ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

হুমায়ূন আহমেদ ও বাংলা ভাষার পাঠক

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১২
হুমায়ূন আহমেদ ও বাংলা ভাষার পাঠক

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু বাঙালির জন্য, বাংলা ভাষার লেখক-পাঠকদের জন্য যেন এক নক্ষত্রের পতন। বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষাভাষি মানুষের জন্য সীমাহীন শোক বয়ে এনেছে তার এই প্রস্থান।



অনেক লেখক-সাংবাদিকদের মতো আমারও এ এক বিশ্বাস যে, হুমায়ূন আহমেদই বাংলা কথাসাহিত্যকে ‘দাদা’দের রাজত্ব থেকে বের করে আনতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের পাঠক একসময় হুমড়ি খেয়ে পড়তো ভারতীয় বাঙালি লেখকদের কাছে। সে দিন এখন অতীত। সেজন্যই হয়ত হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সারা পৃথিবীর বাঙালিদের মধ্যে একটা বিশাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও ভারতের বাংলা কাগজগুলোতে কোনো বড় প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করতে পারেনি। আনন্দবাজার পত্রিকাসহ দু-একটি পত্রিকা সিঙ্গেল কলাম নিউজ দিয়েই দায় সেরেছে।

হুমায়ূন আশির দশক থেকেই ধাক্কা দিয়েছেন। এ ধাক্কায় বাংলাদেশের তারুণ্যের মাঝে কথাসাহিত্য ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। তাকে ঘিরেই হয়ত হু হু করে বেড়েছে পাঠক। তার বই বিক্রি বেড়েছে হাজার হাজার কিংবা লাখো কপি। এমনকি বাংলাদেশের তরুণ লেখক-সাহিত্যিকরা ভরসা পেয়েছেন। নতুন নিরীক্ষায়, ভিন্নতায় এখন বই মেলায় উপন্যাস-গল্পের কাটতি থাকে সর্বোচ্চ। হুমায়ূন সমাজ বিপ্লবের জন্যে কলম হয়ত চালাননি, কিন্তু এটা বলতেই হয় পাঠক সৃষ্ঠিতে বাংলাদেশে তিনি বিপ্লব সৃষ্ঠি করেছেন। ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’--এটা তিনিই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পশ্চিমের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে লেখক হয়েও যে অর্থনৈতিক ব্যাপক সমৃদ্ধি আসে, তার-ই বিশাল প্রমাণ হুমায়ূন আহমেদ।

দেশের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত পাঠক যেভাবে হুমায়ূন আহমেদকে তাদের পাঠের প্রধান স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিল, ঠিক তেমনি একটা শ্রেণি, যারা হয়ত বইয়ের পাঠে মনযোগী নয় কিংবা পাঠের সঙ্গে সংশ্লিষ্টও নয়, তারাও হুমায়ূন আহমেদকে চিনেছিলেন টেলিভিশনের পর্দায়। তার ধারাবাহিক নাটকগুলো ছিল মানুষের সাপ্তাহিক রুটিনের একটি অংশ। হুমায়ূন ছিলেন না গতানুগতিক রাজনীতির কোনো মানুষ। সমাজ ও রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধতা শুধু যে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মী কিংবা সমর্থকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তা একজন লেখক হিসেবে বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদই দেখিয়ে দিতে পেরেছেন। তার সামাজিক দায়বদ্ধতার শক্তিশালী প্রকাশ ঘটিছে ভিন্ন ভিন্নভাবে। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের হতাশাকে তুলে ধরেছেন তার নাটকগুলোতে। আর উচ্চবিত্তের নোংরামি ফুটে উঠেছে তার ভিন্ন চরিত্রে।

হিমু আর মিসির আলীদের জন্ম দিয়েছেন তিনি শত-সহস্র মানুষের মধ্যে, সারা বাংলাদেশে। সামাজিক দায়বদ্ধ এই লেখকের কিংবদন্তিতুল্য সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ মঞ্চ কাঁপানো অসংখ্য গলাবাজ নেতার আওড়ানো বুলির চেয়ে টিভির পর্দায় ছিল সহস্র গুণ শক্তিশালী উচ্চারণ। একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রতি ঘৃণা-মাখানো এই উচ্চারণ মধ্যবিত্ত তরুণদের উদ্বেলিত করেছিল। এভাবেই হুমায়ূন এমনকি জাতীয় দায়বোধকে সংগ্রামী চেতনার মধ্য দিয়েই দর্শক-পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন উপন্যাস ও নাটকে।

উপন্যাস-গল্প-নাটক-গান সব শাখায় বিচরণ করা এই সব্যসাচী লেখকের জায়গা ফিরিয়ে দিতে পারবে কি কেউ? এ প্রশ্ন উচ্চারিত হবেই। একজন শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় কিংবা একজন কাজী নজরুল ইসলামের পর হুমায়ূন আহমেদের জন্য আমাদের আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? পাঠক ধরে রাখার কিংবা সমাজ বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার অনিন্দসুন্দর কারিগর হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু কোনোভাবেই পূরণ হবার নয়।

নুহাশপল্লীতে হুমায়ূনের শেষ শয্যা
পাঠক-প্রিয়তায় আকাশ-ছোঁয়া বাংলা ভাষার লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার জীবদ্দশায় বার বার আলোচিত হয়েছিলেন, মৃত্যুর পরও তিনি রেখে গেলেন বেশ কিছু প্রশ্ন। তাকে নিয়ে বেদনার পাহাড় দেখেছে বাংলা ভাষার পাঠক। অশ্রু ঝরেছে হুমায়ূন আহমেদের সন্তান নুহাশ-শিলা-নোভা-বিপাশা অথবা শত শত হিমুর। সেই অশ্রুধারার সঙ্গেই যেন আরও কিছু প্রশ্নবিদ্ধ করবে এ জাতিকে চিরকাল। আর তা হবে তার মৃতদেহ সমাহিত করা নিয়ে। পাঠকের হুমায়ূন কিংবা পরিবারের হুমায়ূন কোথায় শেষ শয্যা নেবেন তা ছিল লাখো মানুষের জিজ্ঞাসা। সেই জিজ্ঞাসায় সমাপ্তি হয়েছিল তার প্রিয় নুহাশপল্লীতেই তাকে দাফন করে। আর এতে একজন শাওনের জেদ জয়ী হয়েছে ঠিকই, হেরেছে লাখো মানুষের আবেগ। লেখালেখিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসা এই মানুষটার শেষ শয্যাটাও কি ব্যবসার জন্যে রেখে দেওয়া হলো, না কি একজন হুমায়ূন আহমেদকে কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে কিংবা বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে না রেখে দূরেই রাখা হলো, কেন জানি বার বার এসব প্রশ্ন ঘোরপাক খায় ভেতরে ভেতরে আমার।

ফারুক যোশীঃ যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।