গত ২৫ ডিসেম্বর ছিল বড়দিনের ছুটি। অফিস-আদালত সব বন্ধ।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রায় পাঁচ মাস শেষ হতে চলল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই সরকার দেশে স্বাভাবিক অবস্থা তো ফিরিয়ে আনতেই পারেনি, বরং নিত্যনতুন সমস্যাকে যেন নিজেরাই আলিঙ্গন করছে। প্রশাসনের মধ্যে প্রথম দিকে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। তরুণ মেধাবীরা বৈষম্যহীন প্রশাসনে কাজ করার জন্য ছিলেন প্রস্তুত। বেশ কিছু অতি উৎসাহী চাটুকার এবং আমলাদের অবসরে পাঠানোর পর তরুণ মেধাবীরা আশা করেছিলেন, এবার তাঁদের ওপর দায়িত্ব আসবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে তাঁরা হয়তো পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। ১২ বছর আগে অবসর নেওয়া ব্যক্তিদের ডেকে ডেকে সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিগুলো সবই চুক্তির দখলে চলে যাচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এক বাম্পার ফলন যেন সারা প্রশাসনকে গ্রাস করে ফেলেছে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিয়েছে। যা একটি নির্বাচিত সরকারের কাজ। এই অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনকেই অস্থির করে ফেলেছে। আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বে অচল প্রায় প্রশাসন।
চিকিৎসকরাও দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায়। ঢাকা শহরে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটছে। একসময় ঢাকা শহরের নাম ছিল ‘মসজিদের শহর’। পরে অনেকেই ঢাকা শহরকে ‘যানজটের শহর’ বলেন। এখন হয়ে গেছে ‘অবরোধের শহর’। আপনি ঘর থেকে বেরোবেন, কোথায় কখন কোন দাবিতে অবরোধ হবে আপনি জানেন না। আপনাকে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়তে হবে। ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প সব স্থবির হয়ে আছে। কোনো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কোনো নতুন উদ্যোগে হাত দিচ্ছেন না। শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের করা হচ্ছে নানাভাবে হয়রানি। শিল্পকারখানাগুলোতে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনার বিচার হয়নি। দুর্নীতি দমনের নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে শিল্প-উদ্যোক্তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। চালের বাজারে অস্থিরতা। অর্থনীতিতে আজ মহাবিপৎসংকেত।
অন্তর্বর্তী সরকারের কারও কারও মধ্যে যেন আওয়ামী লীগের ‘রোগ’ পেয়ে বসেছে। এ যেন নতুন বোতলে পুরনো মদের মতোই। আওয়ামী লীগ সরকার যেমন বিরুদ্ধ মতকে কঠোরভাবে দমন করেছিল, ভিন্নমতের কোনো স্থান ছিল না, এখনো তেমন হচ্ছে। সরকারের ভিতর সহনশীলতার অভাব আগের মতোই। সমালোচনা সহ্যের মানসিকতা নেই অনেকের। তারা যা করছে, সেটাই সঠিক- এ রকম ভাবনা সরকারের কারও কারও মধ্যে। আওয়ামী লীগের সময় মামলা বাণিজ্য ছিল রমরমা। ঠিক তেমনি এখন মামলা বাণিজ্য সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় পাঁচ মাসে আওয়ামী লীগ সরকারকেই হার মানিয়ে ফেলেছে। ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দিয়ে বিচারকেই একটা প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। যেখানে যে পারছে মামলা দিচ্ছে। পরে চলছে নাম বাদ দেওয়ার নামে চাঁদাবাজি। বাদী জানে না মামলা হয়েছে। এমনকি বাদী কোনো আসামিকেও চিনে না। রাজনীতিবিদ থেকে ব্যবসায়ী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ চাকুরে, সবাই হত্যা মামলার আসামি। সারা দেশে এ রকম মামলার হয়রানির শিকার কয়েক লাখ মানুষ। মৃত ব্যক্তিও আসামি। এ যেন হুবহু আগের সরকারের ধারাবাহিকতা। একই রকম চলছে ‘কৃতিত্ব’ দাবির ক্ষেত্রেও। সরকারের ভিতর ‘বাচাল’ লোকজনের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে বেসামাল কথাবার্তা। আওয়ামী লীগ আমলে যেমন কিছু বাচালের কথার অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়েছিল, এখন তেমন কোনো কোনো ব্যক্তি এমন সব উদ্ভট কথা বলছেন, মানুষ হাসবে, না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছে না। সরকারের কেউ কেউ টেলিভিশনে চেহারা না দেখালে যেন পাগল হয়ে যান। বেসামাল কথাবার্তায় মানুষের কান ঝালাপালা। এ পরিস্থিতিতে দেশ আসলে কে চালাচ্ছে- সেটি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সিংহাসনের পেছনে আসলে কার ছায়া? ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত, প্রশংসিত এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর কর্তৃত্বে যেন দেশ নেই। উপদেষ্টা কিংবা উপদেষ্টার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। মাঝেমধ্যে মনে হয় দু-চারজন উপদেষ্টাই যেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁরা সব বিষয়েই কথা বলেছেন বটে, কিন্তু সমস্যার দায় নিচ্ছেন না। এ নিয়ে জনমনে নানা রকম প্রশ্ন। উপদেষ্টামণ্ডলী যে ক্ষমতার আসল মালিক নন, তা-ও এখন স্পষ্ট। মাঠে সেনাবাহিনী রয়েছে কিন্তু সেনাবাহিনী সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে শুধু আইনশৃঙ্খলার জন্য সহযোগিতা ছাড়া অন্য কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করছে না। এখন পর্যন্ত যেটুকু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি টিকে আছে, সেটি সেনাবাহিনীর মাঠে উপস্থিতির কারণে। সরকারের অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে সশস্ত্র বাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। কাজেই সেনাবাহিনীও দেশ পরিচালনা করছে না। তাহলে কার ইশারায়, কার ইঙ্গিতে দেশ পরিচালিত হচ্ছে? মানুষ ইদানীং রসিকতা করে বলে, দেশ আসলে কেউই চালাচ্ছেন না, দেশ চলছেই না। সচিবালয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না, স্থবির। থানায় মামলা দিলে, সেই মামলার তদন্ত হচ্ছে না। চিকিৎসকরা ঠিকঠাকমতো চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা নিরাপদে-নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারছেন না। শুধু আছে হুমকিধমকি এবং দম্ভোক্তি। বাংলাদেশ যেন এখন একটা পথহারা দেশ। এই দেশের গন্তব্য কোথায় কেউ জানে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আরেক বড় রোগ ছিল সব কিছুর জন্য বিএনপিকে দায়ী করা। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কারও কারও মধ্যেও সেই রোগ প্রকটভাবে সংক্রমিত হয়েছে। যে কোনো বিষয় ব্যর্থ হলেই আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপানোর সহজ কৌশলের মাত্রা ছাড়া প্রয়োগ হচ্ছে। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ই যেন আত্মতৃপ্তির পথ খুঁজছে এই সরকার।
দেশ এক গভীর সংকটে, তা কেউ অস্বীকার করছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে করণীয় কী? সবাই এখন মোটামুটি একমত, একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই এই সরকারের ‘সেফ এক্সিট’ হতে পারে। একটি নতুন নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমেই বর্তমান অচলাবস্থার অবসান ঘটতে পারে। দেশ একটি সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যেতে পারে। পথহারা বাংলাদেশ পথের ঠিকানা খুঁজে পেতে পারে। এই সরকার ৫ আগস্টের পর যে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল এখন তার জনপ্রিয়তা তলানিতে। দিন যতই যাবে এই জনপ্রিয়তা কমতেই থাকবে। এ কারণে সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের পথে যাওয়া উচিত। কিন্তু সরকার নানা রকম সংস্কার কমিশন করে কালক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেকেই বলেছেন, সংস্কার শেষ করে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এসব কথা জন-আকাক্সক্ষার পরিপন্থি। এসব সংস্কারের ব্যাপারে জনগণের ম্যান্ডেট কতটুকু, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। সংস্কার কমিশনের লোকজন সকালে এক রকম, বিকালে আরেক কথা বলছেন। কাজের চেয়ে নিজেদের প্রচারণায় তাঁদের মনোযোগ বেশি। রিপোর্ট দেওয়ার আগেই তাঁরা অবিরাম কথা বলে চলেছেন। তাঁরাও যেন একেকজন উপদেষ্টা। কাজের চেয়ে টেলিভিশনে উপস্থিতির ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ বেশি। সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে এই সরকার আরও নানা রকম সমস্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে একটা হযবরল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এই সরকার দেশকে আরও গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। তাই দ্রুত এখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাটা এই সরকারের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হবে। যদি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাহলেই হবে তাদের জন্য সবচেয়ে সম্মানের কাজ। এর ফলে দেশও পরিত্রাণ পাবে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে এই সরকারের বিরুদ্ধেই জনগণ মাঠে নামবে, আন্দোলন করবে। ইতোমধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁওয়ের জনসভায় এ ব্যাপারে জনগণকে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তিনি জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক নেতা। জনগণের অনুভূতি বোঝেন। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মানুষ আর পারছে না। কর্মসংস্থান নেই, কোথাও কোনো আশার আলো নেই। বাংলাদেশ যেন এক অন্ধকার টানেলে পথ হারিয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া দরকার। আর এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক- এটা সবাই প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশে এখন যে বিদ্যমান সংকট, সমস্যাগুলো আছে এবং নিত্যনতুন দাবিদাওয়া তৈরি হচ্ছে তার সমাধান করতে পারে একমাত্র জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। যাঁরা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তাঁরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তাঁরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তখন বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচিত সরকার নিশ্চয়ই সমাধানের পথ বের করবে। তাঁদের পেছনে থাকবে জনসমর্থন এবং জনগণের ম্যান্ডেট। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ৫৩ বছরে বাংলাদেশ নানা চড়াই-উতরাই পার করেছে। এ সময় নানা রাষ্ট্র সংস্কার হয়েছে। সংস্কার কোনো অ্যান্টিবায়োটিক না। নির্দিষ্ট ডোজ দিলে সব সমস্যা মিটে যাবে। ইতোমধ্যে বিএনপি ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের অবস্থান থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের নানা প্রস্তাব দিয়েছে। জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক। তারা ঠিক করবে কোন সংস্কার তারা গ্রহণ করবেন, কোনটি করবেন না। স্যুট-টাই পরা জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা কোন অধিকারে তাদের অভিপ্রায় জনগণের ওপর চাপাবেন? সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ এই সরকারকে ব্যর্থ করবে। এই অন্তর্বর্তী সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে গণ অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। আর সে কারণেই সরকারের ভিতর বোধোদয় দরকার। তাদের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। কাজেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে। বাংলাদেশ যে এখন পথ হারিয়েছে সেই পথের ঠিকানা একটাই- তা হলো নির্বাচন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
লেখক: নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২৫
এমএম