ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পদ্মাসেতু চাই, ‘নির্বাচনী সেতু’ নয়

ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১২
পদ্মাসেতু চাই, ‘নির্বাচনী সেতু’ নয়

পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়নের অঙ্গীকার থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর স্পষ্টতঃই বাংলাদেশ সরকারের জন্য এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি কেবল ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের জন্যই নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় বিপর্যয়।

বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ এই প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘুষ লেন-দেন হয়েছে, অথবা প্রক্রিয়াধীন ছিল। সরকার এই অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এই বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সরকার সে অভিযোগ পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে নানা পাল্টা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শেই আদমজী বন্ধ হয়েছে, আমাদের পাট ধ্বংস হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কারণেই আমাদের রেলওয়ে আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে, ইত্যাদি।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি সংস্থা যে বাণিজ্যিক সংস্থা এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের মুনাফা শিকারের কুশলী মাধ্যম, সে বিষয়টি নতুন কিছু নয়। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যাবার আগেও তাদের অবস্থান একই ছিল। আমাদের সব ক’টি সরকার জেনেশুনেই জাতীয় অর্থনীতিকে পর্যায়ক্রমে এই আন্তর্জাতিক মহাজনদের কাছে জিম্মি করে ফেলেছে। তাই বর্তমানের বাস্তবতায় ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ বা তথাকথিত ‘উন্নয়ন অংশীদার’দের কাছ থেকে হুট করে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।

এটা বিস্ময়কর যে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত একজন মন্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। সর্বাগ্রে সেই অপমানজনক অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। আমরা মনে করি বিলম্বে হলেও সরকারের উচিত হবে দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী এবং আমলাদের অপসারণ  করে দেশের ভাবমূর্তি পুন:প্রতিষ্ঠা করা এবং সরকারের উপর বিশ্বের ও দেশের জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

সরকারের তরফ থেকে এখন বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই পদ্মাসেতু নির্মাণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এজন্যে প্রয়োজনে চলতি বছরের উন্নয়ন বাজেটের ৫৫,০০০কোটি টাকা কাটছাঁট করে সেখান থেকেই ২৪,০০০কোটি টাকা পদ্মাসেতু নির্মাণে ব্যয় করা হবে।   মোবাইল কলের উপর কলপ্রতি ২৫ পয়সা সারচার্জ আদায়, প্রবাসীদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রায় বন্ড বিক্রি করার মতো প্রস্তাবও রয়েছে। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দেশবাসীকে একবেলা বাজার না করে সে টাকা পদ্মাসেতু নির্মাণে দান করার আহ্বানও জানিয়েছেন।

আমরা মনে করি, এর সবই হচ্ছে অস্থিরতা বা মরিয়াভাবের (desperation) কথা।   বিপদে পড়ার পর এখন তা’ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য কিছু একটা করতেই হবে, অতএব যার যা কিছু মনে আসছে তা-ই বলছেন।
এই অস্থিরতার কারণ, সামনেই নির্বাচন। সরকারি দল আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই পদ্মাসেতু নির্মাণে তড়িঘড়ি একটা সমাধান চায়। অন্ততঃ নির্বাচনের আগেই সেতুর কাজ শুরু করে বাহবা নিতে চায়। স্পষ্টতঃই পদ্মাসেতুকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার ট্রাম্প কার্ড হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ওয়াকেফহাল মহলের মতে, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নতুন করে ঋণ পেতে হলে সব প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করতে হবে। সেজন্যে কমপক্ষে ৩ বৎসর সময় দরকার। অর্থাৎ, ২০১৪ এর আগে তা’ হবার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ, তার আগে বিশ্বব্যাংককে এই প্রকল্পে ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব হচ্ছে না।

অপরদিকে উন্নয়ন বাজেট অর্ধেক কাটছাঁট করে, কিংবা অন্যান্য খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এই সেতু নির্মাণে স্থানান্তরিত করা হলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে তা’ প্রচণ্ড বিরুপ প্রভাব ফেলবে। সরকারের জন্যই তা’ হিতে বিপরীত হবে। সেক্ষেত্রে পদ্মাসেতুই এই সরকারের জন্য মরণফাঁদ হয়ে উঠতে পারে।

আমরা তাই আশা করবো, এক্ষেত্রে ক্ষতি যা হবার তা’ হয়েই গেছে। এখন নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্য তড়িঘড়ি না করে সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে ধীরে চলা এবং সব দিক পরীক্ষা করে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

বিশ্বব্যাংক বা তথাকথিত বিদেশি দাতাদের উপর নির্ভরশীলতা পরিহার করে নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতুটি নির্মাণ করা হলে তা’ দেশ ও জাতির জন্য গৌরব ও আত্ম-প্রণোদনার বিষয় হবে। এই সরকার তেমন একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারে। তবে তা’ এমনভাবে করতে হবে যেন এই সরকারের আমলে তা’ সম্পন্ন না হলেও পরবর্তী যে কোনো সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে তা’ সম্পন্ন করতে পারে।
নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগকে আমরা স্বাগতঃ জানাচ্ছি, তবে একই সঙ্গে একে ‘নির্বাচনী সেতু’ না বানাবার জন্য সরকারের প্রতি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহবান জানাচ্ছি। এটি দেশ ও জাতির প্রয়োজনে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। কোনো দলের নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের সঙ্গে যার কোনো সম্পৃক্ততা থাকা উচিত নয়।

আমরা অন্যান্য বিরোধী দলকেও নির্বাচনের দিকে না তাকিয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের আলোকে এই বিষয়টিকে দেখার জন্য অনুরোধ করছি। আমরা সেতু চাই পদ্মা নদী পারাপারের জন্য; যে সেতুর জন্য জাতি অবশ্যই যে কোনো ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত থাকবে। আমরা ‘নির্বাচনী বৈতরণী’ পার হবার সেতু চাই না।

সরকারের প্রতি আমাদের আহবান:
-- বিশ্বব্যাংক কর্তৃক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-আমলাদের যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে দায়মুক্ত হোন। এ ব্যাপারে অযথা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই।

---পদ্মাসেতু নির্মাণে অহেতুক তড়িঘড়ি না করে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এবং বিশ্বের খ্যাতিমান কিছু বিশেষজ্ঞকে সম্পৃক্ত করে একটি শক্তিশালী সেতু কর্তৃপক্ষ গঠন করে নতুন করে কাজ শুরু করুন। যথাসম্ভব দেশীয় অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণে সকল সম্ভাবনা খতিয়ে দেখুন। এজন্যে প্রয়োজনে ১০ বছর সময় নিন।
--দেশজ অর্থায়নে এই সেতু নির্মিত হলে বাড়তি ব্যয় বা বাড়তি সময় জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।

- আসুন, গোটা জাতি মিলিতভাবে এই জাতীয় বিপর্যয় মোকাবেলা করি।
ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, চেয়ারম্যান, প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টি(পিডিপি)

বাংলাদেশ সময় ১২১৯ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১২
এমএমকে/সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।