ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অনলাইন সংবাদপত্র

সম্ভাবনার শেষ নেই, দায়িত্বও বিশাল

মাসুদা ভাট্টি, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১২

জানার ইচ্ছে যতোদিন আছে ততোদিনই বেঁচে থাকা। এই ইচ্ছেটা যাতে খুব সহজে তৃপ্ত হয় সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ সে চেষ্টা করে যাচ্ছে।

যেমন এই মুহূর্তে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, লন্ডনের আজকের দৈনিক পত্রিকাগুলোর শিরোনাম কি? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নকারীকে চমকে দিয়ে উত্তরদাতা তার মোবাইল ফোনে ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার আজকের শিরোনাম দেখিয়ে দিতে পারবেন। অর্থাৎ এই যে পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, এটাই হচ্ছে আধুনিক যুগে আধুনিক মানুষ হওয়ার এক অনন্য সুখ, যে সুখের জন্য হয়তো কাউকে আর সমরখন্দ-বোখারা বিলিয়ে দিতে হবে না, কেবল একটি ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই হলো। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে কিন্তু আজকের মানুষ অনেক বেশি সুবিধাভোগী, এই বছর দশেক আগেও তথ্যপ্রবাহের জন্য যেমন হাঙ্গামা পোহাতে হতো, আজকে তা কাউকে করতে হচ্ছে না। এজন্য আজকের মানুষ যেমন তৃপ্ত, সুখী তেমনই এই অবাধ তথ্যপ্রবাহ মানুষকে খানিকটা অলসও করে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এক জায়গায় স্থবির থেকেই বিশ্বকে দেখতে চায় বলে তাদের ভেতর ওবিসিটি (অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি) সহ নানাবিধ রোগ দেখা দিয়েছে এবং তারা আসলে “জানার জন্য সুদূর চীন দেশে যাওয়ার” মতো কষ্টও করতে আর রাজি নয়। এমনকি খেলার মাঠের প্রায় সব খেলাই এখন ল্যাপটপ কিংবা আই-বুকে চলে আসায় শরীর বঞ্চিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় পরিশ্রম থেকে। সুতরাং প্রযুক্তির এই ‘শনৈ: শনৈ:’এর ভালোমন্দ দুটো দিকই আছে।

বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাই। এই দেশটি নিয়ে দেশে-বিদেশে অপপ্রচারের শেষ নেই। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং এদেশের মানুষের ভেতরে থাকা নানা বিরোধ-বৈপরিত্যই এই সুযোগ করে দেয় সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও দেশটির এগিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে, সত্যিই বিস্ময়কর। এতো বিশাল জনসংখ্যার বোঝা মাথায় নিয়ে, এতো অসংগতিকে মাড়িয়ে দেশটি কি করে অর্থনৈতিকভাবে এতোটা ভালো করছে তা নিয়ে গবেষণা করছে বিশ্বখ্যাত তদারকি (মনিটরিং) সংস্থাগুলো। হয়তো অচিরেই আমরা সে বিষয়ে বিশদ জানতে পারবো। কিন্তু সাদা চোখে বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্পর্কে একটি বহুজন-শ্রুত ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ দেশের মানুষের ভেতর টিকে থাকার অসীম আকাঙ্ক্ষাই আসলে এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হয়েছে। ঝড়-জল-বন্যা-খরা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আমাদের বসবাস; আর সেটা মেনে নিয়েই আমরা টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত, এ সত্যিই এক অপার আনন্দময় ঘটনা। এর সঙ্গে যদি যোগ করে আমাদের এই গরীব দেশের মানুষের জানার ইচ্ছে, অজানাকে জয়ের ইচ্ছে, ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে গিয়ে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা-- এসবই আমাদের ইতিবাচকভাবে ভাবতে শেখায়। তার সঙ্গে আমাদের অবশ্যই যুক্ত করতে হবে উন্নত তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের তৈরি হওয়া সখ্যকে। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো আমরা টেক-ফ্রিক বা প্রযুক্তি-পাগল দেশ হয়ে উঠতে পারিনি এখনো। কিন্তু তাতে কি! আমরাও পিছিয়ে নেই এ ব্যাপারে মোটেও।

বাংলাদেশের প্রযুক্তি-নির্ভরতা নিয়ে যদিও গোড়াতেই গলদ ছিল। সাবমেরিন কেবল-এ বাংলাদেশের যুক্ত না হওয়া আসলে সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সবচে’ বড় ভুল। সে ভুলের খেসারত আজও আমরা দিচ্ছি। কিন্তু তারপরেও এদেশের তরুণদের প্রযুক্তি-প্রেমকে পুঁজি করে একটি সরকার গঠিত হয়েছে, যাদের স্লোগান ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, যা বিশ্বে বিরল। বাংলাদেশের এই স্লোগান থেকে আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডও এই ডিজিটাল দেশ গড়ার কথা বলছে। এটা আমাদের জন্য উপরি পাওনা। যদিও দুঃখ লাগে দেখে যে, ডিজিটাল প্রযুক্তির কথা বললেও তার উন্নয়ন সরকারের হাতেই শ্লথ হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে এবং সরকার যেন খানিকটা উদাসীনও এ ব্যাপারে। তবে মানতেই হবে যে, দেশের ডিজিটাল প্রযুক্তি আজ যুগের সঙ্গে দৌঁড়–চ্ছে পাল্লা দিয়ে। আমি খুব অবাক হয়েছি শুনে যে, বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতনামা ওয়েব-ডেইলি বাংলানিউজ২৪.কম এরই মধ্যে দু‘বছর পার করে দিয়েছে। দেশের অনলাইন সাংবাদিকতা যে এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছে সেটাইতো বেশ আনন্দদায়ক উপলব্ধি।

বিশ্বময় অনলাইন সাংবাদিকতা নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলতে চান যে, মানুষ প্রিন্ট মিডিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কারণ অনলাইন-মিডিয়া এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। এর সপক্ষে প্রমাণের অভাব নেই। সন্দেহ নেই অনলাইন মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়াকে সর্বত্রই একটা ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু এই ধাক্কা প্রথম দিকে যতোটা কঠিন ছিল ধীরে ধীরে কিন্তু দুই মাধ্যমই তাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিয়েছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশেই বিশেষ করে কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের মতো প্রতাপশালী সংবাদপত্রের পাশাপাশি একই হাউস থেকে বাংলানিউজ২৪.কম-এর মতো অনলাইন দৈনিক প্রকাশিত হচ্ছে এবং কেউ কাউকে থ্রেট মনে করছেন না- এটাও কি কম বিস্ময়ের? পশ্চিমের উন্নত দেশে অনলাইন মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়াকে যে হটিয়ে দিচ্ছিল বলে প্রাথমিকভাবে যে ভয় সঞ্চারিত হয়েছিল তা এরই মধ্যে উবে গেছে। এখন প্রিন্ট মিডিয়া আগের দিনের সেই ঢাউস মাপের নেই, হয়েছে টিউবের ভেতরে বসে সহজভাবে পাঠের মতো সাইজ। বাংলাদেশের মতো কম আয়ের দেশে মানুষ হয়তো সংবাদপত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে খানিকটা অ-দরাজ হলেও হতে পারে কিন্তু অনলাইন সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তা যে এখানে ক্রমশঃ বাড়বে তা বোঝার জন্য গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং বাংলাদেশের তথ্যপ্রবাহকে আরো অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে আরো সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া যেতে পারে এবং অনলাইন সাংবাদিকতার লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নটাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। যা ইচ্ছে তাই লিখে দেওয়ার নাম যে অনলাইন সাংবাদিকতা নয়, এটা যেন নীতিমালার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে বিষয়টিও আমাদের মনে রাখলে ভালো হয়।

আমার নিজের কথা বলি, আমি সেই ১৯৯২ সাল থেকে আন্তর্জাল ব্যবহার করে আসছি। এবং আন্তর্জালে সংবাদপত্র পাঠের শুরুও সেই প্রথম থেকেই, যখন পত্রিকাগুলি নিজেদের ওয়েবসাইট চালু করে। সেদিক দিয়ে আমার যে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতি মোহ কিছুটা কমেছে এরকমটি মনে হয়নি। বরং সংবাদপত্রের অন-লাইন সংস্করণ আর কাগুজে সংস্করণ দু‘টোই নিয়মিত দেখার চেষ্টা করেছি। আমি নিশ্চিতভাবেই মনে করি যে, বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতা আরো সম্প্রসারিত হবে। আরো প্রতিযোগিতা ও পরিশীলনের ভেতর দিয়ে গিয়ে একটা স্থিতিশীল জায়গা নেবে। সে জায়গাটি কাউকে আঘাত করে বা হটিয়ে নয়, বরং স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকবে সে স্থান। বাংলানিউজ২৪.কম হয়তো তখন দাঁড়াবে অগ্রপথিকদের কাতারে। আমি এই অনলাইন দৈনিকটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। নিজেকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত।
ঢাকা, ১ জুলাই, রবিবার, ২০১২।
লেখক: সম্পাদক, একপক্ষ।  
[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।