ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এবার তোরা মানুষ হ

পি.আর.প্ল্যাসিড, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৪ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১২
এবার তোরা মানুষ হ

অনেক আগের কথা, একটি বাংলা ছায়াছবি দেখেছিলাম টিভিতে, পরে আবার হলেও দেখেছিলাম। ছবির নাম ছিল ‘‘আবার তোরা মানুষ হ”।

এতদিন পর ছবির কাহিনী পুরোটা বলতে না পারলেও কিছুটা মনে আছে। ছবির নামকরণের সার্থকতা খুঁজি আমি প্রায়শই। সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই সিনেমার নামটি মনে পড়ল। সিনেমার নামটি একটু বদলে দিয়ে মন চাইলো, যেন বলি, ‘‘এবার তোরা মানুষ হ”।

‘এবার’ আর ‘আবার’ যাই বলি ওরা কিন্তু জন্ম থেকেই মানুষ। যাদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, তারা মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়ার কারণেই কিন্তু মানুষ। অতি দুর্ভাগ্যজনক হলেও মানুষ হয়ে মানুষের সাথে মানুষের মতো আচরণ না করার কারণেই আহবানটা: আবার তোরা মানুষ হ। আর আমি বলতে চাই ‘এবার তোরা মানুষ হ’।

মিয়ানমারের পূর্ব নাম বার্মা। ১৯৭৯ এর কথা। আমি তখন নাগরী সেন্ট নিকোলাস হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার কেনডিডেট, থাকি হোস্টেলে। পরীক্ষার আগে আমরা স্কুল থেকে কক্সবাজার গিয়েছিলাম রিফ্রেসমেন্টের জন্য। দলে আমরা সাতজন আর গাইড হিসাবে ছিলেন আমেরিকান ব্রাদার (মিশনারি) নিকোলাস (সহ-প্রধান শিক্ষক)। সেবারই প্রথম কক্সবাজার যাওয়া হয় আমাদের। সেখানে প্রচণ্ড ঝড়ের মাঝেও আমরা সমুদ্রে গোসল করে বৃষ্টিতে ভিজে হোটেলে ফিরছিলাম। তখন গায়ে পড়ে স্থানীয় কয়েকজন আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে এলো। শুরু হয়েছিল আমাকে নিয়েই। আমার পরনে ছিল ইন্ডিয়ান বিশেষ ছাপার লুংগি। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হল, এই কাপড় বার্মার মেয়েরা পরে, আমি পরলাম কেন?। আমি কেন মেয়েদের পোশাক পরলাম, এর জবাব তাদের দিতেই হবে। এদিয়েই ঝগড়ার শুরু। পরে জানলাম ওরা বার্মিজ। সেদিনই আমি জানলাম বার্মা একটি দেশ আর বার্মার নাগরিকদের বলা হয় বার্মিজ। আর মেয়েদের পোশাক  ঐ লুংগী।

এরপর ১৯৯১ সনে আমি জাপান আসার কিছুদিন পর একটি ফাইভ স্টার হোটেলে কাজ নিলাম। সেখানে ইন্টারভিউ দিতে যাবার পর প্রথমেই আমাকে দেখে বলল,  তোমাদের বাংলাদেশের কিছু লোক আছে এখানে, অন্য শিফটে কাজ করে। আমি মনে মনে খুশি হলাম। খুশি হলাম এজন্য যে, কাজের সময় বাংলাতে অন্তত কথা বলে কিছু না পারলে বা না বুঝলে শেয়ার করা যাবে। ওদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে খাবার রুমে দেখা হত রেস্ট টাইমে; কিন্তু কোনোদিন কথা হতো না। একদিন যখন আমাকে ম্যানেজার ডেকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওদের সাথে, তখনই মুখ খুললাম। কিন্তু বাংলা ভাল বলতে পারছিল না দেখে আমি তখন অনেকটা অবাকই হয়েছিলাম, বাঙালি অথচ বাংলা বলতে পারে না, এ কেমন বাঙালি?

একসাথে কাজ করা বাংলাদেশিরা আমাকে অনেকটা এড়িয়ে চলতে শুরু করল। আমিও ওদের হাবভাব দেখেও খুব একটা পাত্তা দিতাম না। কিন্তু সেখানে একধরনের অন্যায় করে কাজ ছেড়ে দিয়েছিল ওরা কয়েকজন একযোগে। এরপর আমাকে প্রায়ই কর্তৃপক্ষ বলতে থাকে, তোদের বাংলাদেশিরা লোক ভাল না। তোদের দেশের লোককে আর এই হোটেলে কাজ দেওয়া যাবে না। বিষয়টি আমার কাছে খুব খারাপ লাগছিল। এরপর আমিও বাধ্য হলাম ওদের কারণে কাজ ছাড়তে। এত ভাল কাজ ছাড়তে মন না চাইলেও বাধ্য হয়েছিলাম। কাজ ছাড়ার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ওরা বাংলাদেশর পাসপোর্টধারী হলেও আসলে ওদের বাড়ি বার্মাতে। তথ্য নিয়ে জানতে পারলাম, ওরা ওদের দেশ থেকে খুব সহজে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দালালকে টাকা দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। ওরা সেখানে গিয়েছে, সেখানেই অন্যায় বা অপরাধ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
 
জাপানে এখনও বেশ কিছু বার্মিজ আছে যারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট বহন করছে (তথ্যসূত্রে জানতে পারি প্রায় ২০০ রোহিংগাকে জাপান রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে)। দূতাবাসে গত প্রায় দশ বছর আগে একজন অফিসারের সাথে জাপানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট নবায়ন ও নতুন পাসপোর্ট ইস্যু নিয়ে কথা বলার সময় এই একই বিষয় জানলাম, জাপানেও ওরা বিভিন্ন অপরাধ করছে। ধরা পড়লে নিজেদের বাংলাদেশি বলে দাবি করছে। অথচ ওরা বাংলাদেশের নাগরিক নয়, যদিও বহন করছে বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট।  

এরপর থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সময়কার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনাকালে নানা কথা শুনলেও মিয়ানমারের বিষয়গুলো এইভাবে কখনও মাথায় নিইনি, এবারে রোহিংগাদের বিষয়ে জানতে গিয়ে যতটা জেনেছি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে রোহিংগাদের অনুপ্রবেশ বেশি ঘটে। ধর্মীয় অনুভূতির কারণে বাংলাদেশে এরা বিভিন্ন গোষ্ঠি বা রাজনৈতিক দলের দ্বারা বেশ মূল্যায়িত হয়ে আসছিল (বেশ অনেকদিন ধরেই)। এবারেই মনে হয় জানাজানি হচ্ছে আসল ঘটনা বা এদের ভিতরকার কিছু না-জানা ঘটনার কথা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হল।

যতটা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামের সংগঠনটি ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশে চালাচ্ছে তা সকলেরই জানা। এই সংগঠনটি স্বাধীনতার আগে থেকেই স্বাধীনতার বিপক্ষে ভূমিকা রেখে আসছিল, এখনও দেশের ভিতর-বাইরে চালাচ্ছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, তা এবার চট্টগ্রামের অদূরে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সংঘটিত সহিংস ঘটনাতে দেশের মানুষ আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পেরেছে। এবারের এই বিষয়টি মিয়ানমারের একটি অঞ্চলের সমস্যা হলেও সেদেশের জাতীয় সমস্যা কিন্তু নয়। তা না হলে হয়ত সেই দেশের অং সান সুকির মত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী চুপ থাকতেন না।

মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম জামায়াতে ইসলামী ওদের মদদ দিয়ে দেশের ভিতরেও সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। হতে পারে কোনো একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিষয়টিতে উস্কানি দিচ্ছে। কিন্তু দেশ-জাতি-দলমত-ধর্ম নির্বিশেষে যেখানে বলা হয়, ‘’সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই”, সেখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা দলীয়ভাবে বিষয়টিকে না দেখাই উচিৎ বলে আমি মনে করি।

যে কারণেই হোক, রোহিংগাদের এবারের এই সমস্যাটি সেই দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে বা ধর্মীয়ভাবে দেখলেও আমি বলবো, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ বিষয়টিকে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ইস্যু হিসেবে  যেন না দেখেন। এটি সম্পূর্ণ একটি মানবিক বিষয়। ১৯৭১ এর ডিসেম্বর এর কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। তখন আমরাও প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমরাও তখন আশ্রয় পেয়েছিলাম অন্য ধর্মের বা জাতির লোকদের কাছে। ওরা তখন বলেনি আমরা কোন দলের সদস্য বা কোন জাতি-ধর্ম বা গোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত। তারা দেখেছে মানবিক দিকটি। তাদের মানবতাবোধ ছিল বলেই আমরা ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলাম।

আমার মনে আছে,বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাবার প্রথম রাতের কথা। নাড়া বিছিয়ে মাথার নিচে মাটির ঢেলা দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। এরপরের কাহিনী তো আমার জীবনের ও ইতিহাসের অংশ। একটি ঘরে কয়েকটি পরিবার রাত্রি যাপন করেছি। খাবার দাবারের প্রসংগ না হয় নাই বললাম। আমাদের মত হাজারো পরিবার সেদিন এই করুণ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল। আমাদের গ্রাম ছাড়ার সময়কার কথা, বাড়িঘরে আগুন দেবার কথা কখনও ভোলার নয়। ঐ সময়ের কথা মনে করলে আমি বলতে পারি রোহিংগারা মানুষ। এই বিপদের দিনে যারা ওদের বলছে বৌদ্ধ বা মুসলিম, তাদের দৃষ্টি আরও প্রসারিত  ও উদার করতে হবে।  

আপনি-আমি যে সৃষ্টিকর্তায়ই বিশ্বাস করি না কেন, তারা আপনার-আমার মতই নিরীহ মানুষ। ওদের রক্ত লাল। ওরা মরলে আপনার আমার মতই এই পৃথিবীর মাটির সাথে মিশে যাবে। সুতরাং সরকার ও বিরোধী দল কি বলছে, তা নয় আপনি আমি সাধ্য মত ওদের পাশে দাঁড়ালে মনে করবো ওদের মাধ্যমেই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত বা সেবা করা হচ্ছে। ১৯৭১ এর কথা মনে করে অন্তত একবার নিরীহ বিপন্ন অসহায়  মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করছি।

তবে যারাই ওদের নিয়ে খেলছে বা ভুলপথে ধাবিত করছে, আর যারা না বুঝে এদের খেলার ঘুটিঁ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই: ‘এবার (আবার) তোরা মানুষ হ’।

লেখকঃ জাপানপ্রবাসী লেখক-সাংবাদিক।
[email protected];
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।