ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শিক্ষা দিবসের সূবর্ণজয়ন্তী এবং আজকের ছাত্রসমাজ

সঞ্জীব রায়, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১২
শিক্ষা দিবসের সূবর্ণজয়ন্তী এবং আজকের ছাত্রসমাজ

সতেরই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ৬২ সালের এই দিনে শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল।

রাজধানীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল ওয়ালিউল্লাহ, বাবুলরা। আইয়ুব খানের জাতীয় শিক্ষা কমিশন যা শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত ছিল, ছাত্রসমাজ তা প্রতিরোধে সোচ্চার হয়। টাকার বিনিময়ে শিক্ষাকে একটি সাধারণ পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেছিল সেই শিক্ষা কমিশন। ধারাবাহিক আন্দোলন-প্রতিবাদের পথপরিক্রমায় বাষট্টির সতেরোই সেপ্টেম্বর হরতাল আহ্বান করেছিলো ছাত্রসমাজ।   সেই কর্মসূচিতে জীবনদানকে স্মরণ করেই বাঙালি পালন করে আসছে শিক্ষা দিবস। এই দিবসকে স্মরণ করার দায়টা সবসময়ই বেশি করে বর্তায় ছাত্রসমাজের প্রতি। ছাত্রসমাজ শুধু জাতীয় যে কোনো প্রয়োজনেই অগ্রণী ভূমিকা রেখে নয়, নিজেদের শিক্ষার জন্য লড়াই করেও প্রমাণ করতে পারে স্বকীয় তেজস্বী রূপের। শুধুমাত্র ষাটের দশক নয়, স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশেও এমন অগুনতি ঘটনা আছে, যেখানে ছাত্রসমাজ শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়েছে, আন্দোলন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

শিক্ষা দিবসের পঞ্চাশ বছর বা সূবর্ণজয়ন্তী ছাত্রসমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এদেশের ছাত্রসমাজ জাতীয়ভাবে নানমূখী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটিকে স্মরণ করবে তেমনটাই ভাবা উচিৎ। আর সেই ভাবনাটা এ কারণেই যৌক্তিক যে, সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার বৈষম্য দূর করে সব মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার দাবি তোলা হবে উচ্চকিত কণ্ঠে। কিন্তু বাস্তবতা নিশ্চয়ই তেমন সুখবর দিচ্ছে না। আজকের ছাত্রসমাজ শিক্ষা দিবসকে কতোটা ধারণ করছে, স্মরণ করছে তা থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন আকারেই। জবাবটা খুঁজতে গেলে অবশ্যই হতাশা বাড়বে। কিন্তু কতক্ষণ আরো হতাশাগ্রস্ত হবার ভয়ে কিংবা শংকায় উত্তরটা খুঁজবো না আমরা? কেন আমরা উন্মোচন করবো না সত্যিটাকে?

আজ এদেশের ছাত্রসমাজ একটু একটু করে দূরে সরছে নিজেদের মৌলিক দাবি নিয়ে কথা বলার মঞ্চ থেকে। শিক্ষা দিবস নিয়ে, শিক্ষা দিবসের ইতিহাস, দর্শন আর মূল চেতনা নিয়ে একাডেমিক কোন ধারণা কোন পর্যায়ে দেওয়া হয় না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। আর সামাজিকভাবে চর্চার জায়গাটিও কমছে দিনকে দিন। ছাত্রসমাজ নিজেদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিয়ে এখন আর প্রশাসনের কাছে কোন জবাব চায় না, জবাব চায় না রাষ্ট্রের কাছেও। যার ফলে রাষ্ট্র যখন কোন শিক্ষা সংকোচন নীতি গ্রহণ করে, তখন প্রতিবাদের ভাষা খুব সীমিত দেখা যায়। যার ফলে, প্রশাসন যখন নিজেদের ইচ্ছাখুশীমতো শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধি করে কিংবা অপ্রত্যাশিত কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, তখন তা নিশ্চুপভাবে মেনে নেয় ছাত্রসমাজ।

তার মানে কি ছাত্রসমাজের তেজস্বী চরিত্র পাল্টে গেছে। নাকি শক্তি-বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনা কমে গেছে! উত্তরগুলো সরাসরি নেই। কিন্তু, যে ছাত্রটি হঠাৎ করে টিউশন ফি একশ টাকা বাড়ানো হলে প্রশাসনের কাছে জবাব চায় না, সেই ছাত্রটিই রিক্সাওয়ালাকে দশটাকা ভাড়া না দিয়ে থাপ্পর দেয়। যে ছাত্রটি ভর্তি ফি কেন এ বছর দুহাজার টাকা বেশি নেওয়া হবে, তার প্রতিবাদ করে জানতে চায় না, সেই ছাত্রটিকেই দেখি হোটেল-রেস্টুরেন্টে দাপট দেখিয়ে ফ্রি খাচ্ছে! শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। এর কোন প্রতিবাদ-প্রতিরোধে যে ছাত্রটিকে কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেই ছাত্রটিকেই খুঁজে পাবো হকিস্টিক হাতে সিএনজি-অটোরিকশা ভাঙ্গতে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যে ছাত্ররা কখনোই তার গবেষণার জন্য বরাদ্দ না থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে একটি মিছিলে অংশ নেয়নি, তাদেরই দলে দলে দেখা মিলবে জাতীয় নেতানেত্রীদের জন্মদিনে অভিনন্দন র‌্যালিতে। পরিবহন সংকট-হলে আসন সংকটের শিকার হওয়া যে ছাত্ররা একটি দিনও প্রতিকার চেয়ে সোচ্চার হলো না, তাদের উপস্থিতিতে দীর্ঘ হয় কোন জাতীয় নেতাকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনার দাবিতে মিছিল।

এমনই এক পরিস্থিতিতে এই ছাত্রসমাজের সামনে এসেছে শিক্ষা দিবস। এভাবে পঞ্চাশটি বছর কেটেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে কেটেছে চল্লিশ বছর। সংবিধানে আমরা শিক্ষাকে বৈষম্যহীনভাবে সর্বসাধারণের জন্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব দিয়েছি। কিন্তু যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে, তারাই ভঙ্গ করেছে সংবিধান। তারাই প্রতিবার সুযোগ করে দিয়েছে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করার। আজ চল্লিশ বছর পরে এসে একটা বড় ধরনের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। যাদের ব্যবসা হলো শিক্ষা নিয়ে। রাষ্ট্র নানা সময়ে এই ব্যবসায়ীদের সমর্থন-আশির্বাদ দিয়ে এসেছে। আর পক্ষান্তরে সচেতন ছাত্রসমাজ হয়েছে সেই বাণিজ্যের শিকার। ছাত্রসমাজ এখন পূঁজি দিয়ে শিক্ষা কিনে তার মুনাফা তুলে নিতে চায়। এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অশুভ চক্র। সেটা আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে খুব ভয়ানকভাবে ক্রিয়াশীল। এদেশের ছাত্রসমাজ বিশেষত নব্বই পরবর্তীকাল থেকে প্রো-স্ট্যাব্লিশমেন্টের জ্বরে ভুগছে। এই জ্বর ভাইরাস আকারে ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল থেকে কলেজে, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রাম-শহর নির্বিশেষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাল ফিবার। প্রো-স্ট্যাব্লিশমেন্টের ভাবনায় এখন ছাত্রসমাজ ভুলে গেছে চেতনার মন্ত্র। এই সত্যটাকে উন্মোচন করে ফেলার পর একটা বড় রকমের দায়দায়িত্ব বর্তায় সবার ওপর। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী-নগারিক সমাজ-রাজনীতিক প্রত্যেকেরই।

শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে সব পর্যায়ে সমানভাবে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্যহীনভাবে মানসম্মত একই ধারার শিক্ষা বিস্তৃত করতে হবে। সেই শিক্ষা হবে বিজ্ঞানমুখি, জীবনঘনিষ্ট, মানবিক এবং সর্বাগ্রে আধুনিক। সেই শিক্ষা ধনী-গরিব নির্বিশেষ সব মানুষের সন্তানদের গড়ে তুলবে, সচেতন-দেশপ্রেমিক-দক্ষ এবং মেধাবী মানুষ হিসেবে। সেই শিক্ষা ছাত্রসমাজকে ভ্রান্ত পথের পথিক করবে না। সেই শিক্ষার মান হবে বিশ্ব দরবারে ঈর্ষণীয়। সেই শিক্ষা যে মানুষ তৈরি করবে তার অবদান জাতিকে এগিয়ে নেবে উন্নয়নের পথে। সেই শিক্ষা গড়ে তুলবে একটি উদার-গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-বৈষম্যহীন-সমৃদ্ধ-অগ্রগতিশীল সমাজ-অর্থনীতি। তখন আর আত্মকেন্দ্রীক মানসিকতার, ব্যক্তিকেন্দ্রীক ভাবনার বৃত্তবন্দী চিন্তার দারিদ্র্যে কাতর থাকবে না আমাদের ছাত্রসমাজ, আমাদের নাগরিক সমাজ। সেই কাজটি করতে হলে এই মূহুর্তে ছাত্রসমাজকেই নিতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। ছাত্রসমাজেরই আছে অসুস্থতার বৃত্ত ভেঙে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনবার সোনালী ইতিহাস। সেই ইতিহাসের ধারক হিসেবে আজকের ছাত্রসমাজকেই দায়িত্ব নিয়ে সকলকে জাগিয়ে তোলার কাজটি হাতে নিতে হবে। শিক্ষা দিবস দিচ্ছে ডাক - ছাত্রসমাজ জাগুক আজ!

লেখক:  গণমাধ্যমকর্মী‍
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১২
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।