ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পুঁজিহীন ব্যবসার পুঁজি!

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২২ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১২

ব্যবসাটা দারুণ। কিছুই লাগে না।

ব্রিটেনে চ্যারিটি রেজিস্ট্রেশন নিতে খুব একটা বেগও পেতে হয না। চালাক-ধূর্ত যারা তারা কিন্তু সহজেই তাদের পরিবারের বিভিন্ন মানুষের নাম নিয়ে একটা চ্যারিটি সংগঠন দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারে। পরিবারিক ব্যবস্থাপনায় থাকলে এ নিয়ে কেউ আর ঘাঁটাঘাঁটি করে না। কিংবা হিসেব-নিকেশের ঝামেলাও পোহাতে হয় না। এভাবেই এখন শুধু বাঙালি কমিউনিটিতেই গজিয়ে উঠেছে শত শত ভূঁইফোঁড় সংগঠন। এই সংগঠনগুলোর প্রায় সবক’টির নামের আগে বা পরে আরবি শব্দ থাকে। এই সংগঠনগুলোর কর্নধারদের হতে হয় শ্মশ্রুমণ্ডিত; হোন না তিনি একজন যুবক, তাতে কি!

লন্ডনে আছে ছয়টি টিভি চ্যানেল। এগুলোর মধ্যে চ্যানেল এস এবং বাংলা টিভি প্রচারিত হয় লন্ডন থেকে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায়। অন্য চারটি চ্যানেল যেমন চ্যানেল আই, এনটিভি, চ্যানেল নাইন এবং এটিএন বাংলা মূলত ঢাকার চ্যানেলগুলোরই প্রোগ্রাম এখানকার নিজস্ব অফিস থেকে ব্রডকাস্ট করা হয়। ঐ চ্যানেলগুলোর নিজস্ব অফিস, ছোট পরিসরে হলেও নিজস্ব স্টুডিও আছে। এখান থেকে প্রচারিত হয় কমিউনিটির নিউজ, টক শো এবং এগুলোকে কেন্দ্র করেই এখানে বিজ্ঞাপন নির্ভরতাও। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই টিভি চ্যানেলগুলো ব্রিটেন এবং ইউরোপের বাঙালিরা দেখে ফ্রি। গ্রাহক হতে হয় না এর জন্যে।

এখন অর্থাৎ এই রমজান মাসে ঐ টিভি চ্যালেগুলোর নেই কোনো ফুরসত। দু-একটা চ্যানেল বাদে বাকি চারটি চ্যানেলে এখন আর মূলত কোনো বিনোদন চোখে পড়ে না। বিকেল পাঁচটা থেকে টিভির পর্দায় ধ্বনি ওঠে শুধু একটিই: ‘’আল্লার ওয়াস্তে দান করুন। ‘’ গত প্রায় ছয় বছর ধরে চলছে ঐ অর্থ তোলার ধুম। চ্যানেলগুলোতে চাঁদা তুলতে গিয়ে অনেকেই এখন মূর্খ-বেকুবদের কাছে সেলিব্রেটি। আর মূর্খ-বেকুব বলব-ই কিভাবে ? আশ্চর্য একটা শক্তি আছে এদের। নাটক কিংবা সিনেমায় যেমন থ্রিল কিংবা শোকের সময় ভিন্ন ভিন্ন মিউজিকে দর্শক দ্রোহী হয় কিংবা আবেগে উদ্বেলিত হয়, ঠিক সেভাবেই কিছু নেপথ্যের মিউজিক বাজিয়ে কিছু ফুটেজ দিয়ে দর্শকদের আবেগী করে জিকির উঠে সমস্বরে। চাঁদা উত্তোলনকারী প্যানেলে বসা মানুষগুলো তখন বাংলাদেশের গ্রাম্য ওয়াজের মতো কথায় কথায় ‘’আল্লাহ আকবর, রব আর আল্লাহর ওয়াস্তে এতিমদের সহায়তা করুন, কোরবানী গোস্ত দিন, যাকাত দিন’’ প্রভৃতি শব্দে মোহাচ্ছন্ন করে তোলেন দর্শকদের। বিশেষত মহিলারা তখন যেন পাগলপারা হয়ে ওঠেন। বাচ্চাদের দিয়েও চাঁদা দিয়ে উৎসাহিত করা হয টিভি দর্শকদের। গাঁজাখোর সন্তানের শিফা (রোগমুক্তি!)চেয়ে, স্বামীর পরকীয়া থেকে মুক্তির অভীপ্সায় কিংবা ভিনদশির সাথে মেয়ের-ছেলের ওঠাবসা বন্ধে কিংবা নিত্যদিন মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে হাজার হাজার পাউন্ড বেনিফিট নিয়ে প্রকারান্তরে ধর্মীয় দৃষ্টিতে পাপ করে এবং এ থেকে পরিত্রাণ পেতে মূলত এরা মুক্তির আশ্রয় খোঁজেন টিভি পর্দার ঐ বিস্ময়কর যাদুকর মানুষগুলোর কাছে। আর কিছু সরলপ্রান মানুষ ঠিকই হয়ত যাকাত আর ফিতরার অর্থ দিয়ে দেয় অকাতরে, পরকালে শান্তির আশায়।

এদের দোয়ায় যেন সকল মুশকিল আহসান হয়ে যাবে ---এই কামনায় আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে চাঁদার পরিমাণ। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ঐসব চাঁদা উত্তোলনকারীদের মাঝে আছেন ব্যারিস্টার-সলিসিটর, সোশ্যাল ওয়ার্কার, ক্যামেরাম্যান-রিপোর্টার এবং ভিন্ন পেশার কিছু মানুষও। কিছু কমিউনিটি নেতাও ব্যবহৃত হন এ সব চ্যারিটি অ্যাপিলে। বিকেল পাচটা থেকে শুরু হওয়া এই সারা রাতের চাঁদা উত্তোলনের সময় পালাবদল করে প্যানেল বদল হয়। মানুষের পরিবর্তন আসে। ভিন্ন ভিন্ন শহরে অবস্থান করা সমাজে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় প্রতিপত্তি পাওয়া কিংবা কমিউনিটির নেতা-পাতিনেতাদের এখানে এনে জড়ো করা হয়, এবং এরাও টিভি‘র পর্দায় নিজের মুখ দেখিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেন এবং হাত পাতেন নিজের স্বজন কিংবা পরিচিতদের কাছে------তবে এ হাত পাতা অবশ্যই নিজের জন্যে নয়, তাদের ভাষায় গরীব-মিসকিন-এতিমদের জন্যে। যতই বছর গড়াচ্ছে, ততই যেন এই অর্থসংগ্রহেও আসছে নানা কৌশল।   কেউ এমনকি নিজস্ব ব্যবসাকে সামাজিক আন্দোলন কিংবা সামাজিক কার্যক্রম হিসেবে চালিয়ে দিয়ে আল্লাহর নামে কিংবা মানবতার নামে চাঁদা চান। এতে ফলও হয়। যেমন হাসাপতাল করতে হবে, সামাজিক সহায়তার জন্যে চাঁদা প্রদান করতে কিংবা ট্রাস্টি হয়ে হাসপাতালের মালিক হতে উদ্বুদ্ধ করা হয় । এতে কাজও হয। কিন্তু ঐ সহজ-সরল মানুষগুলোকে কিভাবে বোঝাবেন যে, একটা হাসপতাল পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকায় হয় না, এর জন্য শত শত কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। আর সেকারণেই শত-সহস্র্র কোটি টাকা যতদিন না হবে, ততদিন চাঁদা উত্তোলন চলতেই থাকবে, ট্রাস্টি এবং মালিকদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। অর্থাৎ ব্যবসাটা এখানে পাকাপোক্ত আগামীর অনন্ত দিনের জন্যে। নির্মিতব্য হাসপাতালের জন্যে বছরের পর বছর চলতেই থাকবে এই চাঁদা তোলা।

এই চাঁদা তুলতে গিয়ে টিভি কর্তৃপক্ষকে একটা ভাড়া দিতে হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই টিভি চ্যানেলগুলো ব্যবসায় বসেছে। টিভি কর্তৃপক্ষ বিনা পয়সায় তার ১২ ঘন্টার স্লট দেবেই-বা কেন ? তাইতো এর ভাড়া হয় অনেক। আগেই উল্লেখ করেছি, সব কটা টিভি চ্যানেল (বাংলা) ফ্রি চলে ব্রিটেনে কিংবা ইউরোপে। আর রমজান মাস চ্যানেলগুলোর জন্যেও নিয়ে আসে ব্যবসার এক প্রধান মাস হিসেবে। একটা টিভি চ্যানেল কম করে হলেও চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড খরছ করে প্রতি মাসে। দর্শক প্রিয় চ্যানেলটির মাসিক ব্যয় সত্তুর আশি হাজারের কম নয়। সব টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি খুব একটা ভালো নয়। যতটুকু জানা গেছে, দর্শক প্রিয় চ্যানেলগুলো তার স্লট ভাড়া বাবদ বারো-তেরো বা কম করে হলেও দশ হাজার পাউন্ড এবং অন্যান্য চ্যানেলগুলো ন্যূনতম সাত-আট হাজার পাউন্ড চার্জ করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি জানে ঐ খবর? তারা কি জানে মসজিদ-মাদ্রাসার একটি জায়নামাজের জন্যে একশত কিংবা দেড়শত পাউন্ড কিংবা জানালার জন্যে একশত পাউন্ড কিংবা সাউন্ড সিস্টেমের জন্যে তারা যে ৫০০ পাউন্ড দান করে, অথবা মানবতার দোহাই দিয়ে হাসপাতাল কিংবা এতিমখানা নির্মাণ করার কথা বলে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয়,  তা থেকে একটা অংশ যায় টিভি‘র স্লট ভাড়ায়, একটা অংশ যায় কোচ ভাড়ায়, একটা অংশ যায় ইফতারির খরচে, একটা অংশ যায় বাংলাদেশ-আফ্রিকা দোড়াদৌড়ির উড়োজাহাজ ভাড়ায় এবং বাংলাদেশ কিংবা আফ্রিকায় হোটেল ভাড়ায়। কেউ আবার বেতন-ভাতা নেন এই অর্থ থেকেই। অন্য খরচের কথা না হয় বাদই দিলাম। টিভি‘র ওয়াজের সময় এসব উচ্চারণ নেপথ্যেই থাকে। উচ্চারিত হয় না। এমনও  বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান দেখেছি, যারা প্রতি বছর আসে। নতুন নতুন প্রজেক্ট নিয়ে আসে। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে এরা বার বার সেই একই কথা বলে এবং আশ্চর্যের ব্যাপার বিলেতের বাঙালিরা তা লুফেও নেয়। এমনকি দেখা গেছে ব্রিটেনেও বিভিন্ন ব্যবসায়িক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ধর্মীয় লেবাস পরানো হয়েছে এ স্কুলগুলোর। একদিকে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে এখানকার গ্রামার স্কুলের মতো চার্জ করা হচ্ছে, আবার তারাই ঐ স্কুল কিংবা একাডেমীর জন্যে চাঁদাও তুলছে।

বলা প্রয়োজন, এতেও বলা হচ্ছে আপনার সন্তানদের দ্বীনি(ইসলামিক) শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে হবে এবং এর জন্যে অর্থ প্রয়োজন। কি আশ্চর্য সব ভণ্ডামি চলছে এখানে অবলীলায়!
এখানকার মসজিদ-মাদ্রাসা কিংবা স্কুলের জন্যে সংগ্রহ করা অর্থের কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা আছে। সেজন্যে এদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্যে উত্তোলন করা অর্থ নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি না হলেও চাঁদা তোলার এই পদ্ধতির নীতিগত দিক নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু দেশ থেকে আসা মাদ্রাসাগুলো কিংবা তথাকথিত মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে চাঁদা চাওয়ার স্বচ্ছতা শুধু প্রশ্নবিদ্ধই নয়, এগুলো রীতিমত সন্দেহজনকও।
এর আগে দেখা গেছে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ এমনকি জঙ্গি তৎপরতায়ও ব্যয় হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দেশের প্রতিষ্ঠানের জন্যে সংগ্রহ করা লাখ কোটি টাকা কোন পথে বাংলাদেশে যায়, তা-ও তলিয়ে দেখা উচিৎ। সেজন্যেই বিদেশি অর্থ-সমৃদ্ধ ধর্মীয় এমনকি কথিত মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সরকারের মনিটরিং এর আওতায় নেয়া প্রয়োজন।

ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালিদের হাজারো পরিচিত দুস্থ মানুষ পড়ে আছে দেশে। যাকাত-ফিতরা কিংবা সহায়তা তো দেশের মানুষগুলোরই পাওয়া উচিৎ। ভাবতে অবাক লাগে কি এক মোহের কাছে জিম্মি হয়ে আছে ব্রিটেনের অগণন বাঙালি। কিভাবেই এরা কোটি কোটি টাকা তুলে দেয় কোথায়, কোন্ অজানায়?

[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।