ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জনগণ উদ্ভাবিত ধারণা টিআরএম এবং...

গৌরাঙ্গ নন্দী, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৮ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১২
জনগণ উদ্ভাবিত ধারণা টিআরএম এবং...

যশোরের মনিরামপুরে এলাকাবাসী জাতীয় সংসদের হুইপ স্থানীয় এমপি আব্দুল ওহাবকে লাঞ্ছিত করেছে। এমপি ও তাঁর সঙ্গীদের গাড়িতে আগুন দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো কর্তাদের গাড়িতেও আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনগণ। এমপি সমর্থক ও পুলিশ সম্মিলিতভাবে  গ্রামবাসীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। পরে স্থানীয় বাজারে লুটপাট হয়েছে(গত ৩ জুন এ সংক্রান্ত সংবাদ দৈনিক পত্রিকাগুলোর আকর্ষণ বাড়িয়েছে। তবে আগেরদিন একই সংবাদ বাংলানিউজসহ অনলাইন সংবাদ সংস্থা ও টিভি চ্যানেলগুলোতেও ছিল হট আইটেম)।

ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, হুইপ গিয়েছিলেন জোয়ারাধার (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্টÑটিআরএম) প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করতে। কিন্তু এলাকাবাসী টিআরএম প্রকল্প চান না। একারণে তারা দীর্ঘদিন ধরে বিরোধিতা করে আসছেন। ২ জুন যখন এমপি, পাউবো কর্তারা প্রায় পণ করে গিয়েছিলেন, প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেনই, তখনি এলাকাবাসী (অবশ্যই একাংশ) তাদের প্রতিরোধ করে। এর ফলে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনতা কেন ক্ষুব্ধ হলো?

এর সহজ উত্তর হচ্ছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি (টিআরএম) এলাকাবাসী চান না। তারা এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হোক তা চান না, এ কারণে সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রকল্প কার্যক্রমে বাধা দিয়েছেন।

তবে কি টিআরএম জনগণের জন্যে অমঙ্গলজনক? না হলে জনগণ বাধা দেবেন কেন?

প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা একটু পেছনের দিকে যেতে পারি।

টিআরএম ধারণার গোড়ার কথা
টিআরএম কথাটি ইরেজি টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর। একে বাংলায় জোয়ারাধার বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি জোয়ারের পানি ব্যবস্থাপনা। অন্যকথায়, জোয়ারের পানিতে আসা পলি ব্যবস্থাপনা। প্রকৃতপক্ষে, জোয়ারের পানি পরিকল্পিতভাবে বিলে প্রবেশ করিয়ে বিলের নিচুভূমিতে পলি অবক্ষেপণের মাধ্যমে বিলভূমি উঁচু করার প্রক্রিয়াকে জোয়ারাধার বা টিআরএম বলা হচ্ছে। যদিও টিআরএম কথাটি দিয়ে এর যথাযথ তাৎপর্য প্রতিফলিত হয়না। তবুও টিআরএম শব্দটি এখন বহুল পরিচিত।

সেই ১৯৮৫-৮৬ সাল। আজ থেকে সিকি শতাব্দীরও আগের কথা। সেই সময়ে খুলনার ডুমুরিয়া-ফুলতলা উপজেলা জুড়ে যে বিল ডাকাতিয়া তাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বদ্ধ জল বিল ছাপিয়ে গ্রাম, লোকালয়, আবাসস্থল, গৃহস্থের বাড়ি সব তলিয়ে দেয়। কৃষিজীবী মানুষগুলো অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টে পড়ে। বিলে পানি আটকে থাকায় ফসল ফলে না। উপরন্তু সাপ ও অন্যান্য বিষধর সরীসৃপের উৎপাত বেড়ে যায়।

এলাকাবাসী প্রতিবাদী হন। এলাকায় সভা-সমাবেশ করে, প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড Ñপাউবো কর্তাদের কাছে একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়ে সমস্যা সমাধানের দাবি জানাতে থাকেন। কিন্তু প্রশাসন একেবারেই কোনো উদ্যোগ নেয় না। মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়তে থাকে। এভাবেই বছরের পর বছর যেতে থাকে। দুর্ভোগে থাকা মানুষগুলো তখন এই সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলে, বিশাল এই বিলের পানি বেরুতে পারছে না, তার কারণ, পানি নিষ্কাশনের পথ অর্থাৎ পাউবো’র স্লুইস গেটগুলো অকেজো এবং স্লুইস গেট সংলগ্ন নদী বা নদী-সংযোগ খালের গভীরতা কমে বা শুকিয়ে গিয়ে বিলভূমি থেকে তা উঁচু হয়ে গিয়েছে। ফলে বিলের পানি না বেরুতে পেরে আটকে আছে।

এর সমাধান হিসেবে এলাকার ভূক্তভোগী জনগণ ২৫ নং পোল্ডারের মাটির বাঁধের চারটি জায়গাÑ শলুয়া, আমভিটা, সন্ধ্যার খাল সংলগ্ন এলাকা এবং থুকড়ায় বাঁধ কেটে দেয়। অবশ্য, ১৯৯০ সালে বাঁধ কেটে দেয়ার এই ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবে ঘটেনি। বাঁধ কেটে দিয়ে এলাকাবাসী শান্তি বিনষ্ট করছে ও আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে এই অভিযোগে একাধিকবার ১৪৪ ধারা জারি ও বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে জনগণের এই উদ্যোগকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংগঠিত ভূক্তভোগী জনতা প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে বাঁধ কেটে দেয়।

বাঁধ কেটে দিয়ে নদীর সাথে বিলের সরাসরি সংযোগ করে দেয়ায় জোয়ারের পানি বিলে প্রবেশ করে। নদীর নোনা পানি তীরবেগে বিলের মধ্যে প্রবেশ করে, আর ভাটায় তা টেনে নিতে থাকে। কেটে দেয়া জায়গাগুলোর মধ্যে সন্ধ্যার খাল নামের জায়গায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। নদীর পানির চাপে এই খাল বিশাল নদীতে রূপ নেয়। এর ভাটিতে থাকা হামকুড়া নদী আবারও তার হারানো যৌবন ফিরে পায়। আর জোয়ারে আসা বিপুল পরিমাণ পলি সন্ধ্যা খালের মুখে বিল ডাকাতিয়ার মধ্যে পতিত হয়ে পাঁচশো একরেরও বেশি ভূমি উঁচু হয়। মানুষ নতুন দিশা পায়। তারা ধরে নেয়--জোয়ারের পানিতে আসা পলি ভূমিতে থিতু হতে দিলে বিলভূমি উঁচু হয়ে জলাবদ্ধতা মুক্ত হতে পারে।

এই ভাবনার আলোকে একদল মানুষ ভদ্রা নদীর পাড়ে ভায়নার বিলে জোয়ার-ভাটার সংযোগ ঘটায়। এবং ইতিবাচক ফলাফল পায়। ভায়নার বিলে এখন জলাবদ্ধতা দেখা দেয়না। এলাকার মানুষ সোনার ফসল ফলায়। ’পানি কমিটি’ নামের একটি নাগরিক সংগঠন তখন জনগণের এই ধারণাটির যথার্থতা প্রমাণের জন্যে পাউবো কর্তাদের আহ্বান জানায় এবং এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যে প্রচলিত বাঁধ, স্লুইস গেট, রেগুলেটর প্রভৃতির কারিগরি পদ্ধতি নয়, জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে বিলে পলি অবক্ষেপণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি গ্রহণের দাবি জানায়। এবং এই প্রাকৃতিক পদ্ধতি এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনের যথাযথ ও উত্তম পদ্ধতি বলে তুলে ধরে।

তারা আরও বলে, ১৯৬০ সালের কোস্টাল এমব্যাঙ্কমেন্ট প্রজেক্ট-সিইপি’র মাধ্যমে যে পোল্ডার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, তার ফলে এই এলাকার অসম্পূর্ণ ভূমি গঠন প্রক্রিয়া (ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে খুলনাঞ্চল তথা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল গাঙ্গেয় পলল ভূমি এবং এর ভূমি গঠন প্রক্রিয়া এখনও চলেছে) বাধাগ্রস্ত হয়। এতে নদীর জোয়ারে আসা পলি বিলে পড়তে না পেরে তা স্লুইস গেট, রেগুলেটর, নদীর তলদেশে জমা হতে থাকে। ধীরে ধীরে নদীগর্ভ উঁচু হতে থাকে, একপর্যায়ে নদী শুকিয়ে যেতে থাকে। নদী মরে গিয়ে নিষ্কাশন চ্যানেল বন্ধ এবং উঁচু হয়ে যায়; পক্ষান্তরে বিলভূমি নিচুই থেকে গিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।         

বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, পাউবো কর্তারা তখন জনগণের এই ধারণাটি মেনে নিতে পারেননি। তারা জনগণের এই ধারণাটি একেবারে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। পাউবো এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যে খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্প বা কেজেডিআরপি নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এডিবি) সহায়তা পুষ্ট ২২৯ কোটি টাকার ওই প্রকল্পেও বাঁধ, স্লুইস গেট, রেগুলেটর নির্মাণের কথা বলা হয়।

এতে জনগণ বিরোধিতা করে। জনগণ জোয়ারের নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পলি অবক্ষেপনের পদ্ধতি অনুসরণের জন্যে দাবি জানাতে থাকে। এটি দাতা সংস্থা এডিবি’র প্রেসিডেন্টকেও অবহিত করা হয়। এক পর্যায়ে এডিবি প্রকল্পের এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা ইআইএ এবং সোস্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা এসআইএ করতে সম্মত হন। নিয়োগ দেয়া হয় পরামর্শক। ওই পরামর্শকের কাজের মধ্যে জনগণের এই ভাবনাটি সম্পর্কে মতামত দেয়ার কথা বলা হয়। ওই পরামর্শক তার রিপোর্টে জনগণের এই ধারণাটি গ্রহণ করে তাকে খুবই কার্যকরী বলে মত দেন। এবং সেই রিপোর্টে এই পদ্ধতিটির নাম দেয়া হয় টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট বা টিআরএম।

বলাইবাহুল্য, ওই প্রতিবেদনে পানি ব্যবস্থাপনায় টিআরএম পদ্ধতি গ্রহণের পক্ষে অভিমত দিয়ে বলা হয়, টিআরএম-এর ফলে বিলভূমি উঁচু হবে, নদী টিকে থাকবে এবং এলাকা জলাবদ্ধতা মুক্ত হবে। পাউবো সেই সময়ে টিআরএমকে গ্রহণ করেনি, তবে কেজেডিআরপি প্রকল্পের কিছু পরিবর্তন করেছিল মাত্র।

কেজেডিআরপি বাস্তবায়নের পর পাউবো দাবি করেছিল, বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়েছে। তাদের এই দাবি অংশত ঠিক হলেও গোটা বিল ডাকাতিয়া এখন অসংখ্য পুকুরের চেহারা নিয়েছে। কিছু অংশে সারাবছর পানি আটকে থাকে। তবে এর প্রতিক্রিয়াটি পড়ে অপেক্ষাকৃত উত্তরের ২৪ নং পোল্ডার তথা ভবদহ এলাকায়।

ভবদহ এলাকার হরি-মুক্তেশ্বরী-টেকা নদীর মুখে সিইপি’র আওতায় ২১ ভেন্টের এবং ৯ ভেন্টের দু’টি স্লুইস গেট তৈরি করা হয়েছিল। এই গেট দু’টো দিয়ে উত্তরের ২৬টি বিলের পানি নিষ্কাশিত হওয়ার কথা। কিন্তু নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় গেটগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে।

এছাড়া, কেজেডিআরপি বাস্তবায়নের পর শ্রী-হরি-ভদ্রা অববাহিকা দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকে। বিল ডাকাতিয়া সংলগ্ন সন্ধ্যার খাল-হামকুড়া অববাহিকা পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। এতে দক্ষিণের ভদ্রাও শুকিয়ে যায়। আর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভবদহ এলাকা বলে পরিচিত বিশাল জনপদ- প্রধানতঃ মণিরামপুর, অভয়নগর উপজেলার বেশীরভাগ এলাকা এবং কেশবপুর উপজেলার আংশিক এলাকা জলাবদ্ধ কবলিত হয়ে পড়ে।

আর কপোতাক্ষ শুকিয়ে যাওয়ার ফলে কেশবপুর, কলারোয়া, ডুমুরিয়া ও তালা উপজেলার প্রায় পুরো এলাকা বর্ষা মওসূমে জলাবদ্ধ কবলিত হয়ে পড়ে। ২০০৯ এবং ২০১১ সালে যা ভয়াবহ রূপ নেয়।
এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএম বাস্তবায়নের অব্যাহত দাবির মুখে পাউবো খুবই অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও বিল কেদারিয়ায় টিআরএম প্রকল্প চালু করে। তবে টিআরএম-এর জন্যে পরিকল্পিতভাবে বাঁধ কেটে জোয়ারের পানি প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা তারা করেনি, তারা স্লুইস গেইট দিয়ে পানি প্রবেশ করানোর চেষ্টা করে। এতে টিআরএম-এর প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। আর যেহেতু টিআরএম-এ নদীর জোয়ারের পানি বছরের পর বছর (কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর) আটকে রাখতে হয়; জমির ব্যক্তি মালিক ওই জমিতে কোনো উৎপাদন কর্মকাণ্ড করতে পারেন না, সেকারণে ওই প্রকল্প চলাকালে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে।

কিন্তু পাউবো বিষয়টিতে শুরু থেকেই কেমন যেন অবহেলা করেছে। তবে জনতার অব্যাহত চাপে এবং পানি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত অপরাপর বিশেষজ্ঞগণ যেমন ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এবং সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (সিইজিআইএস) এর পক্ষ থেকে টিআরএমকে গুরুত্ব দেয়ায় বিষয়টি জনপ্রিয় হতে থাকে; পাশাপাশি পাউবো-ও তা মানতে শুরু করে। পরবর্তীতে পাউবো বিল খুকশিয়ায় টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু বিল খুকশিয়ায় এই টিআরএম প্রকল্প সাত বছরেও শেষ হয়নি এবং ফলাফল ইতিবাচক নয়।

বলা যায়, পাউবো’র দু’টি টিআরএম প্রকল্পই সফল হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে।

পাউবো’র টিআরএম ব্যর্থতা এবং জনরোষ
বিল খুকশিয়ায় পাউবো’র টিআরএম ব্যর্থতার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, টিআরএম কার্যক্রমে জন-অংশগ্রহণ না থাকা; জোয়ারের পানি প্রবেশ করানোর জন্যে বাঁধের কাটাস্থান (কাট পয়েন্ট) ঠিক না হওয়া; বিলে পলি অবক্ষেপনের বিষয়টি যথাযথ মনিটরিং না করা (জোয়ারের স্রোত যেখানে গিয়ে থামে সেখানে পলি জমা হয়, আর পলি জমা হতে হতে উঁচু হয়, তখন পলি সরিয়ে দিতে হয়); বিলের জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ না পাওয়া; জলাবদ্ধ বিলে একশ্রেণীর স্বার্থান্ধ চিংড়ি ও মাছ চাষীর এর বিরোধিতা করা। তবে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী সাধারণ মানুষকে টিআরএম বিরোধী অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে প্রধানতঃ দু’টি কারণে: এক, পাউবো কর্তৃক টিআরএম-এর নামে বছরের পর বছর বিলে পানি আটকে রাখা এবং দুই, ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়া। প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ২৭ এপ্রিল বিল খুকশিয়ায় টিআরএম চালু হয়, আর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া শুরু হয়।
    
প্রকৃতপক্ষে, বিল কেদারিয়ার টিআরএম ব্যর্থতার কারণে এলাকাবাসী বিনা ক্ষতিপূরণে পাউবো’র তত্ত্বাবধানে বিল খুকশিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়নে রাজি ছিল না। কিন্তু ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার ছাড়াই  টিআরএম চালুর পর দেখা যায়, ভবদহ এলাকার পানি বিল খুকশিয়ায় প্রবেশ করছে। এতে জোয়ারাধারের পানির উচ্চতা দেড় ফুট বেড়ে গিয়ে পেরিফেরিয়াল বাঁধ হুমকির সম্মুখীন হয়। এতে জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়। এ অবস্থায় উপায়হীন ভূক্তভোগী মানুষেরা দুই মাস আঠারো দিন পর বাঁধের কাটা জায়গাটি (কাট পয়েন্ট) আবারও বেঁধে দেয়।

প্রকৃতপক্ষে, আইডব্লিউএম-এর সুপারিশ ও জনমত উপেক্ষা করে পাউবো তাদের খুশীমত কাট-পয়েন্ট নির্ধারণ করে। যে জায়গাটি ছিল টিআরএম বাস্তবায়নের অনুপযোগী।

এছাড়া, পাউবো বিল খুকশিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করে তিন বছর। কিন্তু বিল ভায়নার অভিজ্ঞতা এবং সিইজিআইএস’র রিপোর্ট অনুযায়ী এটি স্পষ্ট যে, পাউবো যদি সঠিকভাবে টিআরএম বাস্তবায়ন করে তাহলেও বিল খুকশিয়া ভরাট হয়ে চাষাবাদের উপযোগী হতে ৯ থেকে দশ বছর সময় প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ ২০০৬ সালে শুরু হওয়া এই টিআরএম-এর সফলতা আগামী ২০১৫-১৬ সালের দিকে পাওয়া যেতেও পারে। টিআরএম বাস্তবায়নের চার বছর পর ২০১১-এ এসে এলাকাবাসী এই টিআরএম নিয়ে খুবই হতাশ হয় ও ক্ষোভ প্রকাশ করে।

তারা ক্ষতিপূরণ না পেয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। গোটা বিষয়টি এলাকাবাসী ও পাউবো কর্তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে মুখোমুখি দাঁড় করায়।

ফলাফল
পাউবো’র অধিকাংশ কর্তা ব্যক্তিরা এখন অন্ততঃপক্ষে মুখে বলেন, এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনের একমাত্র উপায় টিআরএম বাস্তবায়ন করা। এতে নদী বাঁচবে, নিষ্কাষণ পথ উন্মুক্ত হবে এবং জলাবদ্ধতা দূরীভূত হবে। কিন্তু পাউবো’র প্রতি আস্থাহীন জনগণকে আস্থায় আনার জন্যে পাউবো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্যে সামাজিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি ছিল। টিআরএম বাস্তবায়নের জন্যে বছরের পর বছর আন্দোলন-সংগ্রামে যেসব নাগরিক সংগঠনগুলো এই দাবিটি জনপ্রিয় করে তুলেছে, এই আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে মানুষকে সম্পৃক্ত করেছে, তাদেরকে পাউবো কাজে লাগাতে পারতো।

কিন্তু পাউবো সেপথে না হেঁটে, শুধুমাত্র প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিল কপালিয়ায় টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। ফলে স্বার্থান্বেষীরা অতি সহজেই সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলে ২ জুন তাণ্ডব চালায়। সরকারি অর্থাৎ জনগণের সম্পত্তি জনগণই ভাংচুর, তছনছ করে।

অথচ পাউবো এবারে প্রতি একর জমির জন্যে ৪৮ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধুমাত্র একদেশদর্শী ভাবনা, জনতার মনোভাবকে গুরুত্ব না দেয়া, টিআরএম-এর পক্ষের নাগরিক সংগঠনগুলোকে উপেক্ষা করা প্রভৃতি কারণে জনগণ উদ্ভাবিত জোয়ারাধার ধারণাটি আজ একশ্রেণীর জনগণের বিরোধিতার মুখে পড়ে ভেস্তে যেতে বসেছে।

মনে রাখা দরকার, সিইপি’র মাধ্যমে আমরা খুলনাঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের যথেচ্ছ ক্ষতি করেছি, এখনও যথাযথ উদ্যোগ নিলে কয়েকটি নদী বাঁচানো সম্ভব, এই অঞ্চলে জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব।
আমরা কেন জনগণকে সেকথা বোঝাতে পারছি না? তবে কি এটাও স্বার্থান্ধ মানুষের মত পাউবো’র ঘাপটিমারা  স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর কাজ? যারা সমস্যার শুধুমাত্র কারিগরি সমাধান খোঁজেন এবং জনগণ উদ্ভাবিত টিআরএম ধারণা ছুঁড়ে ফেলে দিতে মরিয়া; সেই গোষ্ঠী-ই কি এই ধারণা বাতিল করার জন্যে জনতা এবং জনতার প্রতিনিধিদের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিল! যাতে অদূর ভবিষ্যতে ঘোষণা করা যায় যে, জনগণ চায় না একারণে টিআরএম বাতিল করা হলো? সংশ্লিষ্ট সকল মহলকেই বিষয়টি ভেবে দেখার বিনীত অনুরোধ করি।  

গৌরাঙ্গ নন্দী: সাংবাদিক (খুলনা ব্যুরো প্রধান, কালের কণ্ঠ)
[email protected]

সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।