ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ব্যারিস্টার রফিক কী খালেদার রাষ্ট্রপতি হতে চান?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৬ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১২
ব্যারিস্টার রফিক কী খালেদার রাষ্ট্রপতি হতে চান?

খালেদা জিয়াকে ‘আমাদের নেত্রী’ বলে উল্লেখ করে নিজের নিশানা পরিষ্কার করে দিয়েছেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। এজন্য তাকে ধন্যবাদ।

নিজের মুখোশটা নিজেই খুলেছেন।

অবশ্য খালেদা জিয়াই তার প্রথম নেত্রী নন। তার প্রথম নেতা ছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদ। যিনি শুধু গুলিতে না, ছাত্রদের মিছিলের উপর ট্রাক তুলে দিয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছিলেন। ব্যারিস্টার রফিক ছিলেন তার অ্যাটর্নি জেনারেল। পরবর্তী সময়ে এরশাদের মামলারও তিনি ছিলেন প্রধান আইনজীবী। পরে অবশ্য এরশাদ যখন কতক্ষণ আওয়ামী লীগ কতক্ষণ বিএনপি এসব খেলা খেলছিলেন, তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তার মামলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তার মতো একজন আইনজীবীকে হারিয়ে এরশাদ ভুগেছেনও অনেক। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বন্দি শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া দু’জনেরই মামলা কোর্টে লড়েন ব্যারিস্টার রফিক। এ ছাড়া ওই আমলে  চিহ্নিত অনেক দুর্নীতিবাজের পক্ষেও তিনি কোর্টে দাঁড়ান।

শোনা যায়, এসব সূত্রে অকল্পনীয় অংকের টাকা ওই সময়ে তিনি কামিয়েছেন! ড. কামালের মতো সিনিয়র আইনজীবী যখন সেই তত্ত্বাবধায়কদের পরামর্শকদের একজন ছিলেন, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, বারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদসহ বিশিষ্ট অনেকে যখন ট্যাক্স ফাইল আর সম্পদের সাদাকালো দুর্বলতার কারণে ম্রিয়মান, তখন সে রকম সমস্যা না থাকাতে বেশ দাপটেই ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

তিনি টাকা কামাচ্ছেন দেখলে আরেক কারণে আমার ভালোও লাগে। কারণ গাজীপুরে বড় একটি এতিমখানা অনেকদিন ধরেই একা চালাচ্ছেন তিনি। আদ-দ্বীনের মতো একটি হাসপাতাল করেছেন। এরসবের পিছনে তার আইন ব্যবসার আয় জড়িত।

আইন পেশায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে কোর্টে তার সাবমিশনও শোনার মতো হয়। তার জুনিয়র হিসাবে আইন পেশা শুরু করেছিলেন, এমন অনেকে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিও হয়েছেন, রিটায়ার করেছেন। এর কারণে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যখন বিভিন্ন সময়ে ব্যারিস্টার রফিককে আইনের প্রশ্নে নসিহত করেছেন, এর নিন্দাও করেছি। এমনটা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতেও করবো। কারণ ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের নখের যোগ্যতাও তাদের নেই। বা আইনজীবী হিসাবে তার জুনিয়র হবার যোগ্যতাও তাদের ছিলো না, অথবা তাদের তিনি জুনিয়র হিসাবেও নিতেন কিনা সন্দেহ।

আবার কোর্টের বক্তব্য পছন্দ না হলে মেজাজ চড়িয়ে সবার সামনে কোর্টের মধ্যে ফাইল ছুঁড়ে মারার ঘটনাও ব্যারিস্টার রফিকের আছে। এটি তার মতো আরও অনেক সিনিয়র আইনজীবী করেছেন। কারণ কোর্টে বিচারকদের অনেকে তাদের একাধিক জেনারেশন জুনিয়র। তাদের অনেকে মানসিকভাবে মনে করেন, কোর্টে দাঁড়ালে তারা তাদের মুখ থেকে সিদ্ধান্ত দেবেন। অথবা এসব বিচারক আইন জানেন না-বোঝেন না! অতএব রাগ দেখাতে ফাইল ছুঁড়ে মারার মতো আদালত অবমাননার আর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে `মানির মান রাখতে` তখন প্রধান বিচারপতিকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
 
অনেকদিন নানা ইস্যুতে বিবেকের মতো কথা বলেছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তার কিছু কিছু বক্তব্যকে একজন প্রথিতযশা আইনজীবীর নিরপেক্ষ বক্তব্য হিসাবেও চিহ্নিত করা চলে। যদিও ব্যারিস্টার রফিকের বরাবরই একটি পক্ষ ছিল।

দেশের সাংবাদিকতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, আইনপেশা এমনকি ডাক্তারদের সংগঠনও আওয়ামী লীগ-বিএনপি এই দু’ধারায় বিভক্ত। অথবা আওয়ামী লীগ, অ্যান্টি আওয়ামী লীগ! শিখ’রা বিশ্বাস করে পৃথিবীতে প্রতিটি মানবশিশু শিখ হিসাবে জন্ম নেয়। চুল কাটার পর সে ‘অশিখ’ হয়ে যায়। তেমন বাংলাদেশের রাজনীতিও আওয়ামী লীগ-অ্যান্টি আওয়ামী লীগ এই দু’ধারায় বিভক্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃ্ত্বে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনামলের মতো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশেও কখনো ধর্মের নামে, কখনো সমাজতন্ত্র বা সামরিক শাসনের দালালির নামে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ রাজননীতির ধারাটি হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। অথবা পরিস্থিতিকে এমন করে ফেলা হয়েছে যে, আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বললে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বললে আপনাকে বলা হবে আপনি আওয়ামী লীগ এবং ভারতের দালাল! মুক্তিযুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুখে আনলে বলা হবে এর চেয়ে বড় ‘নাফরমানি’ অথবা ‘আওয়ামী-বাকশালী’ আর কিছু হতে পারে না! এসব মোকাবেলার নামে ভুল পথে এক চিমটে ধর্ম, এক চিমটে সামরিক স্বৈরাচার এসবের জগাখিচুরি মিশেলে আওয়ামী লীগও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতি-আদর্শ থেকে বহুদূর সরে গেছে!

ঢাবি’র সাদা প্যানেলের মতো ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কিন্তু বরাবরই দেশের রাজনীতিতে অ্যান্টি আওয়মী লীগ ঘরানার মানুষ। এখানে মাঝে মাঝে অবশ্য এক চিমটে বঙ্গবন্ধুর নাম না নিলে নিজের একটু নিরপেক্ষ, সুশীল ভাবমূর্তি হয় না, তাই বলেন আর কী! বঙ্গবন্ধু আর জিয়াকে যারা এক পাল্লায় রেখে নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা খোঁজেন, তিনি তাদেরই একজন। সে কারণে হাসিনা-খালেদার মামলা লড়ার পরও বলেছেন, বঙ্গবন্ধু’র মেয়ে আর জিয়ার স্ত্রীর জন্য কিছু করতে পারাকে কর্তব্য মনে করেছেন!

আওয়ামী লীগ-বিএনপির সুবিধাবাদী-সাদাকালোর সমস্যাযুক্ত আইনজীবীদের কারণে অবশ্য তখন ব্যারিস্টার রফিক কোর্টে দাঁড়ানোয় তা দু’নেত্রীর জন্যেই শক্তি হয়েছে। কিন্তু মননে-চিন্তায় ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষেও তিনি সক্রিয় নয়। এখনও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কোর্টে না দাঁড়ালেও যেহেতু খালেদাকে ‘আমাদের নেত্রী’ বলে প্রকাশ্য কবুল করেই ফেলেছেন, সেহেতু তার নেত্রী খালেদা বললে হয়ত তাদের পক্ষেও দাঁড়িয়ে যাবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেন, কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচারী এরশাদের পক্ষে ছিলেন। এখন খালেদা জিয়া বা তার পরিবারের দুর্নীতিকে দুর্নীতি মনে করেন না!

মাঝে মাহমুদুর রহমান মান্নাদের নিয়ে একটি নাগরিক সংগঠন করেছিলেন। বাংলাদেশে এমন একটি শক্তিশালী নাগরিক সংগঠনের বড় অভাব। কিন্তু এই নাগরিক সংগঠনটি কারা কোন উদ্দেশে করেছিলেন, এসব এর মধ্য দিয়েই পরিষ্কার! খালেদা জিয়ার অনশনে গিয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, তিনি হরতালের বিপক্ষে। কিন্তু সেই নাগরিক সংগঠনটি একটি হরতালে সমর্থন দিয়ে বসে! ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’র মতো সেই নাগরিক সংগঠনের সদস্যসচিব মাহমুদুর রহমান মান্নাও তাই ইলিয়াস আলীর বাড়িতে সহানুভূতি জানাতে গেছেন; কিন্তু এ ইস্যুতে নিহত অপর ছ’জনের কারও বাড়ি যাননি বা সে ইচ্ছাও যেন তার করেনি! সেই  নাগরিক সংগঠনে সৈয়দ আবুল মকসুদ যোগ দেওয়ায় অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু সে সংগঠনের মতলব টের পেয়ে সেখান থেকে নিজে নিজেই সরে এসেছেন। কাজেই সে ‘নাগরিকদের নেতা’ ব্যারিস্টার রফিক খালেদা জিয়ার অনশনে গিয়ে ‘আমাদের নেত্রী’ সম্বোধন করে বক্তব্য দেওয়ায় অনেকে অবাক হলেও আমি হইনি।

যা কিছু আমি  গোপন রাখি বা যতো অভিনয়ই করি না কেন, তা কোনো না কোনোভাবে বেরুবেই। আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর ‘ম্যাডাম ডেকেছেন যাই’ বলে তিনি সাংবাদিক বৈঠক থেকে উঠে গিয়েছিলেন। জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের হিসাবে শেখ হাসিনাকে ‘কোটি কোটি মানুষের নেত্রী’ (কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক উচ্চারণে যা অনেক সময় শোনাতো  ‘কুটি কুটি’) আখ্যা দিয়ে বক্তৃতা শুরু করতেন।   আগামী দিনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার হলে রাষ্ট্রপতি হবেন বলে ব্যারিস্টার রফিকেরও কি শখ জেগেছে? শেষ বয়সে এমন শখ অনেকেরই জাগে! না কি তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী বহিষ্কৃত বলে আগামী দিনে কালিয়াকৈর আসনে বিএনপির নমিনেশন কাম এমপি হয়ে মওদুদ আহমদের প্রতিদ্বন্দ্বী হবার ইচ্ছা?

আপনার রাজনৈতিক ইচ্ছা বা সিদ্ধান্তটি আপনার নিজস্ব। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের মতো জাতির বিবেকের মতো কথা বলা লোকজন আমাদের কম। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার এনজিও ব্যবসা আর মার্কিন প্রভুদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক লাইন শব্দও বলেন না। ড. কামালের অনেক কিছু করার সামর্থ্য থাকলেও নানা কারণে তার বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। গ্রহণযোগ্যতার তালিকা থেকে নিজেই নিজের নামটি ছেঁটে ফেললেন ব্যারিস্টার রফিক!

সেটি অবশ্য তার নিজের সিদ্ধান্ত; আর তা ভবিষ্যতে কিছু পাবার আশা থেকেই। কিন্তু সর্বশেষ তিনি যা ছিলেন তার চেয়ে এসব কোনোভাবেই বড় কিছু না। এখন চলতি নতুন পথে জোরকদমে হাঁটা দিলে ‘সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধী মনে করি না’ জাতীয় বক্তব্যও দিয়ে বসতে পারেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। অথবা এমন বক্তব্য তাকে হয়তো দিতেই হবে।

যে কর্মসূচিতে তিনি খালেদা জিয়াকে ``আমাদের নেত্রী`` বলে সম্বোধন করে গদগদ হয়েছেন, সেই একই মঞ্চ থেকে রোববার যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি উঠেছে ---সে খবর বাংলানিউজে প্রকাশিত।
 
আমরা কিন্তু তেমন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার নিন্দা করবো। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় কোনো অর্জন ও অহংকার আমাদের নেই। চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে বেদনার শিয়রে একটি বাসনাই পুষে আসছি; তা হলো, আমাদের স্বজনদের খুনিদের বিচার হবেই। অবশেষে এ বিচারবিরোধী মিছিলে কী ঢুকে যাচ্ছেন ব্যারিস্টার রফিকুল হকও!

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
এমএমকে

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 

[email protected]
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।