ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ধর্মের নামে আর কতো অধর্ম?

সুমি খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১২
ধর্মের নামে আর কতো অধর্ম?

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা জানিয়ে দিলো “তোমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। ” এদেশের মাটিতে আবারো আক্রান্ত হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

৩০ সেপ্টেম্বর গত ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও তে  আদিবাসী, বৌদ্ধ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বর্বরোচিত সহিংস ঘটনা সংগঠিত হয়েছে । স্থানীয় বিএনপি সাংসদ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভ’মিকা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ।   প্রত্যন্ত এই এলাকায় আকস্মিক এই হামলার নেপথ্যে কারা? সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে প্রশাসনকেই।

হামলা ও বৌদ্ধ মন্দির পোড়ানোর ঘটনায় জামায়াতে ইসলামী, নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরিরসহ স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন জড়িত বলে অভিযোগ করেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ তিন সংগঠন। আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিত-হামলা, বৌদ্ধবিহারে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের পক্ষ থেকে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় ষাট- সত্তর বছর আগে লিখেছিলেন, “জাতের নামে বজ্জাতি সব- জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া?”  আমরা বারবার ধর্মের নামে এতো বজ্জাতি কেন সয়ে যাচ্ছি?  একাত্তরের পর ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ  নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ রকমের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে- যার প্রত্যক্ষদর্শী  এবং ভুক্তভোগীদের একজন আমি নিজে। ২০১৩ সালের  নির্বাচন কে  কেন্দ্র করে একই কায়দায় আবারো জঙ্গি রাজনীতিকদের বজ্জাতি শুরু হয়েছে।   আমাদের প্রত্যেকের সাধ্যমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেকাতে হবে এই জঙ্গীবাদ আর তাদের সহিংসতা। আমাদের  পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার জন্যে সোমালিয়ার মতো দুর্ভিক্ষপীড়িত জঙ্গি দেশ অথবা পাকিস্তানের মতো  বিপন্ন হবার আগেই বাঁচাতে হবে এই ক্রম-উন্নয়নশীল  রাষ্ট্র আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ কে।

এরা বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু শূন্য করতে চায়। ১৯৪৭ সালে ২৯.৭% ১৯৭০ সালে ছিল ২৩.৬% ১৯৭৪ সালে ১৯.৫% এখন ৯.৩% । এই ধারা অব্যাহত থাকলে জিরো পার্সেন্টেজে পৌছাবে, যা বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে বিচ্যুত করা হবে। এসব বিষয় সামনে রেখে আগামী ৬ অক্টোবর সারাদেশে ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু বিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ দিবস পালনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

মওদুদীবাদ  মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতায় উন্মাতাল হতে ইন্ধন দিয়েছে- বলছেন গবেষক আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা। আর এর সাক্ষী  যুগে যুগে লক্ষ কোটি  নির্যাতিত মানুষ।   এদেশের কিছু মানুষের রক্তে মিশে গেছে তাদের কপট রাজনীতি । যা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে-  ‘ধর্মের অবমাননা’র মিথ্যে ধুয়া তুলে  ভাইয়ের- বোনের রক্তের হোলিখেলায়  মাতিয়ে দেয় আপন ভাই- বোন বাবা-মাকে।

ভস্মীভ’ত চারটি মন্দিরের মধ্যে  দুইটি রাখাইনদের। দুইটি স্বর্ণের বৌদ্ধ মূর্তি লটে নিয়েছে জঙ্গীরা। কক্সবাজার ঝিলংজা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক জিকু  সাংবাদিকদের বলেছেন  জামায়াতের কর্মীদের সংগঠিত হবার খবর তিনি জনতে পেরে সাথে সাথে জানিয়েছেন পুলিশকে । এর পর ই হামলা হয়। প্রত্যন্ত এলাকায়  এভাবে জঙ্গি সমাবেশ করে পরিকল্পিতভাবে একের পর এক মন্দির আর বসত বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিলো . র্যাব-পুলিশ   জানতেই পারলোনা?  সরকারকে ভাবতে হবে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার জনগণের জানমাল রক্ষায় সংখ্যালঘু কর্মীবাহিনী তৈরি করতে হবে।

৬ অক্টোবর ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু বিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ দিবস পালনের কর্মসূচি  নিয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ , আদিবাসী  ফোরাম। স্বাগত জানাচ্ছি সহিংসতার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদী কর্মসূচিকে ।
২০১৪ সালের  জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট  সবাই তৎপর। তবে   কারা বেশী তৎপর? কারা  বেশী   সংগঠিত? অবশ্যই যারা এই পরিকল্পিত হামলা করছে তারা। আর যারা এই সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ব্যস্ত।

প্রগতিশীল শক্তির দাবিদার সুশীল সমাজ এবং তাদের দোসরেরা   এখন একটু সক্রিয় হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক  শক্তি  রক্তের হোলিখেলা না খেললে এদের বিরুদ্ধে তাদের কলম ও চলে না, মুখ ও খোলেনা। অন্ধকারের এ শক্তির কাছে আত্মসমর্পন কারী মেরুদন্ডহীন  ব্যক্তিরা দেশকে   অন্ধকারের দিকে ঠেলে নামাচ্ছেন। ২০০১ সালে  নির্বাচনের আগে এবং পরের  সাম্প্রদায়িক হামলা ও পুনরাবৃত্তি  হলো। এবং সেই  সময়কালের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্যে স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক  শক্তি  একের পর এক হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ করে সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে  দেখালো তারা বরাবরের মতোই প্রস্তুত। মিথ্যা  ভিত্তিহীন  জিকির তুলে গত কয়েকমাসে চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকার পাথরঘাটা, উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী , সাতক্ষীরা, দিনাজপুরের চিলবন্দর, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে। একই ধারায় রামু , উখিয়া, টেকনাফ এবং পটিয়ার কোলাগাঁওতে সহিংস ঘটনা  ঘটিয়েছে।

সাম্প্রতিক এ ভয়াবহ ঘটনার পর সবার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার - মানবতার চরম লঙ্ঘন দেখেও  আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অত্যাচারীদের সমর্থন করে নির্বিকার ভ’মিকা পালন করেছে।   হামলাকারীদের রোধে বা প্রতিরোধে কোন রাজনৈতিক দলের ভ’মিকা নেই। প্রশাসনের কেউ কেউ  উস্কানি, আশ্রয়, প্রশ্রয়, মদদ দিয়েছে । সেখানে ২০০১ সালের ঘটনা নিয়ে  হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত শাহাবুদ্দিন কমিশনের  সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের কোন পদক্ষেপ দেখিনি। এখন শুনছি সেই অনুযায়ী ১৮টি মামলা করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এই আন্দোলনের  সাথে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ যুক্ত ।
এদেশের পর্যটন শিল্পের অনেক বড় সর্বনাশ করে দিয়েছে ঐতিহাসিক ভাস্কর্য এবং বৌদ্ধ মন্দিরের উপর এই  ন্যাক্কারজনক হামলা। ধর্মে দেশপ্রেমের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি ধর্মেই আছে দেশপ্রেম যার নেই - তার ধর্মহীনতা প্রশ্নাতীত। মানুষ এবং তার মাথা গোঁজার ঠাঁই বাড়িঘরের উপর এমন ধ্বংসযজ্ঞ ভীষণ সর্বনাশা। যারা এই হামলা করেছে, তারা এই  দেশকে সোমালিয়া আর পাকিস্তান করতে চায় ।

রামুতে ১২, উখিয়ায় ৪, চট্টগ্রামের পটিয়ায় ৪টিসহ মোট ২০টি বৌদ্ধবিহার, কোলগাঁওয়ে ৩টি হিন্দু মন্দির, প্রায় পাঁচশ বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। এ সময় বুদ্ধমূর্তি, দুর্গামূতি ও শিবমূর্তি ভাংচুর করা হয়েছে। অগ্নিসংযোগের আগে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৭০ কোটি টাকা। প্রশাসনের নাকের ডগায় সব ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার। সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের অনেকের বিরুদ্ধেও এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

২০০১ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার ঘটনার বিচার হয়নি আজও। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ধর্ষণ অগ্নিসংযোগসহ সাড়ে তিন হাজার অপরাধ চিহ্নিত হয়। সে সময়ে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের মানুষজন নানাভাবে নির্যাতিত হন। ৩৫৫ জনকে হত্যা করা হয়। সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর দখল, গণধর্ষণের মতো জঘন্যতম অন্তত সাড়ে তিন হাজার অপরাধের ঘটনা ঘটে।

এসব ঘটনার তদন্ত করে বিচার করতে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে। মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরকে বিভিন্ন জেলায় ১৬টি মামলা দায়ের করতে নির্দেশনা দেয়।

পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার ইত্তেফাককে বলেছেন, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যেসব থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে পটুয়াখালি জেলার মির্জাগঞ্জ থানা, ভোলার লালমোহন, পিরোজপুরের নাসিরাবাদ, যশোর সদর ও কেশবপুর, ডেমরার যাত্রাবাড়ি, পিরোজপুর সদর, সিলেটের বিশনাথ, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা, ফেনী সদর, বাগেরহাট সদর, চট্টগ্রামের রাউজান, রাজশাহীর দুর্গাপুর, নাটোর সদর, পাবনার বেড়া ও সাথিয়া। এসব জায়গার সম্ভাব্য আসামিদের নামও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে জানানো হয়। জেলাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওইসব জায়গায় ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার বিষয়ে মামলা করার কোনো নির্দেশনা যায়নি।

২০০৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সাবেক জেলা ও  দায়রা জজ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনা, ঘটনার কারণ এবং এরসঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের জন্য এ কমিটি করা হয়। কমিটি গত বছরের ২৪ এপ্রিল পাঁচ খণ্ডে এক হাজার ৮০ পাতার প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে।

বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রধান সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং দুদকের কমিশনার মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা না নেয়া প্রসঙ্গে বলেন, তিনি আশা করেন প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। এতদিনেও ব্যবস্থা না নেয়াকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জানা যায়, কমিশনের প্রতিবেদনে অপরাধীদের ছবিসহ ঘটনার তথ্য প্রমাণ উপস্থান করা হয়েছিল। তারপরও ব্যবস্থা না নেওয়া প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত সচিব মাইন উদ্দীন খন্দকার বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে প্রয়োজীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পুলিশ প্রক্রিয়া নির্ধারণ শেষে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বিচার বিভাগীয় কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জেলাভিত্তিক তালিকা করে আর্থিক সাহায্য দেয়ার সুপারিশ করেছিল। তাও করা হয়নি। ওই ঘটনায় সে সময়ে দায়ের করা কোনো মামলা প্রত্যাহার, কিংবা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হলে তা পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি।

রামুর সবচেয়ে বড় সীমা বিহারের বর্ণনা এরকম: সেখানে দেখি পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে কাঠের কাঠামো। বিহারের একটি বারান্দায় পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তির তাঁর চোখের মণিদুটো সাদা। চোখের মণিদুটো ছিল অতি মূল্যবান পাথরের। আক্রমণকারীরা আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগে মণিদুটো খুলে নিয়েছে। বিশাল মূর্তিটির পায়ের কাছে লম্বা পাটাতন বরাবর ছোট ছোট আরও প্রায় অর্ধশত মূর্তি। কোনোটি ধাবত, কোনোটি পাথুরে। আগুনে কোনোটি জ্বলে গিয়ে রং হারিয়েছে, কোনোটি কালিলিপ্ত, কোনোটি ফেটে চৌচির। কয়েকটির মাথা পড়ে আছে কোলের কাছে। মূর্তিগুলোর পাশে দেখা গেল পোড়া ও আধাপোড়া ত্রিপিটক, আরও কিছু গ্রন্থ।

একই বিহারের আরেক পাশে বিশাল একটি ঘরের দরজা খুলে দিলেন একজন। জুতো খুলে ঢুকলাম সিংহবিহার বুদ্ধমূর্তির ঘরে। ভেতরে এক কনুইয়ে ঠেস দিয়ে আধাশোয়া বুদ্ধমূর্তি: তাঁর চোখদুটিতে বুদ্ধের স্বভাবসুলভ স্থৈর্য, কিন্তু নাকের একাংশ ভাঙা। আক্রমণ চলেছে এখানেও। ভাঙার চেষ্টাও চলেছে, কিন্তু বৌদ্ধমূর্তিটি কঠিন ধাতুতে গড়া। নাক ছাড়া তেমন কিছু ভাঙেনি। সেখানেও ছোট ছোট অনেক মূর্তি ভাঙা। একজন বললেন, অনেক মূর্তি আক্রমণকারীরা নিয়ে গেছে! একজন বললেন, ধাতব দানবাক্সের তালা খোলা হয়েছে ধাতু গলিয়ে। কী উপায়ে সেটা করা হয়েছে, সেটা তাঁর কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার।

হঠাৎ দরজার কাছ থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠে কান্নার শব্দ। তাকিয়ে দেখি, দরজার বাইরে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরের বৌদ্ধমূর্তির দিকে জোড়াহাত তুলে কাঁদছেন এক নারী: ‘ও ভগবান!’

অগ্নিসংযোগের ব্যাপারে প্রায় সবারই অভিযোগ, আক্রমণকারীরা আগুন লাগানোর আগে ‘গান পাউডার’ ও কেরোসিন ছিটিয়েছিলেন, ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। গান পাউডার প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি গান পাউডার চেনেন? একজন বললেন, ‘সাদা সাদা পাউডারের মতো’। বারুদ ছিটানো হয়ে থাকতে পারে, কারণ ধাতব যেসব বুদ্ধমূর্তি আগুনে ফেটে গেছে, সেগুলোতে উচ্চমাত্রার তাপ সৃষ্টি হয়েছিল।

অহিংসা ও প্রচারক বুদ্ধেও মূর্তিতে এমন বর্বর হামলা দেখে ভিক্ষুরা শোকে স্তব্ধ। ঘটনার পরদিন লাল চিং বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষু ওয়েছেকা ছারা মহাথেরো (৮৭) সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা কোনো পাপ করেছিলাম। নইলে এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে হলো কেন?’ একজনকে জিগ্যেস করলাম, আপনিও এ রকম মনে করেন? তিনি দূরে ধ্যানমগ্ন মণিহারা বুদ্ধের দিকে তাকালেন শুধু। কিছু বললেন না।

বর্ষীয়ান  ভিক্ষুর মতো  এই ধ্বংসাত্মক হামলাকে  আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ তাঁদের কোনো অজানা পাপের ফল মনে করেন না তরুণেরা।   তারা জানেন কারা আক্রমন করেছে , কারা ইন্ধন দিয়েছে। কারণ তারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। বাইরে উত্তেজনা দেখে বৌদ্ধ তরুণ-যুবকেরা এসে জড়ো হয়েছিলেন সীমা বিহারে, মূর্তি পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু থানার ওসি (এ কে নজিবুল ইসলাম) এসে তাদের বলেন, ‘আপনারা বাড়ি চলে যান, কেউ এখানে আক্রমণ করতে আসবে না। যদি আসে আমরা সেটা দেখব। ’ তরুণ-যুবকেরা চলে যাওয়ার পর দলে দলে লোক এসে আক্রমণ শুরু করে। তারা বললেন, ‘পুলিশ প্রশাসন চাইলে আক্রমণ অবশ্যই ঠেকাতে পারত, কিন্তু পুলিশ তা চায়নি। ’ আমার প্রশ্ন ওসি নজিবুল ইসলাম কেন বৌদ্ধ যুবকদের চলে যেতে বললেন? তার সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা জরুরি।

সংবাদপত্রের আরও একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরছি এখানে। নারীরা অশ্র সজল  চোখে বলছেন, ‘আমাদের প্রতিবেশীরা মুসলিম, সারা জীবন আমরা পাশাপাশি বসবাস করি; কিন্তু হামলার সময় তারা কেউ আমাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। ’ তারা কখনো কল্পনাও করেননি, তাদের সম্প্রদায়ের ওপর এ রকম হামলা হতে পারে। বাকি জীবন এখানে কীভাবে কাটাবেন এটাই তাদের শংকা। প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, আর কোনো বিপদ নেই। তারা ভরসা পাচ্ছেন না।

অনেকের  সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু পরে সেখানে ছুটে এলেন তার এক মেয়ে। তিনি কাকতি-মিনতি করতে লাগলেন, তাদের বাড়িটি দেখতে যাওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তার বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। শুধু ইটের কয়েকটি দেয়াল ছাড়া পাঁচ ঘরের বাড়িটির সব কিছু ভস্ম হয়ে গেছে। শ্রীকূল পাড়ায় লালচিং বৌদ্ধবিহারের ছাইভস্মের ওপর দাঁড়িয়ে ৭৮ বছর বয়সী বঙ্কিম বড়ুয়া বর্ণনা করছিলেন সেই রাতের বিভীষিকার কথা। তার মনে রাজ্যের প্রশ্ন: ‘এত মানুষ কোত্থেকে এসেছিল? কারা এসব মানুষ? কেন আমাদের ওপর ওদের এত ক্রোধ? আমরা ওদের কী করেছি?’ বঙ্কিম বড়ুয়া ধর্মীয় অনুভূতির ওপর কথিত আঘাতের বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলেন না বলে মনে হলো। কিন্তু এটা তারা ঠিকই বুঝে ফেলেছেন, এই ঘর আর তাঁদের নিরাপদ নিবাস নয়।

সরকারের কাছে এখন আপনারা কী চান? এই প্রশ্নের উত্তরে নিরাশ কণ্ঠে আঞ্চলিক ভাষায়  সাংবাদিকদের যা বললেন, তা এই রকম, ‘সরকারের কাছে আর কী চাইব? এখন তো রাস্তা দেখতে হবে। ’ কিসের রাস্তা? কোথায় যাবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে গেছেন; আক্রমণ করা হয়েছে বেছে বেছে বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়গুলোতে, পাশের মুসলমান বাড়ি ও দোকানে একটি ঢিলও পড়েনি। এ কাজ শুধু বাইরের লোকেরা এসে করেনি, কারণ বাইরের লোক জানে না, কোন বাড়িটা বৌদ্ধের কোনটি মুসলমানের। বঙ্কিম বড়ুয়ার মনে ভয় ঢুকে গেছে এই কারণে যে, তার প্রতিবেশীদের অনেকেও ছিলেন আক্রমণকারীদের সঙ্গে।

রামু থেকে ৩০-৩২ কিলোমিটার দূরে উত্তর মিঠাছড়ি হাজারিকুল বৌদ্ধবিহার । সংবাদে প্রকাশ,  প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ করুণাশ্রয়ী ভিক্ষুকে  অভয় দিচ্ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ জিল্লুল হক। কমান্ডার ভিক্ষুকে বলছিলেন, ‘আর কোনো ভয় নেই। আমরা সবখানে পর্যাপ্ত শক্তি নিয়ে এসেছি। আপনাদের কিছু হবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন। ’ কমান্ডার একটু দূরে চলে গেলে ভিক্ষু তার মনের গভীরে যে শংকা, তা সাংবাদিকদের কাছে অস্বীকার করতে পারলেন না ।

রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার তৃতীয় দিনের চিত্র পড়লাম দৈনিক পত্রিকায় ; চতুর্থ দিনে এই লিখাটি লিখছি সিএনজি টেক্সিতে বসে বসে। অনেক দেরী হয়ে গেছে , আর দেরী করা চরম অন্যায়।    রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি; মহামতি গৌতম বুদ্ধ বিশ্বে  শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্যে সাধনা করে গেছেন। আর ধ্বংস নয়, শান্তির আবাহনে ধ্বংসস্তুপে নতুন চারার জন্ম হোক। আবার নতুন স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গুক টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার শান্তিপূর্ণ মানুষদের।  
[email protected]

বাংলাদেশ সময় ২০১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১২
এমএমকেঃ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।