ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পদ্মাসেতু: দেশের বিরুদ্ধে বিশাল চক্রান্ত

সুমি খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১২
পদ্মাসেতু: দেশের বিরুদ্ধে বিশাল চক্রান্ত

বাঙালি জন্মেছেই টিকে থাকার লড়াই, এক অর্থে অস্তিত্বের লড়াই, করার জন্যে। মায়ের ভাষায় কথা বলার লড়াই, পায়ের নীচের মাটিটুকু রক্ষার লড়াই, বিশ্বমানচিত্রে একটি লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর লড়াই।

এই লড়াকু বাঙালির দুর্ভাগ্য: এতো রক্ত, এতো আত্মদানের বিনিময়ে যে অর্জন, তার সুফলভোগী পাকিস্তানসেবী কুলাঙ্গারদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে নিজের ঘরেই অনেক বড়ো লড়াই করতে হচ্ছে। আর ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে বিবেক বেচে দিয়ে গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার আর নির্লজ্জতায় আকন্ঠ ডুবে আছে বাংলাদেশের ‘সুশীল সমাজ’ এর একটি অংশ। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে আছেন হয়তো তারা। একাত্তরের পরাজিত পাকিগোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আত্মঘাতী যে প্রোপাগান্ডা তারা চালাচ্ছেন, তাতে সমাজের উচ্চশ্রেণীর সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ মোটিভেটেড হতে পারে সহজেই। ধৃষ্টতার জন্যে ক্ষমা চাইছি, তাদের  সার্বিক বিবেচনাবোধ  কতোটা গণমুখি আর কতোটা বাস্তবভিত্তিক তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, তাদের  জীবনবোধ এবং বাস্তবতা ক্রমশ উর্ধ্বমুখি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে তারা অক্ষম। সেই ফুরসতও তাদের নেই। তাই তারা প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন সরকার-বিরোধিতার নামে মহাজোট সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ ‘কতোটা খারাপ’ তা প্রতিষ্ঠা করার।

১৯ জুন পদ্মাসেতুর দুর্নীতির বিষয়টি নাকি স্পষ্ট করবে বিএনপি। কে বলে কার কথা!! হাস্যকর এ ঘোষণা তরিকুল ইসলামের। তার নিজের দুর্নীতি স্পষ্ট করার সৎ সাহস আশা করা বোকামি। তবে একটি ভালো কথা বলেছেন তিনি। জয়নুল আবদিন ফারুক প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, রোজার ঈদের পর সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে শক্তিশালী এবং গঠনমূলক বিরোধী দলের অস্তিত্ব কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার সাধ্য এদের নেই। ধ্বংসকামী ব্যক্তিদের কাছে শুভবুদ্ধি আশা করা বোকামি বটে!

 জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সময়ে মস্তিষ্ক বিকানো যে বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক অথবা নেতানেত্রীরা একা অথবা সপরিবারে হাওয়া ভবনের ‘খয়রাত খোর’ হয়ে তারেক রহমানের পিছু পিছু ঘুরেছেন, তাদের ‘গুরুদায়িত্ব’ তারা এখন বেশ ভালোভাবেই পালন করছেন! লন্ডনে বসে তারেক রহমানও খুব তৃপ্ত। হয়তো ভাবছেন, তার জন্যে বাংলার মসনদ সাজিয়ে রাখছেন এই ব্যক্তিরা। কর্নেল তাহের, খালেদ মোশাররফসহ অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যকে একের পর এক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিচারবহির্ভুতভাবে হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে রাজাকার গোলাম আযম-শাহ আজিজুর রহমান গংসহ একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে পুনর্বাসনের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনাকারী পাকিস্তানসেবী জেনারেল জিয়াউর রহমানের যোগ্য পুত্র তারেক রহমান মসনদে বসে আবার রাজাকার বাহিনীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ দেবেন। বাংলাদেশবিরোধী এই কালোশক্তির হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে তিরিশ লাখ শহীদের আত্মদানের প্রতি অশ্রদ্ধা আর কালিমা লেপনের কলঙ্কজনক দায়িত্ব পালন করবেন আবার এই স্বপ্ন-মদিরায় বিভোর হয়ে আছেন অনেকে।
কিন্তু তাদের জানা উচিত, সেই করাল কালো স্বপ্নের বাড়া ভাতে ছাই দেবে এদেশের সাধারণ মানুষ। সেই মানসিক দৃঢ়তা এবং মনোবল তাদের আছে। প্রয়োজন শুধু বিচ্ছিন্নতা ভুলে সকল শুভ শক্তির আবার একাত্ম-একাট্টা হওয়া।

রাজাকারকুলশিরোমণি গোলাম আযম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের হাজত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে বসে তার বাড়ি থেকে পাঠানো ১৫/২০ পদের চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খেয়ে উদরপূর্তি আর রসনাতৃপ্তি করছেন বেশ। সঙ্গে তার যোগ্য সাগরেদ মীর কাশেম আলী, নিজামী, মুজাহিদ, সাইদী, সাকাচৌ, কাদের মোল্লা। ব্যারিস্টার রাজ্জাক, মিজানুল, তাজুলরা তো আছেনই দেশে-বিদেশে লবিং করে এই কুখ্যাত বর্বর খুনিদের বাঁচানোর চেষ্টায়। এজন্য তারা নেমেছেন আদাজল খেয়ে।

 মার্কিন আইনি সহায়তাকারী সংস্থা ক্যাসেডি অ্যাসোসিয়েটসকে জামায়াতিরা এখন আর ‘মালাউন’, ‘বিধর্মী’ ‘ইহুদি’ ‘নাসারা’ বলছে না। সাড়ে সাতশো কোটি টাকায় লবিস্ট হিসেবে এদের নিয়োগেও দ্বিধা নেই। এখন ‘জান বাঁচাতে তাদের লাগবে। কাজ শেষ হলে বলবে:“মালাউনের বাচ্চা!!”

একাত্তরের মতোই তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভেতরে-বাইরে নানা মিথ্যাচার করে সুবিধা আদায় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; আর এটাই তাদের নীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলসহ কিছু বুদ্ধিদাতা জামায়াত-রক্ষা মিশনে নির্লজ্জভাবে নেমে পড়েছেন। এ পবিত্র মাটির উপর দাঁড়িয়ে মায়ের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে আর কতো মিথ্যাচার আর চাপাবাজি করবেন এরা? এদেশকে যারা ভালোবাসেন, লাখো শহীদের প্রতি যাদের ন্যূনতম দায়িত্ববোধ এবং শ্রদ্ধা আছে, তাদের সবার এখন একাত্ম হয়ে নব্য এই রাজাকার-আলবদর বাহিনীকে ঠেকানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
 
 তাই এখনো বাংলাদেশের কিছু মানুষ অস্তিত্বের, বাঙালির আত্মপরিচয় রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি জান্তা জেনারেল নিয়াজির সুদূর প্রসারী পরিকল্পনাই বুঝি সফল হয়েছে।

সিপিবি  সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম লিখেছেন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে একসময়ে যমুনা সেতু করার দাবিতে তারা ছিলেন সোচ্চার। পূর্ববাংলার পাট বিক্রি আর অন্যসব খাত থেকে আয়ের টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নতুন রাজধানী নির্মাণ, বড় বড় স্থাপনা এবং ব্যয়বহুল ‘তারবেলা বাঁধ’ নির্মান করে পিন্ডির বড় কর্তারা। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৭ সালে ৮২ হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ করে পাকিস্তানের সিন্ধু  নদীর উপর ৮ হাজার ৯শ’৯৯ ফুট দৈর্ঘ্যের, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঁধ  ‘তারবেলা’ তৈরি করার কাজ শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে ১ হাজার ৪শ’৯৭ মিলিয়ন ইউএস ডলারে নির্মাণ শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৭৪ সালে। সেলিম ভাই লিখলেন, তাদের বক্তৃতায় পাকিস্তান সরকারের শোষণ-বৈষম্যের অন্যতম জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে যমুনা সেতু  নির্মানে পাকিস্তান সরকারের অনীহা ও গড়িমসি বড় রাজনৈতিক ইস্যু ছিল। সাধারণের বোধগম্য ভাষায় দেওয়া বক্তৃতায় তারা উদাহরণ টেনে বলতেন “তারবেলা বাঁধের বেলায় শুধু টাকার অভাব হয় না, আমাদের বেলায় শুধু ‘টাকা নেই, টাকা নেই ?”

১৯৭০ সালে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল যমুনা সেতুর বাস্তবায়ন। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে যমুনা সেতু বাস্তবায়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং জাইকাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এ প্রকল্পটিতে অর্থায়নে সম্পৃক্ত হবার জন্যে। স্বাধীনতার পর যমুনা ব্রিজের কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। স্বাধীন দেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দিয়েছিলেন এদেশ কখনো মার্কিন তাবেদারি করবে না। সেটা তিনি কাজেও প্রমাণ করেছিলেন। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, “ঘাস খেয়ে থাকবো , তবু শর্তযুক্ত ঋণ নেবো না।   আপোসহীন এ কঠোর নীতির কারণে স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েকটি বছর বিশ্বব্যাংক এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে মুক্ত থেকে প্রবল আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বিশ্ব সভায় দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। এ আত্মমর্যাদা সবাই সইতে পারে না। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই আত্মমর্যাদা। এদেশে বিরাষ্ট্রীয়করণ, ব্যক্তিখাতের একচ্ছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা বিশ্বব্যাংক জুটিয়ে নেয় উচ্ছিষ্টভোগী লোভী আত্মঘাতী-পিতৃঘাতী বাঙালি লুটেরাদের। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর লালিত এই দল সহজে বিকিয়ে দেয় দেশ এবং নিজের মাটি। পিতার রক্তে রাঙ্গিয়ে নেয় নিজেদের।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় বন্দী করে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যা জেলহত্যার মধ্যে দিয়ে এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় মার্কিন-পাকিস্তানসেবী কালো শক্তি। এ জাতিকে মেধা, মনন সবদিকে নিঃস্ব করতে সদা বদ্ধপরিকর অন্ধকারের এই শক্তি।

উইকিলিকস এর তথ্যমতে, পরবর্তী সময়ে যমুনা বহুমুখি সেতু বাস্তবায়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে ১৯৮৫ সালের মে মাসে এরশাদ কাজ শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়া ভিত্তিপ্রস্তর দেন। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে যমুনা সেতুর কাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ করে তা যান চলাচলের জন্যে উন্মুক্ত করে দেন। ৬শ’ ৯৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় যমুনা সেতু নির্মাণে। এডিবি,আইডিএ, ওইসিডি প্রত্যেকে ২শ’ মিলিয়ন করে   ১% সুদে ঋণ দেয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, দৃশ্যত:১% এই সুদ অবশ্য ২৫% এ গিয়ে দাঁড়ায়। সাম্রাজ্যবাদী এসব দাতাসংস্থা শুভংকরের ফাঁকি দিয়েই আমাদের মতো দেশগুলো (তাদের ভাষায় ‘উন্নয়নশীল’) থেকে সব লুটেপুটে নেয়। বাকি ৯৬ মিলিয়ন ডলার এদেশের মানুষ দিয়েছে। সেই সময় থেকেই পদ্মানদীতে সেতু নির্মাণের দাবি জোরালোভাবে উঠে আসে।

 মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ভাষায় শুরু থেকেই পদ্মাসেতু জাতির ‘স্বপ্নকন্যা’ হিসেবেই সাধারণ মানুষ তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন এবং নির্ভেজাল জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিতে দেখেছে। আর এজন্যেই জাতির এ ‘স্বপ্নকন্যার’ জন্যে হাত বাড়িয়েছে সবাই। ভুল বললাম, সমাজের ছোট্ট সেই অংশটা ছাড়া। দীন-দুঃখিনী মায়ের দেয়া মোটা কাপড় পরার চেয়ে বিদেশি প্রভুর কাছে মাকে বিক্রি করে পা-চাটা কুকুরের মতো  বিষাক্ত‘পার্সেন্টেজ’ ভোগ করে বিলাসী কাপড় পরার সাধ তাদের। দেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজী, চট্টগ্রাম স্টিল মিলস, রেলওয়ে, টিসিবিসহ আরো অনেক কিছু আমরা হারিয়েছি বা হারাতে বসেছি বিশ্বব্যাংকের ফাঁদে পা দিয়ে।

 বিদেশি অর্থায়ন না হলে এই নষ্ট মগজের লোকেদের পার্সেন্টেজের ভাগটা খুব কম হয়ে যায়। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক তার নানান শর্তের বেড়াজালে বন্দী করে পুরো টাকাটাই নয়, হাতিয়ে নেয় তারও চেয়ে বেশি। সেটা জেনেবুঝেও অন্ধের মতো সবাই তার জন্যে মায়াকান্না করার মূর্খতা আর কতোদিন?
 
 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতোটা দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমরা নিজেরা তৈরি করবো পদ্মাসেতু; তার অর্থমন্ত্রীর সুর ঠিক যেন এর উল্টো তালে চলে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তার পুরনো প্রেম তিনি আমৃত্যু টেনে নিয়ে যাবেন হয়তো। তা নেন, সমস্যা নেই। তবে সারা জাতিকে এই প্রেমের ‘কাবাব মে হাড্ডি’ বানানোর চেষ্টায় যেন তিনি ক্ষ্যান্ত দেন। অত্যন্ত মেধাবী এই ব্যক্তিটি বারবার সাধারণ মানুষের অন্তরে ঘা দিচ্ছেন। এলাকায় গিয়ে সম্প্রতি আগামীবার নির্বাচনের প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়ে এসেছেন। তিনি ভুলে গেছেন, বাঙালি বড়ো আত্মভোলা জাতি। ভালো কাজ বিশেষ একটা মনে রাখে না। তবে খারাপ যা করেছেন, তা কখনো ভোলে না। আগামী দিনে প্রার্থিতা করতে হলে ক্ষমতার শেষ সময়টি তাকে দাতাদের মনরক্ষার কথা ভুলে যেতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশে ৫ থেকে ৮ লাখ কোটি কালো টাকা আছে, তা বাজেয়াপ্ত করলে ২০ থেকে ৩০টি পদ্মা সেতু হবে। আহা!! এতো বড়ো সুন্দর কথা! কালো টাকার মালিক তো হাতেগোনা। তাদের ভোট কি আপনার জন্যে খুব জরুরি, মাননীয় অর্থমন্ত্রী? আপনি সেই উদ্যোগই নেন না কেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী? একই সঙ্গে মাগুড়ছড়া ট্যাংরাটিলা গ্যাস বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। তারেক-কোকো-মামুনের পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনারই বা কি হলো মাননীয় অর্থমন্ত্রী? এর সবটাই জনগণের টাকা। এই মহান দায়িত্ব কঠিন হলেও, এতে আপনি সফল হলে দেশের সাধারণ মানুষ আপনার প্রতি এবং এই সরকারের প্রতি আরো অনেক আস্থাশীল হবেন।

মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃঢ়প্রত্যয়ী ভূমিকা উদ্বিগ্ন করেছে বিশ্বব্যাংককে। হঠাৎই সুর পাল্টেছে তারা। তাই বলে এই ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। বিশ্বব্যাংক চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অঙ্গুলি হেলনে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে বন্দী করে, মিথ্যা দুর্নাম দিয়ে আক্রমণ না করলে, যুদ্ধবিধ্বস্ত না হলে ,অস্থিতিশীল না থাকলে  অথবা এসব দেশের মানুষগুলোর হাতে ভিক্ষার থালা না দেখলে তারা শান্তি পায় না। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয় আরো সংকটগ্রস্থ করে তুলেছে আমাদের বাস্তবতাকে। তবু সাধারণ মানুষ অনেক আশায় বুক বেঁধেছে। তারা বিশ্বসভায় বুক ফুলিয়ে বলবে, “আমরাই পারি। ”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাসী আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন সাধারণ জনগণ। এর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রমাণ করবে ‘আমরাও পারি’। যেদেশের নারী চা-শ্রমিকেরা মাত্র ৫০ পয়সা করে জমিয়ে সোনার বালা গড়িয়ে সরকারপ্রধানকে দিতে পারে, সে দেশের ভয় কি?  এদেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে আমার আত্মবিশ্বাস প্রবল। আমরা পারবো। দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। নিজেদের আর কতো খাটো করবো আমরা? বিশ্বব্যাংকের সব অপকর্ম ফাঁাস হবে একদিন। তাদের ফাঁদে আর পা দেয়া নয়।

ছোটকালে পীর খানজাহান আলীর আত্মজীবনী মূলক গল্প পড়েছিলাম, ‘যে কুপথে চলে, সে কূয়ায় পড়ে। ’ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন এ কথাটির প্রতিফলন দেখতে পাই আমি। পাকিস্তান নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করতে চেয়ে আজ নিজেরাই রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। এদেশে এখনো গ্লোব্যাল ক্যাপিটালিজমের ধামাধারী যারা , তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হবে একদিন। আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে প্রত্যেকের মধ্যে।

বুঝতে হবে এ প্রকল্পের  ব্যয় দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। প্রথম ব্যয় ছিল ১৪০ কোটি ডলার। ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদেও নির্বাহী কমিটি একনেকে ১৪৭ কোটি ২৭ লাখ ডলারে  প্রথম প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ২০০৯ সালে ততকালীন যোগাযোগমন্ত্রী  সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১৯০ কোটি ডলার। ডিসেম্বরে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বিষয়ক আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, পদ্মাসেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার। এখন এই ব্যয় ২৯০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করলে তাদের হুকুমেই চলতে হবে। তাদের পছন্দে তাদের নির্ধারিত বেতনে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করতে হবে। এটি সমাজহিতৈষী কোনো সংস্থা নয়, মুনাফালোভী।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত বলেছেন, বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ থেকে পদ্মাসেতুর মতো তিনটি সেতু নির্মাণ সম্ভব। তিনি বলেছেন, অপ্রদর্শিত অর্থ, কালোটাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে এই অর্থ সংগ্রহ সম্ভব হতে পারে। দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর লাইফফান্ডের অলস পড়ে থাকা ১১ হাজার কোটি টাকা এই সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ করা যেতে পারে বলেছে বিআইএ(বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন)। বেসরকারি ব্যাংক-উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি(বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স) এই প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ অনেক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পদ্মাসেতুর বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। পানিবিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, দেশে বিশেষজ্ঞ আছেন, তবে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং অর্থের ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তিবিদ, স্থপতি এবং প্রকৌশলীদের দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা প্রত্যাশা করছি। যাতে তাদের ত্যাগ এবং দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে।

 পরিশেষে আবারো সিপিবি সাধারণ সম্পাদক এককালের মেধাবী ছাত্র, এখনকার মেধাবী রাজনীতিক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে একমত আমি। পদ্মাসেতু কোনো ‘আওয়ামী প্রোজেক্ট’ নয়,এটি একটি জাতীয় প্রকল্প। জাতির সমস্ত শক্তি এবং সম্মতিকে একাজে সমবেত করতে হবে। মহাজোট সরকারের মাত্র ১৬ মাস মেয়াদ আছে। সামনে কারা সরকার গঠন করবে কেউ জানে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মানের পথে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছেন তিনি। একটি সর্বদলীয় জাতীয় পরামর্শ সভা ডাকা প্রয়োজন। দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে। দেশে অনেক মেধাবী, সৎ মানুষ আছে। যাদের নিয়ে গ্রহণযোগ্য তদারকি কমিটি করা প্রয়োজন। নিঃস্বার্র্থভাবে তারা মনিটর করবেন যাতে কোনো দুর্নীতি অথবা কাজে গাফিলতি না হয়। দেশের সেনাবাহিনীকে একাজে সম্পৃক্ত করা যায়, সুদক্ষ সেনাদল আছে যারা এ কাজে পরীক্ষিত।

এখানে সেলিম ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন ,আপনি বলেছেন পদ্মাসেতু নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে একটি বড়ো শিক্ষা দেশ পরিচালনার চলতি নীতি-দর্শনের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে  মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সূচিত মুজিব-তাজউদ্দিনের মতো স্বনির্ভরতার পথে হাঁটতে হবে। বিএনপি যে তা করবে না, সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দল এবং দলীয় আধিপত্য এড়িয়ে লুটেরা ধনিক শ্র্রেণীর ব্যবস্থাপত্রের বাইরে তারা যাবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।