ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ব্লগে ‘হাওয়া মানবদের’ অপচর্চা

শিবলী নোমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১২
ব্লগে ‘হাওয়া মানবদের’ অপচর্চা

গত মাসের ঘটনা। ঢাকার এক বন্ধুকে জড়িয়ে হঠাৎ করেই একটি ব্লগ সাইটে কেউ একজন পোস্ট দিলেন।

‘নাগরিক কণ্ঠস্বর সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে বিকল্প মিডিয়ার সম্মান পাওয়া’ ব্লগের প্রথম পাতায় জ্বলজ্বল করতে থাকলো লেখাটি।

নানা গালিতে ভরপুর লেখাটি রীতিমতো মিথ্যা অভিযোগে পরিপূর্ণ। বোঝাই যায়, বন্ধুটির ওপর অন্ধ আক্রোশ থেকে কেউ একজন লেখাটি দিয়েছেন। এরপর বন্ধুর মোবাইলে ফোনের পর ফোন। বন্ধুটি যথেষ্ট বিব্রত। লেখার ধরন থেকে ধারণা হলো, বন্ধুটির ব্যবসায়িক সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়েই এমন পোস্ট। কী আর করা! ব্লগ কর্তৃপক্ষকে জানানো হলো। তবে ফল পেতে পেতে লেখাটি পড়ে ফেলেছেন অনেকেই। ব্লগ কর্তৃপক্ষ লেখাটি সরিয়ে নিলেও প্রতিক্রিয়া চলতে থাকলো সমানে।

এমন ঘটনার উদাহরণ আরো অনেক দেয়া যায়। মুক্তমত প্রকাশের অবারিত সুযোগে অন্তর্জালের (ইন্টারনেট) দুনিয়ায় এসব ঘটনা যখন ঘটে, তখন ঘটনার শিকার মানুষ বা প্রতিষ্ঠানটির কী পরিস্থিতি হয়? একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো গোষ্ঠীকে এমন আক্রমণ যারা করেন, তারা কোনো না কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকেই করে থাকেন। যে যতোভাবেই মুক্ত মতপ্রকাশের পক্ষে দাঁড়ান, এসব ঘটনা সেই চেতনাকেই ভুলুণ্ঠিত করে না কি?

আমাদের দেশে বেশিরভাগ ব্লগসাইটগুলোর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা প্রকাশিত পোস্ট বা মন্তব্যের দায়িত্ব না নেয়া। জনপ্রিয় একটি ব্লগসাইটের প্রতিটি পোস্টের নিচে লেখা থাকে : “এখানে প্রকাশিত লেখা, মন্তব্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর”। অর্থ্যাৎ ব্লগগুলোর দেয়ালে যে যা খুশি করুন তার দায়-দায়িত্ব শুধুমাত্র যে বা যারা করছেন, তাদেরই। এমন দায়মুক্তির প্রবণতা কতটা সঙ্গত তা নিয়ে অন্যত্র আলোচনা হতে পারে।

তবে তার আগে চলুন, আরেকটি শুভঙ্করের ফাঁকি দেখে আসি। ব্লগ কর্তৃপক্ষ দায়মুক্ত হয়ে যে প্রকাশকারীর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দায়িত্ব সারছেন, তারা কারা? তাদেরকে খুঁজে পাওয়ার উপায়টাই বা কী? স্ব-নাম ও পরিচয়ে লেখা প্রকাশ করনেওয়ালাদের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কিন্তু ব্লগারদের একটি বড় অংশ রয়েছেন, যারা নিজের নাম পরিচয় আড়াল করে অন্তর্জালে ব্লগিং চালান।

একজন মানুষ, তার বহু নিক নেম। এইসব নিকের আড়ালের মানুষটি যে কে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। বলা বাহুল্য, এইসব নিক থেকেই ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক পোস্টগুলো সচরাচর এসে থাকে। এখন এইসব ‘হাওয়া মানবদের’ লেখার দায়-দায়িত্ব শুধু তাদের ঘাড়ে বর্তালে তার কোনো গুরুত্ব আদৌ থাকে কি?

নীতিগতভাবে কারো বিরুদ্ধে কোনোকিছু লিখলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া উচিত। আর কারো বিরুদ্ধে এমন কিছু যদি প্রচারিত বা প্রকাশিত হয়ে থাকে, যাতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে তার আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার রয়েছে। প্রশ্নটি হলো, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটি ব্লগের ক্ষেত্রে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবেন? ব্লগসাইটটি, যা কিনা লেখাটিকে প্রচারের সুযোগ করে দিলো, তার বিরুদ্ধে? কিন্তু তারা তো গতরে দায়মুক্তির বাণী ছাপিয়ে খালাস হয়ে গেছেন। নাকি ব্লগ কর্তৃপক্ষের দেখিয়ে দেয়া পথ ধরে লেখকের বিরুদ্ধে? কিন্তু লেখকটি যে নামে লিখছেন, তার অস্তিত্ব খুঁজে বেরা যাবে কীভাবে?

এসব প্রামাণিক ঝক্কি পোহাতে পোহাতে অভিযোগ করতে মনস্থ করা মানুষটির ধৈর্য্যচ্যূতি না ঘটার কোনো কারণ দেখি না। তাহলে মুক্ত মত প্রকাশের সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে যারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে থাকেন, তাদের নিরস্ত্র করতে কী ব্যবস্থা থাকলো? খুব সম্ভবত এই সুযোগেই দিনে দিনে অধিকাংশ ব্লগে এমন ঘটনা বাড়ছে।
এখানে একটি যুক্তি আসতে পারে।

ব্লগগুলোর দেয়ালে ‘যে যা খুশি তা’ করার প্রবণতা রোধ করার জন্য প্রতিটি ব্লগ কর্তৃপক্ষ নীতিমালা তৈরি করেছে। এসব নীতিমালা অনুসরণ করে মডারেটররা কাজ করেন। সুতরাং কেউ চাইলেই ব্লগে যা খুশি তা করতে পারবেন না। বিষয়টি খুবই সত্য যে, ব্লগের প্রথমদিকে নানা ধরনের বেশ কিছু কুৎসিত ঘটনা ঘটেছে। দিনে দিনে নীতিমালা উন্নয়নের ফলে সেই ঘটনাগুলো এখন অনেক কম।

সেদিক থেকে উদীয়মান বিকল্প মিডিয়া হিসেবে ব্লগ কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এইসব নীতিমালা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয় পোস্ট প্রকাশ হয়ে যাবার পরে। মানে কেউ কাউকে মা-বাপ তুলে গালিগালাজ করার পরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

কিন্তু ততোক্ষণে অনেকের হাতেই স্ক্রিনশট চলে যায়। এরপর সেখান থেকে অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ব্লগে সেটি অপসারণ করা হলো কি হলো না তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এরকম পরিস্থিতিতে নীতিমালা কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। তাহলে মুক্ত মতের নামে যেটি আসলে উন্মুক্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার, তা প্রতিরোধে আগে থেকে ব্লগ কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি কোথায়?

ব্লগে প্রকৃত মানুষ যতো রয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি নিক বা ভুয়া পরিচয় রয়েছে। আগেই বলেছি, এসব নিক-কে যাচাইয়ের কোনো বালাই নেই। হরদম তারা জন্মাচ্ছে এবং নানা অপকর্ম করে ফেলার পর তখন নীতিমালার জালে পাকড়াও হয়ে ‘দুষ্ট-আত্মার নিকগুলো’ মৃত্যুবরণও করছে। এসব নিক অন্যের ভাবমূর্তি ও স্বাধীনতার ওপর কতোটা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, তার একটি উদাহরণ দিই।

খুব সম্ভবত ২০০৭ সালের ঘটনা। দেশের জনপ্রিয়তম একটি ব্লগে দীর্ঘসময় ধরে ব্লগ করতেন মিথিলা নামের একজন ব্লগার। লেখার মধ্য দিয়েই তার যোগাযোগ ঘটে অন্যসব ব্লগারদের সঙ্গে। চমৎকার একটি ব্লগীয় সম্পর্ক। মিথিলাকে কেউ কোনোদিন দেখেননি।

কিন্তু সবাই বিশ্বাস করেন, মিথিলা আছেন। তার লেখায় মন্তব্য করেন ব্লগাররা। তিনিও অন্যদের পোস্টে মন্তব্য করে আসেন। একদিন হঠাৎ করেই জানা গেলো, মিথিলা দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য তিনি দেশের বাইরে চলে গেলেন! এসবই ব্লগের মাধ্যমে জানা যাচ্ছিলো। ‘অসুস্থ মিথিলা’ বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই চমৎকার চমৎকার সব পোস্ট দিতেন।

ব্লগাররা সহমর্মিতা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন তার ব্লগে। সবাই তার সুস্থতা কামনা করতেন। একদিন অন্য একজন ব্লগারের পোস্ট থেকে হঠাৎ একটি লেখা : মিথিলা মারা গেছেন। ব্লগজুড়ে শোকের মাতম। এ যেনো কোনো আত্মীয় হারানোর বেদনা। ব্লগ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত শোক ঘোষণা করে ফেললেন। কিন্তু আসল রহস্য বেরিয়ে এলো কিছুদিন পর। জানা গেলো, এই মিথিলা নামে কারো কোনো অস্তিত্বই ছিলো না কোনোকালে। পুরোটাই একটি ভার্চুয়াল চরিত্র।

একজন ব্লগারের পরিকল্পনায় নিপুণ নাটকের একটি অংশ। যে কি না এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পুরো ব্লগটাকে আবেগের জালে বেঁধে রেখেছিলেন। তা নিয়ে সেইসময় ধুন্ধুমার কাণ্ড। এরপর ব্লগ কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা-বক্তব্য, কতো কী! কিন্তু ব্লগারদের ভাঙা বিশ্বাস তাতে জোড়া লাগেনি কখনোই।

একটি ভুয়া পরিচয় দীর্ঘদিন কীভাবে মানুষকে বোকা বানাতে পারে, অন্তর্জালের দুনিয়ায় মিথিলা-কাণ্ডটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু এসব উদাহরণ থেকে আমরা শিখছি কোথায়? মন্তব্য প্রকাশের ‘দায়মুক্তি’ নিয়ে ব্লগ কর্তৃপক্ষ কতোটা দায় এড়াতে পারে? কর্তৃপক্ষ যদি দায় এড়াতেই চায়, তাহলে অবশ্যই তাদের আরো একটি দায়িত্ব রয়েছে, সেটি হলো প্রতিটি মত প্রকাশকারীর পরিচয় যাচাই করা।

বিষয়টি যে খুব কঠিন তা মনে হয় না। আমাদের দেশেই এমন কিছু ব্লগ রয়েছে, যারা যাচাইয়ের পর সদস্যপদ দেয়। এমনকি লেখাগুলোও আগে থেকে মডারেশন হয়ে এরপর প্রকাশিত হয়। এতে হয়তো হড়বড়িয়ে লেখার তুবড়িতে প্রথম পাতা ভরে ওঠে না। এতে হয়তো ব্লগে ভিজিটরের সংখ্যার ছড়াছড়িও চোখে পড়ে না। এতে হয়তো টোটাল হিটটাও কমে আসে।

কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মিথ্যাচারের প্রবণতা কমবে। কারণ প্রকৃত পরিচয় দিয়ে কেউ কিছু লিখলে তাতে যে দায়িত্বশীলতা তিনি দেখান, বেনামে লিখলে তা দেখান না।

কিংবা হয়তো এতে অনেকেই প্রশ্ন তুলে ফেলতে পারেন, বিকল্প মিডিয়ায় সম্পাদনার ব্যাপারটি থাকলে এর সঙ্গে মূলধারার মিডিয়ার তফাত রইলো কই? তাদের উদ্দেশে পাল্টা প্রশ্ন করাই যেতে পারে, বিকল্প মিডিয়া মানে কি দায়িত্বহীন লেখা লাগামহীনভাবে প্রকাশের লাইসেন্স?
কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ে পাঠকরা ইদানিং খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।

বিশেষ করে পুঁজির পাহারাদার হিসেবে গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে যেভাবে দাঁড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে, তাতে পাঠকদের একটি বড় অংশ বিভ্রান্ত। তার সমাধান হিসেবে কিংবা সেগুলোকে ঠিক পথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে ব্লগ কিংবা এমন বিকল্প মিডিয়াগুলো। তবে অবশ্যই তার জন্য ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমরা কেউই চাই না, দায়িত্বহীন কোনো আচরণের সুযোগ নিয়ে সুযোগসন্ধানী কেউ ‘দায়িত্বশীলতা শেখাতে’ অন্তর্জালে আমাদের এই উন্মুক্ত মাধ্যমটিকে শৃঙ্খলিত করুক। কিন্তু তার আগে আমরা যারা স্বাধীনতার কথা বলি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই, তাদের দায়িত্বশীল হতে শিখতে হবে। এই দায়িত্বশীলতা অর্জনের প্রক্রিয়াগত ব্যবস্থাগুলো নিয়ে বিকল্প মিডিয়াগুলোকেই ভাবতে হবে।

এই মুহূর্তে নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, কে যেনো লিখেছিলেন: স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ডান্ডা যে কাজ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেই দায়িত্ব পালন করে প্রোপাগান্ডা। সু চি’র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কিংবা এই ধরনের গুজব যারা ছড়ান তারা কি খেয়াল করেছেন, তাদের এই দায়িত্বহীন আচরণ আর প্রোপাগান্ডা ছড়ানো সমার্থক? প্রোপাগান্ডা রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি থেকে শুরু করে সুবিধাবাদী শ্রেণির হাতিয়ার হিসেবে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর চোখ রাঙানোর জন্য প্রস্তুত সবল রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবেও দাঁড়িয়ে যায়। আমরা যেনো বিকল্প মিডিয়া গড়ে তোলার বদলে এমন হাতিয়ার তৈরির কারখানা খুলে না বসি।

লেখক: ব্যুরোচিফ, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

বাংলাদেশ সময় : ১১১৯ ঘণ্টা, ০১ জুলাই, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।