ঢাকা, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

হুমকির মুখে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম

সুদীপ্ত সালাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৩ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১২
হুমকির মুখে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম

২৬ মে একদল পুলিশ তিন ফটোসাংবাদিককে পিটিয়েছে। মারের ধরণ দেখে মনে হয়েছে, ওই পুলিশ সদস্যদের কাছে পকেটমার ও সাংবাদিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

এই ইস্যুটি নিয়েই লিখতে বসেছিলাম। এমন সময় খবর এলো, অনলাইন বার্তা সংস্থা বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম অফিসে ঢুকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কসাইযের মতো সাংবাদিকদের কুপিয়েছে। কয়েকজন সাংবাদিকের অবস্থা গুরুতর। স্ত্রী বলেই ফেললোÑ সাংবাদিকতা ছেড়ে দাও। আমি উত্তর দিতে পারিনি। আসলেই তো আমরা নিরাপদ নই। কেউ নিরাপদ নই। আমি এখন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত।
 
সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যন্ত সবাই যেন সাংবাদিকদের পেয়ে বসেছে। সাংবাদিকদের প্রাণের যেন দু’পয়সাও মূল্য নেই।

এই শোচনীয় পরিস্থিতি কি একদিনে তৈরি হয়েছে? না। রাষ্ট্রীয় সিংহাসনে যারাই আরোহন করেন তারাই গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নেন। আমাদের দেশে এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। ফলে গণমাধ্যমের ওপর চলে সরকারি রোলার। বর্তমান সরকারের আমলেও বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটেনি। যৌক্তিক হোক বা না হোকÑ মহাজোট সরকারও গণমাধ্যমকে বারবার পদদলিত করেছে। সরকারি পর্যায় থেকে যখন সাংবাদিকতাকে অপমান করা হয়, পদদলিত করা হয়, দলীয়করণ করা হয় তখন নিচের পর্যায়ের ব্যক্তি ও সংস্থাও সাংবাদিকতাকে ঠুন্কো পেশা হিসেবে ধরে নেয়। এটাই স্বাভাবিক।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিজ বাসায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। খুনিদের ধরতে রাষ্ট্র কিছুই করতে পারেনি। এ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন,  ‘বেডরুমে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়’। এই মন্তেব্যের পর পুলিশ যদি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাহলে দোষ দেয়া যাবে? এই সরকার ক্ষমতায় এসেই চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিলো। চ্যানেলটিতে কর্মরত কর্মীবাহিনীর কথা একবারও ভাবা হলো না। যমুনা টিভিকে আসতে দেয়া হলো না। টেলিভিশনটি শুরু হওয়ার আগেই বেকার হয়ে পড়লো বহু সংবাদকর্মী। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কারাদণ্ড ভোগ করলেন। পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টাও চললো। কোনো মতে টিকে গেলো পত্রিকাটি। ভাগ্য ভালো হলো না অনলাইন বার্তা সংস্থা শীর্ষনিউজডটকমের। সম্পাদককে নেয়া হলো রিমান্ডে। বন্ধ হয়ে গেলো সংবাদ সংস্থাটি। বেকার সাংবাদিকের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। র‌্যাব সদস্যরা ২০০৯ সালে ডেইলি নিউ এজ-এর সাংবাদিক মাসুমকে বেধড়ক পেটালো এবং ২০১১ সালে বাংলাভিশন চ্যানেল ভবনে ঢুকে একাধিক সংবাদ কর্মীকে আহত করেলো। পুলিশ-র‌্যাব সম্পৃক্ত এমন বহু ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে। আইন-প্রণেতারাও পিছিয়ে নেই। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী, সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার, সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ সাংবাদিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনা করার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। কোনো ঘটনারই কি সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে? হয়নি, হচ্ছে না। সাংবাদিক নির্যাতিত হলে কিছুই হয় না, এমনকি সাংবাদিক মেরে ফেললেও বিচার হয় নাÑ এই ধরনের বার্তা যখন সমাজে ছড়িয়ে পড়ে তখন সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য।
 
এই সরকারের আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত করার ষড়যন্ত্রও কি কম হয়েছে? সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে দাঁড়িয়ে সংবাদপত্রের সাংবাদিক-সম্পাদকদের গালাগাল করেছেন, তথ্য মন্ত্রণালয় একটি বিতর্কিত নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে; বিরোধী দলের জনসভা টিভিতে প্রচার করতে দেয়া হয়নি। এমন অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ করা যাবে। এই দমনের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমগুলো যখন সোচ্চার হয়েছেÑ তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলেছেন---- সংবাদমাধ্যমগুলো নাকি যা ইচ্ছে তাই বলছে।

ইতিহাস বলে, সরকার যখন অনুভব করে পায়ের নিচে মাটি নেই, জনসমর্থন ভঙ্গুর তখনই দেউলিয়ার মতো আচরণ করা শুরু করে। মারমুখি আচরণ সে সরকারের প্রধান লক্ষণ। সংবাদমাধ্যম তখন সে দেউলিয়া সরকারের প্রধান শত্রু হিসেবে চি‎হ্নিত হয়। এই পরিস্থিতির সুযোগ সন্ত্রাসীরা নেবে, সরকার সমর্থিত বাহিনীগুলো নেবে এটাই সাধারণ রীতি। বর্তমান অবস্থা বলছেÑ সংবাদমাধ্যম সরকারের টার্গেট।

সুদীপ্ত সালাম: ফটোসাংবাদিক ও লেখক

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।