ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নিজেকে বাঁচাই কী করে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪
নিজেকে বাঁচাই কী করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

শিক্ষাঙ্গনে প্রতিহিংসা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষকদের আক্রমণ করাটা কেবল ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই আক্রমণ করা। শিক্ষকরা এমনিতেই অন্যান্য পেশাজীবীর তুলনায় বঞ্চিত, তদুপরি শ্রদ্ধা যদি বিনষ্ট হয়, তাহলে শিক্ষকতার আকর্ষণ যতটুকু আছে, সেটাও থাকবে না।

শিক্ষক লাঞ্ছনা কিন্তু মাদরাসা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাঙ্গনে ঘটছে না। ঘটছে কেবল মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায়। একজন শিক্ষক যদি তার নিজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা লাঞ্ছিত-অপমানিত হন, তবে জ্ঞান-বুদ্ধি যা-ই থাকুক, তিনি আর শিক্ষক থাকেন না। একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।

আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি দুজন শিক্ষককে নিয়ে। আপাত আনন্দের, কিন্তু অন্তরে দুঃখের। ফাদার মার্টিন একটি অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। সেন্ট গ্রেগরীজ (নটর ডেম) কলেজে তখন ছাত্রসংখ্যা সব মিলিয়ে এক শরও নিচে।

এই স্বল্পসংখ্যক ছাত্র নিয়ে তিনি শেকসপিয়ারের একটি পুরো নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন মূল ইংরেজিতে, পুরনো স্কুলের মাঠে। নাটকের টিকিটও আমরা বিক্রি করেছিলাম, ছাত্ররাই; সব খরচ উঠেও টাকা বেঁচেছিল কিছু, যে টাকা খুলনার বাত্যাবিধ্বস্তদের সাহায্যের জন্য পাঠানো হয়েছিল। সে বছর বড় একটি ঝড় হয়েছিল খুলনা অঞ্চলে। অভিনেতাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। নাটকের মাঝখানে বিরতি হয়েছে, সেই সময়ে গ্রিনরুমে দেখি অজিত কুমার গুহ।

দেখে আমি চমকে উঠেছি। না, পরিচিত পোশাকে নেই। একটু শীত শীত ছিল, দেখি নীলচে কালো একটি স্যুট পরে এসেছেন তিনি। পরিপূর্ণ স্যুটে বড় উজ্জ্বল মনে হচ্ছিল তাঁকে, বড় অপরিচিত। আমরা অভিনেতারা তো তখন সবাই সাজপোশাক পরেছি, রং পরেছি আমাদের গালেমুখে, কিন্তু অজিত স্যার তো জীবন্ত, বাস্তব; অভিনেতা নন, দর্শক। মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন আমাদের, ‘দর্শকদের ভয় করবে না। মনে করবে তারা গরু-ছাগলের পাল। ’ মূল্যবান উপদেশ, সন্দেহ কী। কিন্তু এই উপদেশের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল তাঁর নীলচে কালো স্যুট। খুব সুন্দর মানিয়েছিল বলেই মনে হয়েছিল বেমানান।
প্রতিহিংসা প্রবণতা পরে আমি ভেবেছি এবং বিষণ্ন ঠেকেছে আমার কাছে ওই বিষয়টা। ফাদার মার্টিন কি তাহলে জিতে গেলেন? জয় হলো সাম্রাজ্যবাদের? সাম্রাজ্যবাদই কি বলে দিয়েছে গোপনে যে স্বাভাবিক পোশাকে চলবে না, আসতে হবে স্যুট পরে? রাষ্ট্র ছিল আমেরিকানদের তাঁবেদার, সংস্কৃতিও কি তাদের অধীন হয়ে যাবে? সাম্রাজ্যবাদকে আমি ক্ষমা করব কী করে? আমার শিক্ষককে সে অপমান করেছে!

বসাক স্যারকে হঠাৎ দেখি নতুন ঢাকায়। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে বাস থেকে নামছেন। কিংবা বাস তাঁকে নামিয়ে দিচ্ছে। কেন জানি না দ্বিতীয়টাই বেশি সত্য মনে হলো আমার। আমি শুনতে পেলাম সমস্ত পরিবেশ, ব্যস্ত পথ, ক্রুদ্ধ আওয়াজ, ধুলা, মানুষ, আশপাশের দোকানপাট সবাই একসঙ্গে চিৎকার করছে, আপনি এখানে কেন? কী চান? কী দরকার?

আমার সাহস হয়নি কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বলি, ‘স্যার, আমি আপনার ছাত্র। ’ আমার নিজেকেই অপাঙক্তেয় মনে হয়েছে সেদিন ওই বিকেলে। সেই উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশে। বসাক স্যার কোথায় ছিলেন, কেমন ছিলেন, কিছুই জানা ছিল না আমার। ভূগোল পড়াতেন, খুব জানতেন এবং যেমন মনে হয় ছাত্রদের, তেমনি মনে হয়েছিল আমারও, যদি স্যারের মতো ভূগোল জানতাম। কিন্তু কেমন যেন ম্রিয়মাণ ছিলেন তখনই। তখন পাকিস্তান হয়েছে, আমরা এসেছি কলকাতা থেকে, মিশনারিদের ওই স্কুলে ভর্তি হয়ে শুনি হিন্দু শিক্ষকদের অনেকেই চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। বসাক স্যাররা আছেন, তাঁরা পড়াচ্ছেন। আধাবাঙালি ছেলে ছিল দু-তিনটি ওই ক্লাসে। রাজাকারদের পূর্বসূরি, নানা রকমের গোলযোগ সৃষ্টি করত। বসাক স্যারকে মনে হতো সব কিছু পারেন, কেবল ওদের সঙ্গে পারেন না। সেই শিক্ষক আমার কী করে পার হয়েছেন এত বছর, পার হলেন কী করে ঘাতক একাত্তর, কোথায় থাকেন, কেন এসেছেন এই নতুন শহরে, যে শহর তাঁকে চেনে না, মর্যাদা দেয় না, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায়, সেখানে? আরো ঝুঁকে পড়ে হাঁটছেন, আরো মলিন বেশবাস। কেন এসেছেন?

আমার সাহস হয়নি, এগিয়ে যাই, গিয়ে জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন, যাচ্ছেন কোথায়? আমার ভয়, স্যার হয়তো ছাত্র পড়াতে চলেছেন ওই বৃদ্ধ বয়সে। তাদের কারো গৃহে কি, যারা একদিন হল্লা করতে চাইত তাঁর ক্লাসে? ত্যক্তবিরক্ত করত নিজেদের অবস্থানের জোরে?

আরো এক ভয় ছিল আমার। মৃত্যুর। পুরনো কালের আপনজনদের কাছে যেতে আমার বুক কাঁপে, কথা বলতে গিয়ে আশঙ্কা হয় দেখব তিনি নেই, অজান্তে চলে গেছেন, দেখব আমিও নেই, সেই আগের আমি, মৃত্যু ঘটেছে আমারও। প্রায়ই হয়েছে এমন যে দেখা হলে প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো অতীতকে খুঁজেছি আমরা উভয়েই, কঙ্কাল পেয়েছি কিছু খুঁজে, প্রাণ পাইনি। সেই উচ্ছ্বাস, আগ্রহ, উদ্দীপনা, কলহ, মৈত্রী, প্রতিহিংসাপরাছুতা সব গেছে মরে। নাড়তে গেলেই টের পেয়েছি ভেঙে পড়বে টুকরা টুকরা হয়ে। কোন সাহসে যাই আমি আমার পুরনো শিক্ষকদের কাছে?

কিন্তু বসাক স্যার আছেন আমার জীবনে, আমার মনে হয়েছে সেদিন, হাঁটতে হাঁটতে। সব শিক্ষকই থাকেন, কোনো না কোনোভাবে। কে তাঁদের খোঁজ পাবে যে ভ্রুকুটি করবে কিংবা ধমক দেবে? দুজন শিক্ষক বিশেষভাবেই রয়েছেন, জানি আমি, বুঝতে পারি। একজন সাহিত্যের, অপরজন অঙ্কের। বাংলা পড়াতেন দুজন, রায় স্যার অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন ব্যাকরণে, চক্রবর্তী স্যার সাহিত্যে। রায় স্যার চলে গেলেন কলকাতায়, চক্রবর্তী স্যার রইলেন। সমসাময়িক ছিলেন তিনি বুদ্ধদেব বসুর, সহপাঠী অজিত দত্তকে কবি হতে দেখেছেন, নিজের চোখে। বুদ্ধদেব বসুর ব্যক্তিগত প্রবন্ধগুলো ক্লাসে পড়ে শোনাতেন তিনি। পুরানা পল্টনের কথা, মফস্বলের পোস্ট অফিসের কথা। বড় সুন্দর করে পড়তেন, যেন কবিতা পড়ছেন, গদ্যে। সেসব প্রবন্ধের প্রতি অনুরাগ পরীক্ষা পাসের ব্যাপারে কতটা কী সাহায্য করেছে আমাকে, তা জানি না, কিন্তু সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তৈরিতে যে কাজ করেছে, তাতে সন্দেহ করার কোনো উপায় নেই। সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন চৌধুরী স্যার। অঙ্কের। আমি সাধারণ ও অতিরিক্ত দুই অঙ্ক নিয়েছিলাম, ধারণা ছিল বিজ্ঞান পড়ব পরে। আর বিশেষ গাঢ় একটি স্বপ্ন ছিল, হায়, যদি অঙ্ক পারতাম চৌধুরী স্যারের মতো। পারিনি। বিশেষ সুবিধা হয়নি অঙ্কে। যে জন্য নিজেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলাম জারি করে ভবিষ্যতে নিজের বিজ্ঞান পাঠের ওপর। প্রভাব দুটিই, ইতির দিক থেকে চক্রবর্তী স্যারের, নেতির দিক থেকে চৌধুরী স্যারের। কিন্তু তাঁরা দুজনই ছিলেন, এখনো জানি আমি, আছেন আমার ভেতরে। অতি গভীরে। শিক্ষকরা থাকেন। থাকেন কি? এখন থাকেন কি? কেমন থাকেন শুরুর ঘটনাগুলোই বলে দেয়। তাঁদের ছাত্ররা দীক্ষা নেবে কী, উল্টো কান ধরে উঠবস করায়। শিক্ষকদের শপথ করানোর মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটিয়েছে। এখন স্কুলের ছবি আলাদা। এখন সেখানে দলবদ্ধভাবে যায় না ছেলেরা, যেমন আমরা যেতাম, যেন মিছিল চলেছে, মনে হতো। এখন হাঁটা থাক, রাস্তা পার হওয়াই কঠিন, ব্যস্ত সময়ে প্রায় অসম্ভব। এখন স্কুলে পড়া হয় না, শুনি আমি। শুনব কেন, দেখিও তো বটে। বিদ্যার চর্চা এখন গৃহে গৃহে। ‘ভালো’ শিক্ষকরা নিজেদের ঘরে পড়ান, স্রোতের মতো ছেলেমেয়েরা আসে, স্রোতের মতো বের হয়ে যায়। তেমন যাঁরা ‘ভালো’ নন, তাঁরা নিজেরাই যান ছাত্রের গৃহে। ফেরি করতে বিদ্যা। বাসে করে যান হয়তো, ধাক্কা দিয়ে বাস নামিয়ে দেয়। বিরূপ বিশ্ব চিৎকার করে, কে? কে আপনি? কী চান এখানে? সেই আমার বাল্যের শিক্ষক, ভূগোলের বসাক স্যার, পুরনো ঢাকার আশ্রয় ছেড়ে নতুন ঢাকায় এসেছেন কি গৃহশিক্ষকতা করবেন বলে? আমি ভাবতে পারিনি, আমার চোখ ছলছল করে উঠেছে। কোথায় থাকেন, স্যার? পুরান ঢাকায়, নারিন্দার কিংবা সূত্রাপুরের বাড়িটা কি তাঁর নিজের ছিল, নাকি ভাড়া করা? ছেলেমেয়েরা কে কোথায়? পুরনো স্কুলে একবার আমি গিয়েছিলাম। বাইরে নয়, একেবারে ভেতরে। একেবারে প্রধান অতিথি হয়ে। কেউকেটা তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি হয়তো, সেই অবকাশে আমার যাওয়া প্রধান অতিথি হয়ে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীতে। মঞ্চের ওপর বসা আমি, দেখছি চারদিকে, কিন্তু কেউ নেই, আমার নিজের শিক্ষকদের কেউ নেই, আশপাশে তখন যাঁরা অল্পবয়সী ছিলেন তুলনামূলকভাবে, তাঁদের দু-একজন আছেন যেন পূর্বজন্মের সাক্ষী হিসেবে। তবু আমার ভয় করছিল, হঠাৎ মনে হচ্ছিল আমি নেমে চলে যাব নিচে, গিয়ে বসব পেছনের বেঞ্চগুলোর একটিতে, ছাত্র হয়ে যাব এই বিদ্যালয়ের, যেমন একদিন ছিলাম সত্যি সত্যি অনেক আগে। ফেরার পথে ভেবেছি আমি ওই স্কুল পুরনো স্কুলই আছে একদিক দিয়ে। ওখানে কেউ গাড়িতে করে আসেনি। আমাদের সময়েও আসত না, যদিও গাড়ি ছিল হয়তো কারো কারো। নিষেধ ছিল। সৌজন্যবোধের। এখন আসে, বোধ হয় অন্য কারণে। সেই ঢাকা নেই বলে। নতুন ঢাকা, পুরান ঢাকা তো ছিল না তখন, বঙ্গভঙ্গ হয়েছে, কিন্তু ঢাকা ভঙ্গ হয়নি, ঢাকা তখনো এক ও অবিভক্ত, কিন্তু এখন তো অনেক ঢাকা এই ঢাকায়, নতুন ঢাকায় যাবে না পুরান ঢাকায়, যদিও পুরান ঢাকা আসতে পারে নতুনে। লক্ষ্মীবাজারে গাড়ি নিয়ে যাওয়া কঠিন। আরো কঠিন গাড়ি না থাকলে যাওয়া। এখন হলে আমার বাবা আমাকে সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবতেন না, আসতে-যেতে ২০ টাকা রিকশা ভাড়ার কথা ভেবে।

আসল সত্য মনে হয় ওটাই। বিভাজন, বৈষম্য। সেটা বাড়ছে। কে কোথায় ছিটকে পড়ছি আমরা। যে বাস ফেলে রেখে গেল বসাক স্যারকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে, তার কি কোনো দয়া আছে? সে কি করুণা জানে? মর্যাদা দিতে শিখেছে কি শিক্ষার এবং শিক্ষকের? স্যার, আপনাকে বাঁচায় কে? শত্রু তো কেউ একা নয়, শত্রু গোটা ব্যবস্থা। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর পোয়াবারো গেছে রাজাকারদের, একাত্তরের স্বাধীনতা ক্ষমতা দিল কাদের হাতে? আমি কাকে বাঁচাব, স্যার? শিক্ষক বলে নিজেকে বাঁচাই কী করে?

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১০২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।