ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সাংবাদিক হওয়াটা কী অন্যায়?

পিয়াল হাছান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৫ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১২
সাংবাদিক হওয়াটা কী অন্যায়?

আমার বেড়ে ওঠা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পারিবারিক অস্বচছলতার কারণে প্রত্যেক দিন আমার বড় ভাইকে বাড়ি থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরের কলেজে গিয়ে ক্লাস করতে হত।

কারণ শহরে রেখে পড়ানোর মত অবস্থা আমার বাবার ছিল না। ট্রেনে যাতায়াত খরচ কম লাগতো বলে সকল ৮টার ট্রেনে গিয়ে ক্লাস ধরতো এবং সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ি চলে আসতো।

ভাইয়া যখন বাড়ি ফিরতো, প্রত্যেকদিন একটা করে খবরের কাগজ নিয়ে আসতো। এক এক দিন এক এক কাগজ আনতো। তিনি কখনো খবরের কাগজ আনতে ভুল করতেন না। আমি তখন ৪র্থ কিংবা ৫ম শ্রেণীতে পড়ি। ভাইয়া কখন আসবে আমি সেই অপেক্ষায় থাকতাম। বাড়িতে এসেই ভাইয়া নিউজ পেপারটা বিছানার উপর রেখে পোশাক বদলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আর তখনই আমি এটাকে ছু মেরে নিয়ে যেতাম এবং সাথে সাথে এটা পড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়তাম।

এভাবেই কয়েক মাসে পত্রিকা পড়াটা আমার নেশায় পরিণত হল। এর পর থেকে নিয়মিত পত্রিকা না পড়লে ঘুমাতে পারতাম না। এর সাথে একটা মজার ঘটনা ঘটল, এভাবে সংবাদ পত্রের প্রতি যে ভালোবাসা জন্মালো এর প্রভাবে আমি সাংবাদিকতাকে আমার এইম ইন লাইফ হিসেবে ঠিক করলাম। সে এক কঠিন সিদ্ধান্ত। আমাকে সাংবাদিক হতেই হবে এই টাইপ সিদ্ধান্ত। কয়েকজন বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পরামর্শ নিলাম সবাই বললো, ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিলে ব্যপারটা তোমার কাছে সহজ হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা হলে তো আরও ভালো।

একটা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা পড়ে সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নে ডুবে রইলাম এবং সেই স্বপ্নই এস এস সি ও এইচ এস সি তে জিপিএ ৫ পেতে সাহায্য করলো। এর পর শুরু হলো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার কঠিন সংগ্রাম। স্বপ্ন পূরণের আশাকে সামনে রেখে এর আলোয় কয়েক মাস দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। দুদিন বাদে যখন ভর্তি পরিক্ষার রিজাল্ট দিল আমি তো অবাক। আমি চান্স পেয়েছি, শুধু তাই নয় এসএসসি-এইচএসসির ফল এবং ভর্তি মেধাক্রম আগাম জানান দিচ্ছে আমি সাংবাদিকতায় ভর্তি হতে পারবো। অবশেষে তাই হল।

সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়ে আমার কেবল রবীন্দনাথের একটা গানের লাইন মনে পড়ছে,”আমার চেয়ে সুখী কে আছে আয় সখি আয় আমার কাছে। ” কিন্তু যবে থেকে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেবার জন্য বদ্ধপরিকর হলাম সেদিন থেকে পরিবারের প্রায় সবাইসহ অনেক আত্মীয় সজন এর বিপক্ষে চলে গেল।

তারা অনেকেই বলতে শুরু করলো রাস্তায় মরে থাকবি, সাংবাদিকদের জীবন কুকুরের জীবনের চেয়ে নিকৃষ্ট, শুধু অপরকে দেওয়া ছাড়া জীবনে কিছুই পাবিনা ইত্যাদি। আমার মা এবং বড় বোনেরা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না কাটি শুরু করলো। বুঝাতে থাকলো জীবন মানে পাগলামি না, এই রকম পাগলামি করিস না সাথে সাথে তারা বিভিন্ন সময়ের নির্যাতিত ও শহীদ সাংবাদিকদের উদাহরণ দিল।

তারা বললো অনেক আশা নিয়ে আমরা তোকে বড় করেছি। তোকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। এরপরও আমি আমার সিদ্ধন্তে অনড় রইলাম। মনে মনে জিদটা আর বেড়ে গেল সাংবাদিক হতেই হবে। সাংবাদিক হয়েই আমি প্রমাণ করবো সাংবাদিক মানে রাস্তায় মরে থাকা না, সাংবাদিক মানে যাযাবর কুকুরের জীবন না। সাংবাদিক মানে ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী, সমাজে দূর্বল বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের মুখ্য হাতিয়ার। গণতন্ত্রের রক্ষক ও সমাজের অত্যন্ত শ্রদ্বেয় ব্যক্তি।

কিন্তু বিধি বাম, সাম্প্রতিকালে কিছু ঘটনা শুধু আমার মা বাবাকেই নয় আমাকেও হতাশ করেছে। কিছুদিন আগেও সাংবাদিক হওয়ার যে স্বপ্নে বিভুর থাকতাম তাতে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়েছে। প্রেস ক্লাবের সামনে বাস চালকের অবহেলায় সাংবাদিক নিহত এবং চালকের বিচার এখন পর্যন্ত না হওয়া। দেশের দুটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের দুজন মেধাবী সাংবাদিক হত্যার রহস্য ৪৮ ঘণ্টার সময় নিয়ে এখন পর্যন্ত উৎঘাটন না হওয়া। পুলিশের হাতে ৩ সাংবাদিক নির্যাতিত হওয়া ইত্যাদি।

একজন মানুষ সব ত্যাগ স্বীকার করে কেন সাংবাদিক হয়? এগুলো পাওয়ার জন্য? ব্যাপারটা তখন আরও খারাপ লাগে যখন দেশের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্তলোকরা(প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী) দায়িত্বহীনদের  মত কথা বলে। তখন দুচোখ বন্ধ করে দু’হাতে দু’কান চেপে পাথরে মাথা বাড়ি দিতে দিতে বলতে হয় লজ্জা লজ্জা।

দেশকে যারা দেবার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করে না তাদের কি দেশ থেকে সামান্য কিছুটা আশা করাটা অপরাধ? সাংবাদিক হওয়াটা কী অন্যায়?

পিয়াল হাছান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।