ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রতিবাদই পারে নদ-নদীকে সুরক্ষা দিতে

আলম শাইন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০২ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২৩
প্রতিবাদই পারে নদ-নদীকে সুরক্ষা দিতে

বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে মানুষ আর তিমির আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। কথিত আছে, তিমি মারা গেলে জোড়ের সঙ্গী স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দেয়; আর তিমিদের দলপতি মারা গেলে দলবেঁধে আত্মহত্যা করে অন্যান্য তিমিরা।

মানুষ নিজের প্রাণ নিজে কেড়ে নেয় হতাশায় ভুগতে থাকলে, আর তিমি তার সঙ্গী হারানোর শোক সইতে না পেরে প্রাণ বিসর্জন দেয়। এই ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে কমবেশি; তার মধ্যে ইঁদুর প্রজাতির প্রাণী ‘লেমিং’ অন্যতম। প্রাণীজগতের পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাধারগুলোরও আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। তার মধ্যে নদ-নদী, ঝর্ণাধারা অন্যতম। নদী প্রাণ বিসর্জন দেয় মানবজাতির ভোগ আর আত্মসাৎ প্রবৃত্তির কারণে; নদী শাসনের কারণেও বলা যেতে পারে। মূলত উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত শাসন আর নির্যাতনই নদ-নদীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। নাব্যতা হারিয়ে চর জেগে ওঠাই হলো নদীর প্রাণ বিসর্জন দেওয়া; যা পরবর্তীতে ‘মরা গাঙ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।  

নদ-নদীর বুকে বাঁধ দিলে অথবা প্রাচীর নির্মাণ করলে অথবা বর্জ্যের ভাগাড় বানিয়ে জোয়ার-ভাটার প্রবাহ আটকে দিলেই নদী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তেমনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে দেশের অনেক নদ-নদী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে এ যাবতকালে। তার মধ্যে লাঠিয়াল, জোতদার কিংবা ধন্যাঢদের নিষ্ঠুরতার বলি হয়েই নদীগুলো প্রাণ হারিয়েছে বেশির ভাগ। যার ফলে আজ জলবায়ু এবং জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তাপমাত্রাও বেড়ে চলছে। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে ফসলের মাঠ-প্রান্তর ধু ধু করে তাপদাহ ছড়াচ্ছে। লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার ডাকাতিয়ার পাড়েও তদ্রূপ। শাসন আর জুলুমের শিকার হয়ে ডাকাতিয়া নদীর দুই প্রান্তে এখন দরদালান মাথা উঁচিয়ে উঠছে। বর্জ্যের ভাগাড়ের কারণে জলের রঙেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। নানাবিধ কারণে ডাকাতিয়ায় মরা গাঙের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। অথচ ডাকাতিয়া বেশ চওড়া ছিল পাঁচ যুগ আগেও। ঝুপঝাপ করে নদীর দুই পাড় ভেঙে জলে তলিয়ে যেতে দেখেছে ষাটোর্ধ্ব অনেকেই। দেখেছে রুপালি ইলিশের আনাগোনাও। দেখেছে ঢাকা সদরঘাট থেকে লঞ্চ  চাঁদপুর হয়ে রায়পুর পৌঁছতে। সেই সব এখন স্মৃতি। ডাকাতিয়ার ভরা যৌবন এখন নেই, নেই ভয়ংকর গর্জন, শোনা যায় না লঞ্চের সাইরেনও।

আমজনতার বাধার মুখে ডাকাতিয়ার বুকে আশির দশকে মাটিচাপা দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করেছিল সেই সময়ের স্থানীয় প্রশাসন। বাঁধের দুইধার ঘিরে অজস্র দোকানপাট গড়ে উঠেছে তখন থেকেই, মস্ত কায়কারবারও জমে উঠেছে ডাকাতিয়ার বুকে। বাঁধের মধ্যখানটায় পিচ ঢেলে মুড়িয়ে দেওয়ায় যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহন দাপিয়ে বেড়াতে পারছে ইচ্ছেমতো। আর সে সুযোগে নদীটি এখন গিলে খাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। বিভিন্নভাবে নদী দখল করে রেখেছে তারা। ফলে নদীর জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ; মানববন্ধনও করেছেন দফায় দফায়। তাদের দাবি, বাঁধ ভেঙ্গে সেতু বানানোর এবং নদীর আশপাশ দখল মুক্ত করার। তাতে করে ডাকাতিয়া পুনঃযৌবন ফিরে পাবে, বইবে জোয়ার-ভাটার জলও। তাদের বিশ্বাস, নদী দখলমুক্ত হলে কিংবা বাঁধ ভেঙ্গে দিলে ঢাকা-রায়পুর লঞ্চ যাতায়াতে সহায়ক হবে।  

বিষয়টি জেনেশুনে আমরাও নিশ্চিত হয়েছি, যে এলাকাবাসীর দাবিগুলো অযৌক্তিক নয়। কর্তৃপক্ষ ডাকাতিয়ার কান্না শুনতে না পেলেও এলাকার তরুণসমাজ ঠিকই শুনতে পেয়েছেন। তারা জেগে উঠেছেন নদী সুরক্ষায়; পরিবেশ রক্ষাও সোচ্চার হয়েছেন। আমরা জানি, দেশের আর কোথাও নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে রাস্তা নির্মাণের এমন নজির নেই। অথচ আশির দশকে সাবেক নোয়াখালী জেলা (লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলা) প্রশাসনের ব্যতিক্রম উদ্যোগের ফলে নদীটির শ্বাসরোধ করা হয়েছে! প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, এতসব আন্দোলনের পরেও ডাকাতিয়া রাহুমুক্ত হতে না পারার কারণটি। অথচ সরকার জলাধার, নদীনালা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শূন্য ভূমিকায় অবস্থান নিলেও ডাকাতিয়া অচল আধুলির মতো বাক্সবন্দি হয়ে রয়েছে। যার ফলে নদী সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের জন্য তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করে আসছেন কয়েক বছর ধরে। যার এখনো কোন বিহিত হয়নি। এই তো ডাকাতিয়ার কথা। এই নদী ছাড়াও দেশের অসংখ্য নদ-নদী মানুষের দখলদারিত্ব, অত্যাচার আর জুলুমবাজির কারণে আজ মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। তেমনি আরেকটি অন্যতম নদী হচ্ছে, ময়মনসিংহ এলাকার বহ্মপুত্র নদ। নদীটি নাব্যতা হারিয়ে বর্তমানে হাঁটুজলে এসে ঠেকেছে। একসময়ের উত্তাল নদী এখন দেখতে অনেকটাই খালের মতো মনে হচ্ছে। নদীটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২০১৮ সালে বহ্মপুত্র নদ খননের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও আজ অবধি খনন কাজ সম্পন্ন হয়নি।  

স্থানীয়দের দাবি পাঁচ বছরে মাত্র ১০ শতাংশ নদী খনন করা হয়েছে। ফলে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের কর্মকাণ্ডে। তারা ময়মনসিংহের কাচারীঘাট এলাকায় এক অভিনব কায়দায় প্রতিবাদের আয়োজন করেন। সেখানে এলাকার সুধীসমাজ ও সংস্কৃত ব্যক্তিত্বরা নদীর হাঁটুজলে নেমে জারি-সারি গান গেয়ে এবং জালাময়ী বক্ত্যব রেখে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। নদী দূষণমুক্ত করতে ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে অভিনব কায়দার প্রতিবাদ নদীপ্রেমীদের দৃষ্টি আর্কষণ করেন। যার ফলে দেশের পরিবেশবাদী সংগঠন ও আমজনতা নদ-নদী সুরক্ষায় আরও উজ্জীবিত হয়েছেন, যা আমাদের কাছেও প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

উপরোক্ত নদী দুটি উদাহরণ মাত্র; এ ধরনের অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় দেশে আজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে কিংবা দখলদারের লোভ-লালসার শিকার হয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। নদীর সেই কান্না বা আহাজারি দখলদাররা শুনতে পারছেন না, তারা এতটাই বধির হয়ে পড়েছেন লালসার বেড়াজালে আটকে। আমরা জানি, নদী দূষণের ফলে আজ দেশের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এছাড়াও নদীর নাব্যতা হারানোয় মারাত্মকভাবে বন্যার কবলে পড়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এতকিছু ঘটনা ঘটার পরেও দখলদারদের বোধোদয় হচ্ছে না কিছুতেই, কারণ তাদের ব্যাপক জায়গা জমিনের প্রয়োজন। সেই জায়গা-জমি হোক কবরস্থান কিংবা শ্মশানের তাতে কারো কিছু যায় আসে না। তাই আসুন এ ধরনের লোভী মানুষদের আমরা প্রতিহত করি শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করে। কারণ একমাত্র প্রতিবাদই পারবে নদীকে সুরক্ষা দিতে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।