ঢাকা, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

আমার লেখালেখি নিয়ে কতশত কথা!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১২
আমার লেখালেখি নিয়ে কতশত কথা!

বিদেশের ব্যয়বহুল জীবনে টিকে থাকার সংগ্রামের মাঝে অনেক কষ্টে সময় বের করে লিখি। এ সংগ্রামটা কী রকমের, তা যারা বিদেশে আছেন, তারাই ভালো জানবেন।

লেখাপড়ার স্বার্থে পর্যাপ্ত ঘুমাতেও পারি না। এ অবস্থাতেই আবার কাজের শিডিউল ধরে ছুটতে হয়। এতে চোখে গ্লুকোমাসহ শারীরিক অনেক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। এই কল্যাণরাষ্ট্রটিতে আমাদের চিকিৎসা ফ্রি, সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা বিষয় সরকারি দায়িত্বে থাকাতে অবশ্য এসব নিয়ে দেশের স্বজনদের মতো দুশ্চিন্তা কম। লেখালিখি করি বিবেকের তাগিদে।

বিদেশে বসে লিখি বলে অনেকে অপরাধও দেখেন। সরাসরি বলেনও, পারলে দেশে আইসা লেখ! কিন্তু কী করবো! আজকাল সাহসের অভাবও তৈরি হয়েছে। দেশে বসে হয়তো অনেক কিছু এভাবে চাঁছাছোলা লিখতেও পারতাম না। মায়ের বাধার বিষয়তো আছেই। সব মায়েরা চান, তাদের ছেলে দেশে ফিরে আসুক। শুধু আমার মা ছাড়া! আমি বিদেশ থাকায় তিনি নাকি চিন্তামুক্ত আছেন! সাগর-রুনি’র মতো ক্লু লেস খুন বা ইলিয়াস আলীর মতো গুম হবার ভয়টাও যে আছে!

সত্য বলতে দ্বিধা নেই, আমি আমার লেখার সমালোচকদের মতো অত সাহসী কেউ না। একেবারেই নিরীহ মধ্যবিত্ত শ্রেণির। মধ্যবিত্ত স্বভাবের মতো মাঝে মাঝে বিদ্রোহ-বিপ্লব করতে ইচ্ছাও করে! যখন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ঘুরি, তখন অনেকে বলতেন, সাইকেলে ঘুরলে ভালো হতো না! আসলে তখন সাইকেল চালাতেও জানতাম না। এদেশে এসে গাড়ি চালানো শিখেছি। কিন্তু বাংলাদেশে গেলে গাড়ি চালানোর সাহস রাখি না। অ্যাডমন্ড হিলারি-শেরপা তেনজিং নোরগে’র এভারেস্ট বিজয়ের কাহিনী পড়ে শিহরিত হয়েছি। কিন্তু কোনোদিন এভারেস্ট অভিযানের কথা কল্পনায়ও ভাবিনি। এখন আমাদের দেশের ছেলেদের কাছে শুধু না, মেয়েদের কাছেও পদানত মাউন্ট এভারেস্ট!

কিন্তু নিজের সমগ্র সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশটাতো আমারও। দেহটা বিদেশে থাকলেও মনটাতো সারা সময় পড়ে থাকে দেশে। দেশের নানাকিছু দেখেশুনে মন যা সায় দেয়, বিবেক যা বলে তা অকপটে বলার-লিখার চেষ্টা করি। বিদেশে যে দেশটিতে এখন আছি, এখানে মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলে। লেবার পার্টি-লিবারেল পার্টির সমর্থক বলে কেউ দলের যা খুশি কাজকর্মকে চোখ বুঝে সমর্থন করে না। এটি দেখে-শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে কিন্তু আগের চেয়ে-স্বাধীন কাঠখোট্টা যে কোন বিষয় সরাসরি লিখার চেষ্টা করি।

কিন্তু সব সময় ভালো লিখতে পারি না। এটি আমার সময়-সামর্থ্য দু’টিরই সীমাবদ্ধতা। নিজের লেখা আমার নিজের কখনো বিশেষ ভালোও লাগে না। এমন একটি অতৃপ্তি নিয়ে লিখেই চলেছি। লিখি বলেই বুঝি সচল-ভালো আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বাধীনতার চল্লিশ বছর গেলেও আজ পর্যন্ত দেশের সব মানুষজন স্বাধীনভাবে কথা বলতে শিখলো না! আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কাছে আওয়ামী লীগের কোনো দোষ নেই। বিএনপির সমর্থকদেরও একই অবস্থা। দুটি পরিবারের সদস্যরা যে কী পরিমাণ দুর্নীতি করতে পারে, সে স্বীকারোক্তি দল দুটির সমর্থকদের কাছে নেই।

দেশ যে শুধু পিছাচ্ছে, সামনে হাঁটছে না, এটিও এর একটি কারণ। আবার আমাদের দেশের যারা সারাদিন আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমালোচনা করেন, তারাও আবার ভোটের সময় নৌকা-ধানের শীষ ছাড়া কিছু বোঝেন না! এর জন্যে দেশের মানুষ কষ্ট পাচ্ছে দেখে মাঝে মাঝে জেদও লাগে! গফরগাঁও’র এমপির প্রকাশ্যে গুলি করার ছবি ছাপা হয়েছে! এমন একটা লোককে তো ভোট দিয়ে এমপি বানিয়েছে তার এলাকার লোকজন! এতবড় ঘটনার পরও আজ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা হলো না! দেশের আইন-কানুন কী সব গেছে!

বাংলানিউজ কন্ট্রিবিউটিং এডিটর পদযুক্ত করে আমার ইদানিং’এর লেখাগুলো ছাপছে। এখন এই কন্ট্রিবিউটার এডিটরের বিষয় নিয়ে একটা গল্প বলি। মীরা এডলার নামে দ্য অস্ট্রেলিয়ানের এক কন্ট্রিবিউটিং এডিটর একবার আমার ক্লাসে অতিথি বক্তা হিসাবে এসেছিলেন। তার সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে একটি প্রশ্নে তিনি বিব্রতবোধ করেন! আমি বাংলাদেশের মানুষতো, তাই তাকে এমন প্রশ্ন করেছিলাম! প্রশ্নটি ছিল লিখার সময় তিনি পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতির কথা মনে রাখেন কী না! বা তার লেখার কোন বক্তব্য সম্পাদকীয় নীতিমালার বাইরে গেলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তা সম্পাদনা করে কী না!

প্রশ্নটির পর আমার বিভাগীয় প্রধান মীরা’র কানে কানে কিছু বলেন। সম্ভবত আমার ব্যাকগ্রাউন্ড তাকে অবহিত করেন বিভাগীয় প্রধান। মীরা আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে জবাব দিয়ে বলেন, ``আমার লেখা তারা এডিট করবে কেন বা আমি তাদের সম্পাদকীয় নীতিমালা মাথায় রেখে লিখবো কেন? আমিতো তাদের স্টাফ না। লেখার বিনিময়ে আমি সেখান থেকে টাকা পাই ঠিক, কিন্তু এরজন্য তো কারও কাছে মাথা বিক্রি অথবা বন্ধক দিয়ে রাখিনি। আমাকে তো পাঠকদের কথা মাথায় রেখে লিখতে হয়। আমার দায়বদ্ধতা তাদের কাছে যারা লেখা পড়ে প্রতিক্রিয়া দেন। সে প্রতিক্রিয়াগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ি। সেখান থেকে খোরাক নেই আমার পরবর্তী কোনো লেখার। ``

বাংলানিউজ কিন্তু তাদের এই কন্ট্রিবিউটিং এডিটরের সব লেখা প্রকাশ করে না। অথবা দেশের পরিস্থিতির কারণে পারে না। আবার এটাও ঠিক আমার অনেক লেখা যে বাংলানিউজ প্রকাশ করে, দেশে অনেকে তা ছাপতো-প্রকাশ করতো কী না সন্দেহ আছে। আজকাল আবার ফেসবুকের কারণে কোনো লেখা অপ্রকাশিত থাকেও না।

এখন এই যে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর এসব লেখালেখি নিয়ে অনেক সমস্যাও হচ্ছে। লেখা যখন যার বিপক্ষে যাচ্ছে তারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে পক্ষেরই হোন না কেন, যা খুশি তাই বলে দিচ্ছেন! বিএনপির লোকজনের ধারণা আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক। আর আওয়ামী লীগের কিছু লোক সারা সময় অনলাইনসহ নানা জায়গায় আমার লেখালেখির বিরুদ্ধে কী কী প্রকারে ঘোঁট পাকান, তা ওয়াকিবহালরা জানেন। আওয়ামী লীগার বা বিএনপি হতে না পারায় আমাকে কখনো জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পর্যন্ত করা হয়নি, বা সেভাবে সদস্য হবার চেষ্টাও করিনি। আমার সহকর্মী অথবা জুনিয়র বন্ধু যারা সাংবাদিকতায় আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ফোরামের সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যতিক্রম বাদে মাশাল্লাহ মোটামুটি প্রায় সবাই প্রেস ক্লাবের সদস্য শুধু না, সরকারি প্লটেরও মালিক। আমিতো কোনোদিন কোনো সরকারি প্লটের জন্যে আবেদনও করিনি বা দেশে থাকতে সে আবেদন করতে যে টাকা দেওয়া লাগতো, সে টাকাও আমার ছিলো না। বিদেশেও থাকি ভাড়া বাসায়। পুরান গাড়ি চালাই। কিন্তু ভালো আছি। শান্তিতে আছি। কোথাও কারও সঙ্গে ঠ্যালা-ধাক্কা-গুঁতোগুঁতিতে নেই। সেখানে সাম্প্রতিক লেখালেখিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সাজানোর প্রতিযোগিতা দেখে বেশ মজাই লাগে! মনে হয় আমি ঠিক আছি।

অনেকে লিখে দেন, আওয়ামী লীগ নাকি আমাকে টাকা দিয়ে লেখায়! বা আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পাবার আশায় নাকি লিখি! এরা এত সরল যে আওয়ামী লীগ কী জিনিস তা চেনেও না জানেও না। আওয়ামী লীগের কী লোকের এতই অভাব পড়েছে যে বিদেশে থাকা নাদান একজনকে টাকা দিয়ে লেখাবে? নাকি  আওয়ামী লীগ এসব করে? বিদেশ থেকে যারা বিএনপি-জামায়াতের হয়ে লিখেন, সেগুলোও কী এভাবে টাকা দিয়ে লিখানো হয়?

আমার সাংবাদিকতার গুরু তোয়াব খানের কাছে একটা বিষয় শিখেছি, তা হলো কোন সাংবাদিকের সেলফ সেন্সরড হতে নেই। একজন রিপোর্টারের কাছে যা তথ্য আসে তা তার রিপোর্টার তার রিপোর্টে আনকাট লেখা উচিত। রিপোর্টারের সে লেখা পত্রিকার অনেক হাত ঘুরে হয়তো প্রকাশিত অথবা নিহত হয়। আমার ওপর আস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তোয়াব খান আমার এমন আনকাট অনেক রিপোর্টই ছেপেছেন। যেমন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম রিপোর্টটি ``কাকরাইল কারাবালাঃ ওয়াসার পানির গাড়ি মন্ত্রীর সখের মাছের খামারে!`` শিরোনামে আমার বাইলাইন ছাপা হয়। আজকের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তখন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। এর আগে কর্নেল অলি আহমদ বিএনপির যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালে মিন্টো রোডের যে বাড়িতে থাকতেন জিল্লুর রহমান সে বাড়িতে ওঠেন। অলি আহমদ সেখানে থাকার সময় মাছ চাষের জন্য সে বাড়ি সীমায় ছোটখাটো পুকুরের মতো একটি পাকা ট্যাংক তৈরি করা হয়। জিল্লুর রহমান সে বাড়িতে ওঠার পর তারও মাছ চাষের সখ হয়! স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসাবে তিনি ওয়াসারও মন্ত্রী। কাকরাইল এলাকায় পানির আক্রা চলছে তখন। লোকজন পয়সা দিয়ে ওয়াসার কাছে পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। আর মন্ত্রীর বাড়ির মাছের খামারের জন্য নেওয়া হয়েছে আট গাড়ি পানি!

একটি সূত্রে খবরটি পেয়ে ওয়াসার মিন্টো রোডের ডিপোতে গিয়ে কৌশলে তাদের খাতা থেকে টুকে আনি আট গাড়ি পানির বৃত্তান্ত। বিস্তারিত তথ্য ঠিকমতো আছে দেখে তোয়াব খান রিপোর্টটি গুরুত্ব দিয়ে ছাপার ব্যবস্থা করেন। একুশ বছর পর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের মধুচন্দ্রিমার সময়ে সে রিপোর্টে অনেকে গোস্বা করেছিলেন! সে আমলে জয়নাল হাজারী, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আলতাফ হোসেন গোলন্দাজদের সন্ত্রাসের রিপোর্টগুলো আমার করার সুযোগ হয়েছিল।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসে। সে নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা-সন্ত্রাসের সরেজমিন রিপোর্ট করা হয়। কালিয়াকৈরের এক তছনছ মন্দিরে দেখি ভাঙ্গা মূর্তির পাশে বসে গীতা পড়ছেন ভীতসন্ত্রস্ত পুরোহিত! গীতার নিচে আবার জনকণ্ঠ ভাজ করে রাখা! পুরোহিত এক লাইন গীতা পড়েন আবার এক লাইন পড়েন জনকণ্ঠ! যে রিপোর্ট এভাবে পুরোহিত পড়ছিলেন, সেটিও আমার করা। পরে পুরো বিএনপি শাসনামলে আমাদের অনেক সমস্যা হয়েছে। আমরা যাতে বেতন না পাই, না খেয়ে মরি, সে জন্য অনেক কিছুই তখন করা হয়েছে! দৈনিক বাংলা বন্ধ হবার পর দুর্দিনে বিএনপিপন্থি অনেক সাংবাদিক জনকণ্ঠে আশ্রয় পেয়েছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় যাবার পর তারা আবার জায়গামতো ফেরত যান। কিন্তু সরকারি আক্রোশ থেকে জনকণ্ঠকে রক্ষার জন্য তাদের কেউ কাজ করেন নি।

আমার দেশের ঘটনার পর সে কথাগুলোই মনে পড়েছে। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নির্বাচনী সফর কভার করা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ঢাকা থেকে মিডিয়ার গাড়ি রওয়ানা দেবার সময় এমন করা হতো, যাতে জনকণ্ঠের লোক গাড়ি ধরতে না পারে! মজার ব্যাপার এসব ক্ষেত্রে কিন্তু অনেকক্ষেত্রে বিটের রিপোর্টাররাই বেশি ভূমিকা পালন করেন! অথবা বিট করতে করতে রিপোর্টারও যেন হয়ে যান দলের সদস্য। একবার খালেদার উত্তরবঙ্গ সফরের সফরসঙ্গী হতে গিয়ে সে সমস্যায় পড়ি। সাংবাদিকদের গাড়ি আগের দিন রওয়ানা হয়ে বগুড়ার পর্যটন মোটেলে গিয়ে ওঠে।

সাংবাদিকদের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, এক সময়কার সাংবাদিক, বিএনপি নেতা আহমেদ নজির। তারা যথারীতি আমাকে না নিয়েই চলে গেছেন শুনে আবার তাদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিতে বিব্রতও লাগে। কিন্তু পেশাগত স্বার্থে এসব লুকিয়ে রাখতে হয়। বগুড়ায় বিএনপির নেতা হেলালুজ্জামান লালু’র সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে বলেন, আপনি যদি নিজে চলে আসতে পারেন তাহলে পর্যটন মোটেলে আমার গেস্ট হিসাবে থাকবেন, আমি বলে রাখবো। তাই করলাম। পরের সকালে সে মোটেলের নাস্তার টেবিলে চক্ষু লজ্জায় কেউ আর আমাকে এড়াতে পারেন না। গাড়িতেও ডেকে নিয়ে তোলা হয়।

সরেজমিন রিপোর্টে আমি সব সময় যা দেখতাম তাই লেখার চেষ্টা করতাম। পরিবেশের গন্ধ-বর্ণনা থাকতে হয় সরেজমিন রিপোর্টে। নতুবা তা রিডারকে টানে না। আমি যেভাবে লিখতাম সেভাবেই জনকণ্ঠে ছাপা হতো। এরপর দেখি জনকণ্ঠ আসার পর গাড়িতে বসেই তা জোরে জোরে পড়ে সবাইকে শোনাতেন আহমেদ নজির ভাই। লজ্জাই লাগতো তখন। তাদের লজ্জা করতো কী না জানি না।

কিন্তু গাড়ি ভর্তি বিএনপিপন্থী বা হয়ে যাওয়া সাংবাদিকরা জানতেন, আমি তাদের বিএনপির লোক না। সেটাই ভালো লাগতো। যেমন আওয়ামী লীগও জানে আমি তাদের না। এটাও ভালো। সাংবাদিকতায় আসার এক বছরের মধ্যে রিপোর্টের কারণে কী করে ৩২ নম্বরে ডেকে নেওয়া হয়েছিল তা হয়তো বাহাউদ্দিন নাছিমের মনে আছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত এ দলগুলোই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের সরকারে যায় বা বিরোধীদলে থাকে। এ চারটির কোনটি না করাতে রিপোর্টার হিসাবে একটা বিষয় এনজয় করি, তাহলো এ চারটির দলের আনন্দ-বেদনা আমাকে স্পর্শ করে না।

তবে জন্মসূত্রে একজন বাংলাদেশি বাঙালি হিসাবে আমার কিছু নিজস্ব অবস্থান আছে। তাহলো মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা-লক্ষ্যগুলোকে আমি ধারণ করে চলা চেষ্টা করি। যার অনেক কিছু এখন আওয়ামী লীগও ধারণ করে না। বিএনপিতো নয়ই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি জাতির পিতা হিসাবে মানি-সম্মান করি। মুক্তিযুদ্ধের জয়বাংলা স্লোগানটি আমারও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি নিয়ে আমি মনে করি এ বিচার যতটা হবার তা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই হবে। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারলে এ বিচার ভণ্ডুল হবে।

এক বন্ধু আমার এ বিষয়গুলো নিয়ে সম্প্রতি একটি অনলাইনে লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন,  ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ এখন সে অবস্থায় নেই’। সীমান্ত হত্যাসহ দেশের নানা কারণকে তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন। এ বিষয়টিই আরও জোরের সঙ্গে বলতে চাই আমি। তাহলো যুদ্ধাপরাধের  বিচারের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কী? চল্লিশ বছর এ বিচার করতে দেওয়া হয়নি। তাতে কী দেশ বেহেস্তে পৌঁছে গিয়েছিল?

না এখন এ বিচার বন্ধ করে দিলে সেখানে পৌঁছে যাবে? আজ এ বিচার বন্ধ করে দিলে কী বন্ধ হয়ে যাবে সীমান্ত হত্যা? বিদ্যুৎ সমস্যা, দ্রম্যমূল্য সব কমে যাবে? নানান ছলচাতুরিতে এ বিচার ঠেকাতে-এড়াতে স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষ নতুন প্রজন্মকে বরাবর এমন কিছু স্বার্থান্বেষী ধারণা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে আসছে, এখনও ঢোকাচ্ছে!

বাংলানিউজে সর্বশেষ ব্যারিস্টার রফিক আর মির্জা ফখরুলের মেয়ে সামারুহ মির্জাকে নিয়ে লিখার পরও বিএনপি-জামায়াতের লোকজন বেজায় ক্ষেপেছেন! এ নিয়ে বাংলানিউজে পাঠানো মেলগুলোর প্রায় সবক’টিই আমাকে ফরোয়ার্ড করে পাঠানো হয়েছে। এসব লেখার মূল সুরটি হলো আমি আওয়ামী লীগের দালাল ইত্যাদি। ব্যারিস্টার রফিকের প্রতি আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতার কথা এদের জানা নেই। যদিও এরশাদের আইনজীবী থাকাকালে একদিন প্রশ্ন পছন্দ না হওয়াতে তিনি সাংবাদিকদের তাড়াও করেছিলেন। কিন্তু তার সবকিছুর চেয়ে আইন ব্যবসার টাকায় একটি এতিমখানা চালানোর বিষয়টি আমার কাছে বড়।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শিক্ষক, সরকারি চাকুরে থাকার সময় থেকে তাকে ভদ্রলোক হিসাবে জানি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট তাকে জোগাড় করতে হবে কেন? এটা কী কোন ভদ্রলোকের কাজ হয়েছে? একাত্তরে ঠাকুরগাঁও’তে পাকিস্তানিদের পক্ষে শান্তি কমিটি গঠনের পর এর সদস্য হন মির্জা ফখরুলের বাবা মির্জা রুহুল আমিন চোখা মিয়া। এরপর আবার মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট বাড়ার পর ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ভারতে আত্মীয়ের বাড়িও চলে যান। তা তিনি কী ভারতে গিয়ে অন্যদের মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন? না দেশে ফিরে নিয়েছেন?

প্রথমে জিয়া ও পরে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেন মির্জা রুহুল আমিন চোখা মিয়া। এরশাদ তাকে ব্যবহার করে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে না দেওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গেই ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বাবা। মুক্তিযুদ্ধে এই পিতা-পুত্রের ভূমিকার তথ্য ঠাকুরগাঁও’র মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাওয়া। ভারতে যাওয়া চোখা মিয়া যে রাজাকার ছিলেন একজন এর প্রমাণ দিতে বলেছেন। তথাকথিত শান্তি কমিটিতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন নিয়ে গড়া হয়নি। একাত্তরের ঠাকুরগাঁও’র রাজাকারদের সংগঠন শান্তি কমিটির তালিকায় মির্জা রুহুল আমিন চোখা মিয়ার নাম ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলে তার মতো লোকের নাম বাদ পড়তো না। পিতার কারারুদ্ধ জীবন নিয়ে মেয়ে হিসাবে বেদনায় নীল লিপিমালা লিখেছেন সামারুহ মির্জা। তার প্রতি ব্যক্তিগত সহানুভূতি জানিয়েই লিখেছি, নগরের এই আগুন একদিনে তৈরি হয়নি। হরতাল সন্ত্রাসও বন্ধ হওয়া দরকার। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে পক্ষে নেয়া তার পিতার পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন না মুক্তিযোদ্ধা ড. আনোয়ার হোসেন। তার ভাই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে ষড়যন্ত্রমূলক বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছেন মির্জা ফখরুলের নেতা জিয়াউর রহমান। এসব লিখলে কী আওয়ামী লীগ হয়ে যাওয়া হয়? যাক, এসব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেখে মনে হয় রাইট ট্র্যাকেই আছি! আমিতো সবাইকে খুশি করে চলতে পারবো না। বা চেষ্টাও করি না। এমন দলীয় স্বার্থচিন্তাকে কেন্দ্র করে খাওয়া চলে, নানা কিছু চলে, লেখা চলে না। তোমার জন্য লিখে যাবো বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের শত্রু-খুনিদের, তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে লিখে যাবো। যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ...!

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর ; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।