ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নীতিমালায় হ্যাঁ, আইনি ভীতিমালায় না

মোহাম্মদ আরজু, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, বার্তা২৪ ডটনেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১২
নীতিমালায় হ্যাঁ, আইনি ভীতিমালায় না

অনলাইনসহ কোনো গণমাধ্যমের ওপর সরকারকে নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দণ্ডবিধি প্রণয়ন চলতে পারে না। কিন্তু সেরকমই চেষ্টা চলছে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা তৈরির নামে।

তথ্য মন্ত্রণালয় জিনিসটির নাম দিয়েছে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা, কিন্তু ‘অনলাইন গণমাধ্যম’ কী জিনিস? প্রস্তাবিত নীতিমালাটিতে অনলাইন গণমাধ্যমের’ই কোনো সংজ্ঞা নাই। অনলাইনে এখন নানা ধরনের গণমাধ্যম গড়ে উঠেছে, ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে ব্লগ, নানা ধরনের ফোরাম, কমিউনিটি ব্লগ, মতামত-সংবাদসহ রকমারি তথ্য ভিত্তিক ওয়েবসাইট।

এসব ওয়েবসাইট শুধু ঢাকা ভিত্তিক নয়, জেলা এমনকি উপজেলা স্তরের উদ্যোক্তারাও এমন সব গণমাধ্যম গড়ছেন। এত বৈচিত্রের পরও অনলাইন গণমাধ্যমের কোনো সংজ্ঞা বা আওতা-পরিধির বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি সরকার প্রস্তাবিত নীতিমালাটিতে।

তবে এই নীতিমালায় এমন সব কানুন রাখা হয়েছে, সরকার চাইলে যে কোনো ওয়েবসাইটকে অনলাইন গণমাধ্যম সাব্যস্ত করে অফলাইনে পাঠিয়ে দিতে পারে। প্রস্তাবিত নীতিমালাটি অক্টোবর মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত করতে চায় সরকার। নাগরিকদের বা সংশ্লিষ্ট কারো কোনো মত না নিয়েই এ প্রস্তাবিত নীতির খসড়া করেছে সরকার। এ মাসের  ১২ তারিখে অনলাইন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ডেকে এ তথ্য জানিয়েছেন তথ্যসচিব, প্রস্তাবিত নীতিমালা সরবরাহ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছেন। ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মত দিতে হবে।

এই ডাকাডাকি থেকে এটুকু আন্দাজ করা যায়, সরকার অনলাইন গণমাধ্যম বলতে স্রেফ ঢাকা’র সংবাদ ভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলোকে বোঝাতে চাইছে আপাতত। যারা নিজেদের অনলাইন সংবাদপত্র বলে ডাকে, এমন কয়েকটি প্রধান ও অপ্রধান গণমাধ্যমকেই ডেকেছে তথ্য মন্ত্রণালয়, তাদেরই প্রস্তাবিত নীতিমালার বিষয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে ।

তো, এই অনলাইন ‘সংবাদপত্র’গুলোর জন্য সরকার নীতিমালা করতে চাইছে কেনো? অফলাইন বা ছাপা সংবাদপত্রগুলোর চেয়ে এর ভূমিকা তো আলাদা কিছু নয়, স্রেফ মাধ্যমটা ভিন্ন। ফলে মিডিয়াকর্মী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর গত ১৫ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিকে তার প্রতিক্রিয়ার শিরোনাম দিয়েছেন, ‘এ নীতিমালার প্রয়োজন নেই’।

তিনি যথার্থই বলছেন, ‘‘সংবাদপত্রের জন্য যা যা নীতিমালা রয়েছে, অনলাইনের জন্যও একই নীতিমালা প্রয়োজন। ’’ তিনি বলছেন, ‘‘অনলাইন সংবাদপত্র যদি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা পালন করে, তা হলে বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। বাকি কাজ আদালতের, তথ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। কোনো অনলাইন সংবাদপত্র কর ফাঁকি দিলে তা দেখবে এনবিআর। ’’

তবে ছাপা সংবাদপত্রের মতো অনলাইন সংবাদপত্রের জন্য সরকারি ঘোষণাপত্রের বিষয়ে আপত্তি নেই তার, ‘‘তথ্য মন্ত্রণালয় শুধু একটা কাজ করতে পারে। সংবাদপত্র প্রকাশের নীতিমালা অনুসরণ করে আবেদনকারীকে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশনার জন্য একটা ‘ডিক্লারেশন’ দিতে পারে। প্রকাশক যদি ডিক্লারেশন পাওয়ার যোগ্য হন, তা হলে ছাড়পত্র দিয়েই তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব শেষ’’ হতে পারে। সংবাদপত্র বের করবার জন্য সরকারি ডিক্লারেশনের বাধ্যবাধকতার ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার বিষয়ে কেউ নীতিগতভাবে একমত হলে অনলাইন সংবাদপত্রের ব্যাপারেও তা চলতে দেয়ার বিষয়ে একমত থাকা চলে।

কিন্তু শুধু ডিক্লারেশন দেয়ার প্রচলিত দায়িত্বটুকুর বাইরে সরকার এত বিশাল নীতিমালা করতে যাচ্ছে কেনো? মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর মনে করেন, ‘‘তথ্য মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে কিছু টাকা রোজগারের ফন্দি এঁটেছে বলেই আমাদের ধারণা। ’’ অনলাইন সংবাদপত্রগুলোর থেকে নানা খাত দেখিয়ে ‘কিছু টাকা রোজগারের’ ব্যবস্থা নীতিমালায় রাখা হয়েছে সত্যি; লাইসেন্স ফি দিতে হবে, জামানত রাখতে হবে, লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে, বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া আয়ের শতকরা ২ ভাগ সরকারকে দিতে হবে ইত্যাদি।

কিন্তু আমরা এটা মনে করতে পারছি না যে, সরকারের ‘ফন্দি’ এই আয়টুকুই, কারণ লাইসেন্স ফি’র সঙ্গে আছে লাইসেন্স দেয়া বা না দেয়ার বিষয়টি— এমনকি লাইসেন্স নবায়ন না করা, স্থগিত বা বাতিল করাও।  

এভাবে অনলাইন গণমাধ্যমে চিহ্নিত সম্ভাব্য সরকারি আয়ের খাতগুলো মূলত এ গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যম মাত্র। লাইসেন্স ছাড়াও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রেগুলেটরি কমিটি, সরকারি নির্দেশ পালনের বাধ্যবাধকতা, দেশীয় সার্ভারে তথ্য সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতা, কি সম্প্রচার করা যাবে আর কি যাবে না ইত্যাদি আইনি বিধান রাখা হয়েছে। সবমিলিয়ে এটি এক দণ্ডবিধি হয়ে উঠেছে।

সরকার যদি আসলেই কোনো নীতিমালা প্রস্তাব করতো, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে এটা ধরে নেয়া যেতো যে, অনলাইন সংবাদপত্রের ব্যাপারে এটি সরকারের নীতিগুলোর সমষ্টি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এটা আর নীতির স্তরে থাকেনি। এটা হয়েছে এমন এক আইন যা এমনকি সাধারণ ন্যায়বিচারের নীতি বা প্রিন্সিপাল অফ ন্যাচারাল জাস্টিসের বিরুদ্ধে যায়— যেই আইনে যিনি পুলিশ, তিনিই আদালত।

এই আইনে সরকারকে যেই  ব্যাপক ও অনির্দিষ্ট ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, এই আইন না মেনে অনলাইন গণমাধ্যম জন্ম নিতে বা বেঁচে থাকতে পারবে না। এই কালো আইনটি না মানলে অনলাইন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে সরকার, আবার নিজের অভিযোগের নিজেই বিচারক হয়ে অনলাইন গণমাধ্যমকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে। গণমাধ্যমের ব্যাপারে এমন আইন হতে পারে না।

বড়জোর সরকার চাইলে এ ধরনের গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুবিধা ব্যবহার করতে দিয়ে বিকশিত হতে সাহায্য করতে- সরকারের সঙ্গে এর সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে নাগরিকদের ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আগে থেকেই আলাপ-আলোচনা করে সরকার কিছু নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। দেশে দেশে এভাবে সরকারগুলোর নানা নীতি থাকে নানা ব্যাপারে। বাংলাদেশ সরকার চাইলে সার্বিকভাবে গণমাধ্যমের প্রতি তাদের নীতি নির্ধারণ করে এমন নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু আইনি ভীতিমালা নয়।

আর অনলাইনসহ যেকোনো ধরনের সংবাদমাধ্যমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রেস কাউন্সিলকে আরো গণতান্ত্রিকভাবে গঠন করে একে কাজের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা চলে, সে কথা আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি। [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সম্পাদনা: আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।