিচালনা করেছে। ``
 
ওসমানী মিলনায়তনে মহান মে দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেছিলেন, ``ইলিয়াসের বিধবা স্ত্রী জানেন তার স্বামীর প্রকৃত খুনী কে। আপনার স্বামীর খুনী কে তা প্রধানমন্ত্রীকে খুলে বলুন। ``

গত ২ মে সন্তানদের নিয়ে ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা গণভবনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে। প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ দিয়ে ইলিয়াসের স্ত্রীকে বলেছিলেন, ``আগে মানবতা, পরে রাজনীতি। মানবতার কারণেই সরকারের দায়িত্ব কোনো হারানো নাগরিককে খুঁজে বের করা। ``
 
গত ৩ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বঙ্গবন্ধু একাডেমীর উদ্যোগে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মসূচির নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এমপি বলেছেন, ``ইলিয়াস আলীর লালিত সন্ত্রাসীরাই তাকে খুন করেছে। ``

সরকারপ্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কথাগুলো বলেছেন তাতে নিখোঁজ ইলিয়াসের স্ত্রী লুনা গণভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের আশস্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। এরপরও যে বিষয়টি লিখতে বাধ্য করেছে তা হচ্ছে একটি ঘটনা থেকে অনেক প্রশ্নের জন্ম। দেশে যখন নির্বাচিত সরকার থাকে তখন সে সরকার পর্দার আড়ালে নিজেদের দলীয় সরকার বলে দাবি করলেও তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তবে সরকারকে দৃশ্যমান হতে হয় দেশ ও প্রতিটি নাগরিকের সরকার হিসাবে। কে ভোট দিয়েছে আর কে দেয়নি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সেটি বড় বিবেচ্য বিষয় নয়। বড় হলো দেশ ও জনগণের সরকার।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন এ ধরণের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে পারি না? মন্ত্রী হওয়ার পর দলের যে কোনো পদে থাকলেও তিনি তো দলের মন্ত্রী নন। দেশ ও জনগণের মন্ত্রী। এমন একটি পদে থেকে যদি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে উঠতে না পারেন তাহলে এমন কোনো মন্তব্য করা উচিত নয় যা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু মন্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের দলের গণ্ডির বাইরে ভাবতে না পেরে প্রকাশ্যে এমন ধরণের কথা বলেন যা বিতর্কের সূত্রপাত ঘটায় এবং সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। আর ইলিয়াস নিখোঁজ ইস্যুতে সে ধরণের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে একাধিকবার।

সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য নিয়ে একটি অংক কষা যায়। ২৪ ঘন্টায় একদিন। অতএব ১৩ দিনে ৩১২ ঘন্টা। আবার ৬০ মিনিটে এক ঘন্টা এ হিসাবে ৩১২ ঘন্টায় ১৮ হাজার ৭২০ মিনিট। মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দেওয়া তথ্য সত্য ধরে নিলে অংকের ফলাফল দাঁড়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ইলিয়াসকে উদ্ধারের জন্য প্রতি ১৫ মিনিট ০৬ সেকেন্ডে একটি করে অভিযান চালিয়েছে।

মন্ত্রীর এ হিসাব সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করে সবিনয়ে এটুকু বলা যায় পৃথিবীর কোন দেশে কোন ধরণের প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব?

তোষামোদ নিয়ে একটি প্রবাদ রয়েছে। রাজা তার উজিরকে প্রশ্ন করলেন ২ এর সাথে ২ গুণ করলে কত হয়? উজিরের জবাব ছিলো, হুজুর গুণফল ৪ হয়। রাজা পাল্টা প্রশ্ন করেন কেন ৫ হবে না? উজির হাত জোড় করে বিনয়ের সাথে জবাবে বললো, জ্বি হুজুর আপনি চাইলে ২ এর সাথে ২ গুণ বা যোগ করলে ফলাফল ৫ হবেই।

অপরদিকে মে দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান নিখোঁজ ইলিয়াস সম্পর্কে যা বলেছেন তা কি আসলেই সত্য? রাজনীতির কারণে সব সময় নেতারা রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। আর বিরোধী দলের নেতা হলে তো এমন বক্তব্য দেন যে রীতিমত সরকারকে তুলোধুনো করে ছাড়েন। বিরোধী দলের নেতাদের এসব বক্তব্যের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর যদি রাজনৈতিক নেতার মত যখন যা ইচ্ছা বলা হয় তা কি দায়িত্ববোধের পর্যায়ে পড়ে? মন্ত্রীর বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই সরকারের বক্তব্য হিসাবে ধরে নেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও এক সময়কার আমলা ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর ১৯৯৬-২০০১ সময়কার আওয়ামী লীগের ঐক্যমতের সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমান মহাজোট সরকারের একজন সংসদ সদস্য; তাছাড়াও তিনি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এতোবড় একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হওয়ার পরও তিনি গত ৩ মে বললেন ``ইলিয়াস আলীর লালিত সন্ত্রাসীরাই তাকে খুন করেছে। `` আসলে তিনি নিশ্চিত হয়েই এসব কথা বলেছেন নাকি রাজনীতির কারণে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা কিন্তু থেমে নেই।
 
প্রশ্ন হচ্ছে কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য বিএনপি’র নিখোঁজ নেতার ব্যাপারে যেসব কথা বলেছেন তা কি সরকারেই কথা? নাকি তারা রাজনীতির কারণেই এমন ধরণের কথাবার্তা বলেছেন? বিএনপি ঘটনার প্রথম থেকেই সরকারকে দায়ী করে আসছে। এখন চাইছে এসব কথার সূত্র ধরে সরকারের দিকে স্থায়ীভাবে অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করতে। কয়েকজন নেতা এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী কিনটন ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সফর শেষে ইলিয়াস ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ ফের উত্তপ্ত করার কথা চিন্তা-ভাবনা করছে বিএনপি।

যে কথাটি না বললেই নয় সেটি হচ্ছে একজন স্ত্রী ও সন্তান। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিখোঁজ ইলিয়াস সম্পর্কে যা বলেছেন তা নিয়ে বিএনপি কি করবে বা না করবে সেটি হয়তো ইলিয়াসের পরিবারের দেখার বিষয় নয়। সত্যি সত্যি যদি ইলিয়াসের স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ আত্মীয়-স্বজনরা জবাব চান তাহলে তাদের কি জবাব দেওয়া হবে? তারা যদি বক্তব্য প্রদানকারী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করেন, ``ইলিয়াসকে হত্যা করা হয়েছে এমন কথা কেন বলেছেন, আবার  কারা তাকে হত্যা করেছে একথা যে  বলেছেন তা কিসের ভিত্তিতে বলেছেন? অতএব আমরা লাশটি ফেরত চাই, দয়া করে  লাশটি ফেরত দিন। সেই সাথে যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিচারও চাই। `` তখন কি এসব বক্তব্য রাজনীতির কারণে দেওয়া হয়েছে বলে পাশ কাটানো যাবে?

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

[email protected]

বাংলাদেশ সময় ১০৪১ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।